চট্টগ্রাম : কোনো কাজকেই ছোট ও অসম্মানের মনে করেন না চিত্তরঞ্জন বিশ্বাস। জীবন-সংগ্রামের শুরুর দিনগুলোতে ভ্যানগাড়ি চালিয়েছেন, করেছেন দিনমজুরি। তাতে হীনন্মন্যতায় ভোগতেন না কখনো। ভাবতেন চুরি তো আর করছেন না, করছেন কর্ম। তাই ভ্যান চালানোকে তিনি বিমান চালানো মনে করতেন। আর মজুরির কাজকে মনে করতেন অফিসের কাজ।
দিনভর ঘামঝরানো কাজের মাঝেও নিজেকে সুখী ভাবতেন। সম্মানিত বোধ করতেন। আত্মবিশ্বাস ও মনোবল চাঙ্গা রেখে বলতেন- সুদিন আসবেই। টাকার পেছনে নয়, একদিন টাকাই তার পেছনে ছুটবে। জীবনের একটা সময়ে এসে তাই হয়েছে। বাস্তবে টাকাই এখন তার পেছনে ছোটে।
টাকাকে পেছনে ছোটানোর কসরত করতে গিয়ে একসময় যুক্ত হন ধানের ব্যবসায়। পুঁজি নেই তেমন। সৎ, কর্মঠ বলে এলাকার মানুষ চিত্তরঞ্জনকে পছন্দ করতেন। তাই অনেকেই বাকিতে ধান দিতেন। কিছুদিন মজুদ রাখার পর বাড়তি দাম পেলে লভ্যাংশ নিজের কাছে রেখে মানুষের পাওনা টাকা পরিশোধ করে দিতেন।
শুভার্থীদের টাকায় ব্যবসা করে সংসারে স্বচ্ছলতা আনার পাশাপাশি নিজের ৫ লাখ টাকা মূলধান দাঁড় করিয়ে ফেলেন চিত্তরঞ্জন। কিন্তু সেই টাকা বাতাসে মিলিয়ে যেতে সময় লাগেনি।
‘৯৬ সালের শেষের দিকে ধানের বাজারে আকস্মিক ধস নামে। ধানের বাজার এত নিচে নেমে গিয়েছিল যে, ৫ লাখ টাকা মূলধন এসে ঠেকে দেড় লাখ টাকায়। অন্যদের থেকে ধার নিয়ে মজুদ করা ২০ লাখ টাকার ধান হয়ে যায় ৬ লাখ টাকা। বিশাল এই ক্ষতির মুখে রীতিমতো বিধ্বস্ত চিত্তরঞ্জন। বন্ধ হয়ে যায় ব্যবসা-বাণিজ্য। থমকে যায় জীবনের গতি। একদিকে সংসারের খরচ অন্যদিকে মানুষের টাকা।
চরম এক সঙ্কটাপন্ন অবস্থায় একদিন একদিন মুখোমুখি হন পদুয়া ইউনিয়নের উদালবুনিয়া এলাকার তৎকালীন ধনাঢ্য ব্যবসায়ী প্রয়াত ফয়েজ আহমেদ তালুকদারের। একচেটিয়া ধানের ব্যবসা তাঁরও। জীবনের টর্নেডোতে বিধ্বস্ত চিত্তরঞ্জনের কাছে ত্রাণকর্তা হিসেবে আবির্ভূত হন ফয়েজ আহমেদ। বলেন, কোনো চিন্তা করো না, আমার কাছ থেকে টাকা নিয়ে ধান কিন, বিক্রির পর টাকা ফেরৎ দিও।
শুরু হলো চিত্তরঞ্জনের নতুন অধ্যায়, নতুন যুদ্ধ। এই যুদ্ধে ঝুঁকিটা আরও বেশি। এবারের যুদ্ধে পরাজিত হলে উঠে দাঁড়ানোর একদম সুযোগ নেই। আগের দেনা, নতুন দেনা- সবমিলিয়ে দায়টা বেশ বড়ই। যাই হোক, পেছনে আর তাকাতে চান না চিত্তরঞ্জন। ঘুরে এবার দাঁড়াতেই হবে, মনে মনে পণ করেন দৃঢ়চিত্তের চিত্ত।
‘৯৭ সালের ঘটনা। নগরীর দুই নম্বর গেইটে এক মুসলিম বন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে আসেন চিত্তরঞ্জন। বন্ধুর সঙ্গে সাক্ষাৎ শেষে সেদিনই বাড়ি ফিরে যাবার কথা। বন্ধু বললেন, শাহ আমানত শাহ’র মাজার জেয়ারত করতে যাবো। আপত্তি না থাকলে তুমিও যেতে পারো আমার সঙ্গে। সানন্দে গেলেন বন্ধুর সঙ্গে।
