শনিবার, ১৮ জানুয়ারি ২০২৫, ৫ মাঘ ১৪৩১

কোন পথে এরদোয়ানের তুরস্ক?

| প্রকাশিতঃ ১৭ জুলাই ২০১৬ | ৮:১১ অপরাহ্ন

:: সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা ::

syed rezaবিফল অভ্যুত্থান, গদিচ্যুত হওয়ার মুখ থেকে বেঁচে গেলেন প্রেসিডেন্ট রিসেপ তায়িপ এরদোয়ান। কিন্তু তুরস্ক কী স্বাভাবিকতায় ফিরবে? কামাল আতাতুর্কের দেশে সেনাবাহিনীর এমন বিদ্রোহে বিপদের আঁচ পাচ্ছেন অনেকেই। দেশের দক্ষিণে ইরাক এবং সিরিয়ার মতো আইএস-জঙ্গি ঘাঁটির বিপদ ঘাড়ে নিয়ে থাকা তুরস্ক বহু দিন ধরেই মার্কিন মিত্র। সিরিয়ায় আমেরিকার আইএস-বিরোধী যুদ্ধেও অংশ নিয়েছে তারা। কারণ তাদের নিজের দেশেও ছায়া পড়ছে আইএসের। ইরাক, সিরিয়া থেকে আইএস জঙ্গিরা ঢুকে মাঝেমধ্যেই হামলা চালাচ্ছে।

অভ্যুত্থান ব্যর্থ হওয়ায় দেশটি আরও বেশি মৌলবাদী হয়ে উঠবে এমনটাই আশংকা। উদার অসাম্প্রদায়িক মানুষ, বিশেষ করে রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কর্মীদের বিরুদ্ধে নামবে, আরও বেশি কুর্দিবিরোধী হয়ে উঠবে, ধর্মনিরপেক্ষ মানুষদের আরও বেশি করে খাচায় ভরবে, গণমাধ্যমকে আরও দমিয়ে রাখবে এটাই এখন দুশ্চিন্তা। তুরস্কের চলাচল মৌলবাদের সাথে যার পেছনে প্রেসিডেন্ট এরদোয়ানের ভূমিকাই বেশি। মুসলিম বিশ্বের অনেক আলোচিত ব্যক্তি এখন এরদোয়ান। তিনি আমেরিকার বেশ কাছের লোক। ইসরাইলের সঙ্গেও তার সম্পর্ক এখন অনেক ঘনিষ্ঠ।

ন্যাটোর অন্যতম সদস্য তুরস্ক আইসিসের বিরুদ্ধে যতটানা যুদ্ধ করে, তার চেয়ে বেশি করে সিরিয়ায় অবস্থান নেয়া কুর্দিদের বিরুদ্ধে। তুরস্কের মোট জনসংখ্যার ১৫ থেকে ২৫ শতাংশ কুর্দি। তবে প্রকৃত সংখ্যা অজানা। কারণ এরদোয়ানের কুর্দি খুন উন্মত্ততায় সেই সংখ্যাও এখন কত তা বলা কঠিন। কুর্দিদের বেশিরভাগই বাস করে দক্ষিণ-পূর্ব সিরিয়া-ইরাক সীমান্ত এলাকায়।

প্রথম পারস্য উপসাগরীয় যুদ্ধের পর সেই সময়ের ইরাকের প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেন থেকে নিজেদের মুক্ত করে নিতে সক্ষম হয় কুর্দিরা। সিরিয়ায় গৃহযুদ্ধ শুরু হলে আ্ইএস আর আসাদ সরকারের বিরোধিতার মাঝে নিজেদের একটা অবস্থান নিশ্চিত করার চেষ্টা করতে থাকে তারা যেটা তুরস্কের মূল মাথাব্যথা। তুরস্ক একটি শক্তিশালী রাষ্ট্র, যেমন ছিলেন সাদ্দাম হোসের সরকার। তেমনি শক্তিশালী ছিল সিরিয়ায় বাশার আল আসাদের সরকারও। যুক্তরাষ্ট্রের কারণে আইএসকে মোকাবেলায় মাঠে নামলেও কার্যত কুর্দিদের নিশ্চিহ্ন করাই এরদোয়ানের বড় এজেন্ডা।

