আফছারুল আমীন : নেন না প্রটোকল-গানম্যান, ব্যবহার করেন না স্টিকার-পতাকা


আবু আজাদ : প্রায়-সব সংসদ সদস্য যেখানে পুলিশ প্রটোকল নিয়ে ঘুরে বেড়ান, সরকারি-বেসরকারি গানম্যান সঙ্গে রাখেন, দলীয় সন্ত্রাসী-মান্তানের পাহারায় থাকেন সেখানে তার বিপরীতে একেবারে সাদামাটা, নির্লিপ্ত জীবনযাপন করেন ডা. আফছারুল আমীন।

চট্টগ্রাম-১০ আসনের বর্তমান সংসদ সদস্য ছাড়াও শিক্ষা মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি তিনি। ছিলেন সরকারের নৌ পরিবহন, প্রাথমিক ও গণশিক্ষামন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী।

সরকারের আইন প্রণয়ন সংক্রান্ত প্রস্তাব মূল্যায়ন এবং সরকারের নির্বাহী বিভাগের কর্মকাণ্ড পরিচালনার এমন পদে থেকেও নিরহঙ্কার এ মানুষটির চলাফেরা নিতান্তই সাদামাটা, অন্য দশজনের মতো।

মন্ত্রণালয় থেকে বরাদ্দের গাড়িটিও চট্টগ্রামে তিনি ব্যবহার করেন না। নিজের প্রাপ্য থাকার পরেও নেন না পুলিশ প্রটোকল, গানম্যান। গাড়িতে লাগান না সংসদ সদস্যের স্টিকার কিংবা সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতির পতাকা।

বৃহস্পতিবার (১৯ এপ্রিল) সকালে তার হালিশহরের পৈত্রিক বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, বাড়ির আঙিনায় ক্যাজুয়াল (নৈমত্তিক) ড্রেস পরে দাঁড়িয়ে আছেন। মাঝে মাঝে বাগানের পরিচর্যারত মালিকে কাজ বুঝিয়ে দিচ্ছেন আফছারুল আমীন। ফাঁকে পাড়ার লোকজনের সঙ্গে কুশল বিনিময় করছেন। দূর-দূরান্ত থেকে আসা লোকজনও সরাসরি চলে যাচ্ছেন একেবারে তাঁর সামনে। আফছারুল আমীন খুব সহজে তাদের গ্রহণ করছেন, কথা বলছেন, সমস্যা শুনে সমাধানের চেষ্টা করছেন।

এসময় সাইকেলে চড়ে আসা এক যুবককে দেখে আফছারুল আমীন বললেন, ‘ওডো কেন আছোস? তুর হাক্কুর কি অবস্থা? ওপেন হার্ড সার্জারি গরাইয়ুস বলে, আরারে তো ন জানালি (কেমন আছিস? তোর চাচার কী অবস্থা, ওপেন হার্ট সার্জারি করিয়েছো নাকি, আমাদের তো জানালে না)।’

আরেক যুবককে ডেকে ঠাট্টা করলেন এমপি আফছারুল; বলেন, ‘ওডো তুরে-ত পাহারতলির পোয়া-অলে তুয়ার, কিজ্জুস আল্লাই এনা জানে (তোকে তো পাহাড়তলির ছেলেরা খুঁজছে, কী করেছিস আল্লাহই জানে)।’

এভাবে হাসি-ঠাট্টায় দর্শনার্থীদের গ্রহণ করছেন তিনি। কখনো দাঁড়িয়ে, হেঁটে হেঁটে আবার দর্শনার্থী কক্ষে সকাল ১০টা পর্যন্ত সংসদীয় এলাকার মানুষদের সময় দিয়ে নিজের গাড়িতে উঠে নিজ কার্যালয়ের (ডাক্তারি চেম্বার) উদ্দেশ্য রওনা হন আফসারুল আমিন।

পাঁচ বছর মন্ত্রী, নয় বছরের বেশি সময় ধরে এমপি। কিন্তু একটুও পরিবর্তন হয়নি তাঁর বাড়ি, অফিসঘর। দেওয়ানহাটের মোড়ের অফিসকক্ষটা এখনো আগের মতো। জীর্ণশীর্ণ কক্ষ, পুরোনো পর্দা, নেই কোনো সাজসজ্জা। ছোট্ট এই অফিস ঘরেও বড় বেশি সাদামাটা, সপ্রতিভ আফছারুল আমীন। কেবল একটি অনাড়ম্বর টেবিল ঘিরেই তাঁর জগৎ।