গিয়ে ভীষণ মগ্ন হলেন, ধ্যানে পড়লেন! প্রার্থনা করতে করতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়লেন কিছুই জানেন না চিত্তরঞ্জন। ঘুমের মাঝে স্বপ্ন দেখেন শাহ আমানত শাহ (রহ.)কে। সেদিনের স্মৃতি হাতড়াতে গিয়ে চিত্তরঞ্জন জানালেন, স্বপ্নে দেখলাম, শাহ আমানত শাহ বাবাজি আমাকে দোয়া করছেন, মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন।
এরপর ঘুম ভাঙলে নিজেকে আবিষ্কার করি শাহ আমানত শাহ’র মাজারে। একি দেখলাম! মাজারেই ঘুম, মাজারেই স্বপ্ন, মাজারেই বাবার দেখা! পবিত্র মনে আবারও প্রার্থনা করে ফিরে এলাম বাড়িতে। বলেন চিত্তরঞ্জন বিশ্বাস।
চিত্তরঞ্জনের মতে, সেই থেকে তাকে আর পিছনে তাকাতে হয়নি। একে একে ভেঙেছেন সফলতার সিঁড়ি। ধানের ব্যবসায় সাফল্য পেয়েছেন, শোধ করেছেন ধারদেনা। রাঙ্গুনিয়া শিলক ইউনিয়নের আমতল এলাকায় লিয়াকত আলী মার্কেটে গড়ে তুলেন শাহ আমানত স্টোর ও শাহ আমানত এন্টারপ্রাইজ নামে দুটি ব্যবসা-প্রতিষ্ঠান। শাহ আমানত এক্সপ্রেস নামে শহর এলাকায় চালু করেছেন দুটি যাত্রীবাহী বাস। বিদেশে প্রতিষ্ঠিত করেছেন তিন ছেলেকে। তিনি এবং ছোট ছেলে দেশের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলো দেখাশুনা করেন। শিলকের ফিরিঙ্গিখিল এলাকায় পাকা দালান করেছেন। স্ত্রী, চার ছেলের বউ, নাতি-নাতনি নিয়ে সেই দালান যেন সুখী গৃহকোণ চিত্তরঞ্জন বিশ্বাসের।
চিত্তরঞ্জন দাশের কোনো মেয়ে নেই। ছেলের বউগুলোয় তার মেয়ে, পেটের সন্তান। তাদের চমৎকার মেলবন্ধনে তৃপ্ত, মুগ্ধ তিনি। বলেন, আমার ছেলের বউগুলো অসম্ভব ভালো, সৌহার্দ্যপূর্ণ স্বভাবের। বাপের বাড়িতে যেতে বললেও যায় না ওরা। আমার ঘরটাই যেন তাদের বাবার বাড়ি, আসল বাড়ি। এ নিয়ে বেয়াই-বেয়াইনরা মেয়েদের খোটা দেয়। বলেন, তোরা কি বিক্রি হয়ে গেছস, বাবার বাড়ির নাম-ধাম এভাবে ভুলে গেলি? মেয়েগুলো জবাব দেয়, বিক্রি হওয়া কিংবা ভুলে যাওয়ার বিষয় নয়। এটা ভালোবাসার বিষয়, অর্জনের বিষয়, বন্ধনের বিষয়। তাদের এমন কথায় আমি আরও নরম হই, আনন্দে চোখের জল ফেলি।
চিত্তরঞ্জন বিশ্বাস মনে করেন, এসবই শাহ আমানত শাহ বাবার দান, দয়া। তিনি দয়া এবং দোয়া করেছেন বলে আজ তার সংসারে কোনো অভাব নেই, দুঃখ নেই, কষ্ট নেই। নেই জাগতিক সমস্যা। তাই আজ পৃথিবীর সেরা সুখী মানুষ চিত্তরঞ্জন।
তার পরিবারের প্রতিটি সদস্য শাহ আমানত শাহ মাজারের পরম ভক্ত। যখন-তখন মাজারে ছুটে যান, প্রার্থনায় নত হন তারা। বার্ষিক ওরশ মাহফিলে সানন্দে অংশগ্রহণের পাশাপাশি বছরে একাধিকবার মাজারে আগনি (ডেক) রান্না করে দর্শনার্থীদের খাওয়াতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন।
অন্য এক প্রসঙ্গে চিত্তরঞ্জন বিশ্বাস একুশে পত্রিকাকে জানান, ‘ভক্তি-শ্রদ্ধা, বিশ্বাসের চেয়ে ধর্ম বড় নয়। আমি আমার ধর্ম পালন করেও শাহ আমানত শাহ বাবার পরিচালিত পথে নির্বান লাভ করছি। এক্ষেত্রে ধর্ম বাধা হতে পারেনি।’
এটি/একুশে