সনাতনী জাতীয়তাবাদী যে ধারণায় তুরস্কের পথচলা, সেখানে যে যে গোষ্ঠীরই হোক না কেন, সবাই তুর্কি এটাই বড় পরিচয় হওয়ার কথা। তুর্কিদের এই জাতীয়তাবাদী চরিত্রটি আরব জাতীয়তাবাদের মতো খুব পুরোনো নয়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের মধ্য দিয়ে অটোমান সাম্রাজ্যের পতনের পর তুর্কি জাতীয়তাবাদের কথাটাটি বেশি উচ্চারিত হতে থাকে। তুরস্ক বরাবরই বিভিন্ন জাতির সমন্বয়ে একটি দেশ। এখানে কুর্দিরা যেমন আছে, আছে আরব, জাজা, আলেভিসহ নানা জাতি গোষ্ঠী।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর আধুনিক তুরস্কের স্থপতি মুস্তাফা কামাল আতাতুর্ক চেয়েছিলেন সব জাতি-গোষ্ঠীকে এক ছাতার নিচে নিয়ে আসতে। কিন্তু কুর্দিরা তা মানেনি, কারণ পশ্চিমা শক্তি প্রতিজ্ঞা করেছিল তাদের আলাদা রাষ্ট্র দেয়া হবে। সেই থেকে আজ অব্দি কুর্দিরা রাষ্ট্র্রবিহীন একটি জাতি গোষ্ঠী যারা ছড়িয়ে আছে তুরস্ক, ইরাক, ইরান আর সিরিয়ায়। যুক্তরাষ্ট্র এরদোয়ানকে যেমন সমর্থন করে, তেমনি কাছে কুর্দিদেরও।

তুরস্ক শুরু থেকেই কুর্দিদের বিরুদ্ধে সাংস্কৃতিক আগ্রাসন অব্যাহত রেখেছে। আদিবাসি কুর্দিদের জোর করে সরিয়ে দেয়া হয় দেশের পূর্ব দিকে, আর ইউরোপীয় কুর্দিদের নিয়ে যাওয়া আরেক অঞ্চলে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, সরকারি অফিসসহ প্রকাশ্যে কুর্দি ভাষা উচ্চারণও নিষিদ্ধ ছিল ১৯৯১ পর্যন্ত। আসলে তুরস্কে কুর্দিদের সঙ্গে সমস্যাটি যতটানা জাতিগত, তার চেয়ে বেশি রাজনৈতিক। ১৯৮৪ সাল থেকে সোভিয়েত সমর্থিত পিকেকে নামে পরিচিত কুর্দিশ ওয়ার্কার্স পার্টি গেরিলাযুদ্ধে অবতীর্ণ হয়। এই লড়াইয়ে মারা যায় বহু মানুষ যাদের বেশিরভাগই কুর্দি। ২০১৩ থেকে ২০১৫ পর্যন্ত যুদ্ধবিরোধী চুক্তি করে পিকেকে চুপ করেই ছিল। তবে এরদোগানের বাহিনী ইরাকের কুর্দি অধ্যুসিত এলাকায় বোমার হামলা করলে আবারো শুরু হয় নতুন করে সংঘাত।

আইএসের সঙ্গে একদিকে তেলবাণিজ্য, অন্যদিকে বাশার আল আসাদের সঙ্গে বিরোধিতা, কুর্দি বিরোধিতা এবং নিজের দেশে উদার অসাম্প্রদায়িক শক্তিকে দমন করে, গণমাধ্যমের টুটি চেপে ধরে রেখে রেখে, এরদোয়ান নিজেই এখন তুরস্কের সবচেয়ে বড় সমস্যা। একজন কর্তৃত্ববাদী শাসক হিসবে এরদোয়ান গণমাধ্যমের ওপরে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছেন, সাংবাদিকদের ওপরে চালিয়েছেন নির্যাতন। সিরিয়ার আসাদ প্রশাসনকে টাইট দিতে তাঁকেই আমেরিকা তথা ন্যাটো অন্যতম বড় বাজি হিসাবে ধরেছিল৷ আর সেই সুযোগটাকে কাজে লাগিয়ে প্রশাসনে যারা উদারপন্থী তাদের নিশ্চিহ্ন করেছেন, অন্যদিকে দেশের বাইরে আইএসের মতো সন্ত্রাসবাদী শক্তিকে ঢালাও সমর্থন জুগিয়েছেন৷

এবারের অভ্যুত্থান ব্যর্থ হয়েছে। কিন্তু সমস্যা থেকে বের হতে পারেননি এরদোয়ান। অভ্যুত্থানের পেছনে যুক্তরাষ্ট্রে নির্বাসিত ধর্মীয় নেতা ফেতুল্লা গুলেনের হাত আছে বলে অভিযোগ করছে এরদোগান সরকার। তাকে ফেরত পাঠাতে মার্কিন সরকারের কাছে আহ্বান জানিয়েছেন তুর্কি প্রেসিডেন্ট। গুলেনকে নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে মন কষাকষি শুরু না হতেই এরদোগান সরকারের কোনো কোনো কর্মকর্তা বলতে শুরু করেছেন এরদোয়ান সরকার পতনে যুক্তরাষ্ট্রের হাত রয়েছে। তাই এখনই বলা যায় না নতুন কী সমস্যা অপেক্ষা করছে তুরস্কের জন্য।

লেখক: পরিচালক বার্তা, একাত্তর টিভি