ডা. আফছারুল আমীনের ব্যক্তিগত সহকারি (পিএ) তুষার একুশে পত্রিকাকে বলেন, অনেকদিন স্যারের সঙ্গে আছি। স্যার চট্টগ্রাম এলে সিএমপির নগর বিশেষ শাখা (সিটিএসবি) থেকে ফোন করা হয়, জানতে চায় পুলিশের গাড়ি, পুলিশ এবং গানম্যান লাগবে কিনা। কিন্তু স্যার বরাবরই এসব এড়িয়ে চলেন। তাদের নিরুৎসাহিত করেন। বলেন তুষার।

চারপাশে ক্ষমতা, অর্থ আর প্রভাব-প্রতিপত্তির ভিড়ে প্রকৃতার্থেই বৈধ একজন ক্ষমতাবান মানুষের এমন ক্ষমতাহীন, সাধারণ চলাফেরা অনেককেই বিস্মিত করে। গর্ববোধ করেন তাঁর সংসদীয় এলাকার মানুষজন।

চট্টগ্রাম-১০ সংসদীয় আসনভুক্ত সরাইপাড়া, পাঠানটুলি ও উত্তর আগ্রাবাদ ওয়ার্ড থেকে নির্বাচিত তিনবারের কমিশনার অ্যাডভোকেট রেহানা বেগম রানু এ প্রসঙ্গে একুশে পত্রিকাকে বলেন, আফছার ভাই আমাদের অহঙ্কারের প্রতীক। পাঁচবছর মন্ত্রী, নয়বছরের বেশি এমপি। ক্ষমতার চূড়ায় থেকেও লোভ, হিংসা, অনৈতিকতা তাকে বিন্দুমাত্র স্পর্শ করতে পারেনি। একেবারে সাদামাটা, অনন্য সাধারণ তাঁর জীবনাচরণ। এমন নেতা সমাজে কমই আছে।

পাঠানটুলি এলাকার বাসিন্দা সফটওয়্যার ব্যবসায়ী এম আজাহার উদ্দিন বলেন, ডা. আফছারুর আমীনের মতো সাদামাটা মানুষ আমি আর দেখিনি। তাঁর রাজনৈতিক দর্শনটাই অন্যরকম, আলাদা। শোডাউন, লোকদেখানো, মিথ্যা আশ্বাস-প্রতিশ্রুতি, স্ট্যান্টবাজি তিনি অপছন্দ করেন। এমন মানুষকে নেতা বা এমপি হিসেবে যারা পেয়েছেন তারা ভাগ্যবান।

এসব বিষয়ে জানতে চাইলে ডা. আফছারুল আমিন একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘আমি চট্টগ্রামের ছেলে, এখানে জন্ম, এখানেই বেড়ে উঠা। আমাকে কেন পুলিশ প্রটোকল নিয়ে চলতে হবে? মৃত্যু আসলে পুলিশ কি আমাকে বাঁচাতে পারবে?

তিনি বলেন, ক্ষমতা আজ আছে, কাল নেই। তাই আমি ক্ষমতার অপব্যবহার করি না। স্ট্যান্ডিং কমিটির চেয়ারম্যান হয়েও গাড়ি, প্রটোকল, গানম্যান বর্জন করে চলি। আমি চাই না আমার সামনে-পেছনে হুইসেল দিয়ে গাড়ি চলুক, লোকজন বাহবা দিক, সরকারি অর্থ ও সম্পদের অপচয় হোক। মন্ত্রী থাকাকালেও এসব বর্জন করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু পারিনি, রাখতে বাধ্য হয়েছিলাম।

আফছারুল আমীন আরো বলেন, ‘শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে আমার জন্য একটি গাড়ি বরাদ্দ থাকলেও তা আমি ঢাকায় গেলে ব্যবহার করি, এখানে আল্লাহর রহমতে আমার নিজের গাড়ি আছে। অনেক পুরোনো এ গাড়িটা ১৬ লাখ টাকায় কেনা। আর আমি রাস্তায় যাবো বলেই সামনে পেছনে গাড়ি দৌড়াতে হবে বিষয়টা আমার সঙ্গে যায় না। এটা অভিরুচির ব্যাপার।

আমি চাই মানুষ আমাকে তাদের কাছে পাক। আমি মারা গেলে মানুষ জানাজা আর কালেমা পড়ে আমাকে বিদায় দিক। বলেন ডা. আফছারুল আমীন।

একুশে/এএ/এএইচ/এটি