খালেদার ঐক্যের ডাক ‘নাকচ’ প্রধানমন্ত্রীর

pm hasinaঢাকা: বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার জাতীয় ঐক্যের ডাক একরকম ‘নাকচ’ করে দিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেছেন, যাদের সঙ্গে ঐক্য হওয়ার তাদের সঙ্গে ঐক্য হয়েই আছে।

আজ রবিবার বিকাল চারটায় গণভবনে সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী এভাবেই খালেদা জিয়ার জাতীয় ঐক্যের ডাক সম্পর্কে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করলেন।

মঙ্গোলিয়ায় অনুষ্ঠিত দুই দিনের এশিয়া-ইউরোপ সম্মেলনে (আসেম) যোগদান শেষে গণভবনে এই সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়।

সম্প্রতি গুলশান ও শোলাকিয়ায় জঙ্গি হামলার পর বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে জাতীয় ঐক্যের ডাক দেন। এই ইস্যুতে খালেদা জিয়া জোট নেতা ও বিএনপি সমমনা বুদ্ধিজীবীদের সঙ্গে কয়েক দফা বৈঠকও করেছেন।

গুলশান ও শোলাকিয়ার ঘটনায় দেশের মানুষ শোকাবিভূত তখন বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সুশীল সমাজের পক্ষ থেকে জাতীয় ঐক্যের কথা বলা হচ্ছে- বিষয়টিকে আপনি কিভাবে দেখছেন এমন প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী পাল্টা প্রশ্ন করে বলেন, আপনি (সাংবাদিক) কি মনে করেন না সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে ইতিমধ্যে জাতীয় ঐক্য সৃষ্টি হয়ে গেছে? আমিতো মনেকরি জাতীয় ঐক্য সৃষ্টি হয়ে গেছে।

তিনি বলেন, যারা সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদ নিয়ে খেলে কিংবা আগুন দিয়ে মানুষ পুড়িয়ে হত্যার পথ বেছে নেয় সেই ঘাতকদের সঙ্গে যারা জড়িত তাদের কথা আলাদা। যাদের ঐক্য সৃষ্টি হলে সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদ মোকাবেলা সম্ভব তাদের ঐক্য সৃষ্টি হয় গেছে। এই ঐক্য কিন্তু থাকবে।

এসময় প্রধানমন্ত্রী প্রশ্ন করেন, সর্প হয়ে দংশন করবেন, আবার ওঝা হয়ে ঝাড়বেন?

বিএনপির সঙ্গে জাতীয় সংলাপ সম্পর্কিত অপর এক প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, তাদের সঙ্গে আলোচনায় বসলে সন্ত্রাসবাদ বন্ধ হবে । না হলে তারা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাবে? এটাই তারা বোঝাতে চাচ্ছেন?

উগ্রবাদীদের উদ্দেশ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তানেরা যাদের জীবনে কোন কিছুর অভাব নেই, চাওয়া পাওয়ার অভাব নেই তারা এখন বেহেস্তের হুর-পরী পাওয়ার জন্য ব্যস্ত হয়ে গেছে। মানুষ খুন করলে বেহেস্তের দরজা খুলবে না।’

শেখ হাসিনা বলেন,‘এর আগে সবাই মনে করতো মাদ্রাসার ছাত্র। এখন দেখা যাচ্ছে উচ্চবিত্ত, তাদের সব চাহিদা পুরণ হয়ে যাচ্ছে। এখন আর কিছু না পেয়ে তারা মানুষ হত্যায় নেমেছে। তারা (হামলাকারী) এখন বেহেস্তের হুর-পরী পাওয়ার জন্য পাগল হয়ে গেছে! তারা এখানে কেন আসলো? এর কোন যৌক্তিকতা খুঁজে পাচ্ছি না।’ প্রধানমন্ত্রী বলেন, মানুষ খুন করলে বেহেস্তের দরজা খুলবে না। যারা তাদেরকে এই ভুল শিক্ষা দেবে তারা ভুল করছেন’

আমি সাংবাদিকদের বলবো আপনারা একটু খুঁজে বের করুন তারা (হামলাকারী) কেন মানুষ খুন করছে।

বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্র রাজনীতি চালু করা হবে কী না? একজন সাংবাদিককের এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘ছাত্র রাজনীতি কিন্তু বাংলাদেশে নিষিদ্ধ না। আমাদের সবার শুরুটা কিন্তু ছাত্র রাজনীতি দিয়ে। আমরা স্কুল পালিয়ে চলে আসতাম। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো নিজস্ব নিয়ম নীতিমালা অনুযায়ী চলছে। সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডকে মদদ দেওয়া খুব দু:খজনক।’

গুলশানে ঘটে যাওয়া ঘটনায় বিশ্ব মিডিয়ায় বড় করে দেখানো কোন ষড়যন্ত্র কী না এমন প্রশ্নের উত্তরে শেখ হাসিনা বলেন, বাংলাদেশকে এইভাবে প্রচার করা আমাদের দেশ থেকেই বেশি হয় না? বিশ্বে যখন এই ধরণের ঘটনা ঘটছে তখন বিশ্ব নেতারা উদ্বেগ প্রকাশ করেন। আসেম সম্মেলনে যখন বসলাম তখন প্রত্যেকটি প্রোগ্রামে এজেন্ডায় যাই থাকুক না কেন সবাই ফ্রান্সের ঘটনার নিন্দা জানিয়েছেন। তারপর আসলো তুরস্কর ঘটনা।’

তিনি বলেন, ‘বিশ্ব মিডিয়াতে লাইভ দেখানো হয়। কিন্তু আমাদের দেশের মিডিয়ার মতো কোথায় লাশ পড়ে আছে, রক্ত লেগে আছে সব কিছুই দেখিয়ে দিচ্ছে।একটা ঘটনা যখন ঘটছে তখন যেসব ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে সেটাও মিডিয়ায় বলে দেওয়া হচ্ছে। যখন আমাদের মিডিয়াগুলোতে এইগুলো বেশি প্রচার করা হয় তখনই বিশ্ব মিডিয়া এইগুলো প্রচার করে। আমাদের মিডিয়া থেকে নিয়েই বিবিসি, সিএনএন প্রচার করে। দোষটা কাকে দেবো?’

প্রধানমন্ত্রী বলেন, যখনই যারা ক্ষমতায় এসেছে তখন নিজেদের আর্থ-সামাজিক উন্নতির জন্য কাজ করেছে, আর কিছুই না। এভাবে যারা ক্ষমতা দখল করে তারা নিজেদের ক্ষমতা পাকাপোক্ত করতে এতই ব্যস্ত যে দেশের জনগণের জন্য কোন কাজ করার সুযোগ তারা পায় না। একমাত্র আওয়ামী লীগ দেশের মানুষের জন্য কাজ করে।

তিনি বলেন, ‘সন্ত্রাস মোকাবেলা করে আমরা বাংলাদেশকে যে সম্মানজনক অবস্থানে নিয়ে গিয়েছিলাম গুলশানে বিদেশি হত্যার ঘটনার পর সেই জায়গাটা কিছুটা ম্লান হয়েছে। সন্ত্রাসী হামলার ঘটনা বাংলাদেশের একার সমস্যা নয়, এটা বৈশ্বিক সমস্যা। এতদিন বাংলাদেশে এটি আমরা নিয়ন্ত্রণে রাখতে পেরেছিলাম।’

হলি আর্টিজানে জঙ্গি হানার তদন্তের অগ্রগতি সম্পর্কে জানতে চাইলে কলকাতার সাংবাদিককে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘তদন্তের সব কথা বলা যাবে না। আমি যদি সব বলে ফেলি তাহলে সেটা আর তদন্ত থাকে না।’

তিনি বলেন, ‘এখানে অনেকগুলো ধাপ আছে, কাজ চলছে। ভবিষ্যতে এমন জিনিস বেরুবে যে আপনারা নিজেরাই তাজ্জব হয়ে যাবেন। সেখান থেকে যতটুকু প্রকাশ করা যায় ততটুকু প্রকাশ করা হচ্ছে। সাংবাদিকদের বলবো আপনারা খোচাখুঁচি করে বেশি কিছু বের করে ঘটনাগুলোকে অন্য দিকে নিয়ে যাবেন না।’

বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা বলেন, অত্যন্ত দু:খজনক যে ২১ জন জেএমবি সদস্যর বিরুদ্ধে মামলা হাইকোর্টে ঝুলে আছে। বার বার তাগাদা দেওয়ার পরও হচ্ছে না। এ ব্যাপারে আমরা যথাযথ পদক্ষেপ নিচ্ছি। সব জায়গায় সব ধরণের লোক আছে। আবার যদি বেছে বেছে ঐগুলো তুলে ফেলতে যাই আপনারাই আবার লিখবেন রাজনৈতিক প্রতিহিংসা শুরু হয়েছে। তারপরও আমরা এ ব্যাপারে যথাযথ পদক্ষেপ নিচ্ছি।

শেখ হাসিনা বলেন, আমরা যখন আসেম সম্মেলনে তখনই ফ্রান্সে হামলার ঘটনার খবর আসে। আমি তখনও নিন্দা জানিয়েছি, এখনও নিন্দা জানাচ্ছি। এরপরই তুরস্কের সেনা অভ্যূত্থানের খবর আসে। আমরা সব সময় অসাংবিধানিকভাবে ক্ষমতা দখলের বিরুদ্ধে।

তিনি বলেন, আসেম সম্মেলনে আমি আমার বক্তব্যে সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্সের কথা তুলে ধরি। পাশাপাশি জঙ্গিবাদের মদদদাতা, অর্থদাতা, অস্ত্রদাতাদের খুঁজে বের করতে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করি।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, আসেম সম্মেলনে যোগ দেওয়ার পাশাপাশি আমি বাংলাদেশের গুলশানে ঘটে যাওয়া ঘটনা সম্পর্কে জাপানের প্রধানমন্ত্রী, ইতালির পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও ভারতের উপ-রাষ্ট্রপতিকে সরকারের চলমান তদন্ত সম্পর্কে জানাই।

গুলশান ও শোলাকিয়ার ঘটনায় দেশবাসীর মনে আতঙ্ক সৃষ্টি হয়েছে তা দূর করতে সরকার কি পদক্ষেপ নিয়েছে এমন প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এ এধরনের ঘটনা ঘটলেতো মানুষের মনে আতঙ্ক সৃষ্টি হতে পারে এটাই স্বভাবিক। কিন্তু জীবন চলমান, তা থেমে থাকে না। আমি মোঙ্গলিয়ায় থাকাকালীন সময়ে একটা খবর পেলাম, একটি চিঠি এসেছে যাতে বলা হয়েছে শপিং মলে হামলা হবে’। এর পরেই আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী নিরাপত্তামূলক পদক্ষেপ নিয়েছে। পাশাপাশি যার যার নিজস্ব একটি নিরাপত্তা বলয় সৃষ্টি এবং সতর্ক থাকা উচিত। সরকার জনমনে আতঙ্ক দূর করার জন্য যা যা করা দরকার তা তা করছে। এতে কোন গাফলতি নেই।

জনগণের উদ্দেশ্যে প্রধানমন্ত্রী বলেন, সবাইকে আত্মবিশ্বাস নিয়ে চলতে হবে এবং মানুষকে সচেতন হতে হবে। তাঁরা যদি সচেতন হয় এবং স্বতঃস্ফূর্তভাবে এদের প্রতিরোধে এগিয়ে আসে তাহলে অনেক কিছুই অর্জন করা সম্ভব।

তিনি বলেন, দেশব্যাপী এ বিষয়ে কাজ শুরু হয়েছে। অনেক জায়গায় সন্ত্রাস জঙ্গিবাদ প্রতিরোধ কমিটিও হচ্ছে। অনেক জায়গায় নিজেরাই পাহারা দিচ্ছে। আপনারা (সাংবাদিক) জানেন এবারের ঈদের জামাতের নিরাপত্তার জন্য হিন্দু, খ্রিস্টান ও বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের ছেলেরা স্বেচ্ছাসেবক ছিল। আমরা যে অসাম্প্রদায়িক চেতনায় বিশ্বাস করি এটি তার প্রমাণ।

শেখ হাসিনা বলেন, আমরা ভালোভাবেই বিশ্বাস করি সব শিক্ষক ও ছাত্র সন্ত্রাস জঙ্গিবাদে জড়িত নয়। তাই দোষিদের জন্য অন্যের শিক্ষাজীবন নষ্ট হোক তা আমরা চাই না। তবে সমস্ত বিশ্ববিদ্যালয়, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি ও কর্মকর্তাদের সাথে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, শিক্ষামন্ত্রী বৈঠক করছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে যেন শিক্ষার পরিবেশ থাকে তা নিয়ে সবাই কাজ করছে।