রবিবার, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ৮ পৌষ ১৪৩১

বড়মিয়া মসজিদ সম্প্রসারণের নামে ভরাট করা হচ্ছে শতবর্ষী পুকুর

প্রকাশিতঃ ১৯ মার্চ ২০১৮ | ১:১১ অপরাহ্ন

আবু আজাদ : নগরীর চকবাজার কেবি আমান আলী রোডের বড়মিয়া মসজিদ সম্প্রসারণের নামে ভরাট করা হচ্ছে শতবর্ষী পুকুর। আর এই কাজ করছেন মসজিদ পরিচালনা পরিষদের নামে পুকুরে মালিকানা আছে এমন স্থানীয় ব্যক্তিরা।

চকবাজার বড় মিয়া মসজিদ-লাগোয়া বলে প্রায় ১০০ গজ আয়তনের মসজিদটি বড়মিয়া মসজিদ পুকুর হিসেবেই পরিচিত। মসজিদের মুসল্লিরা অজু ও গোসলের প্রয়োজন সারেন এই পুকুরে। এ ছাড়া স্থানীয়দের অনেকেই গোসলসহ নানা কাজে এই পুকুর ব্যবহার করে থাকেন। মসজিদ সম্প্রসারণের নামে ইতিমধ্যে পুকুরের ৩০ ভাগ বালি ফেলে ভরাট করে ফেলা হয়েছে। জড়িতরা মসজিদ সম্প্রসারণের অজুহাত দেখালেও স্থানীয় অনেকেই অভিযোগ করেছেন, এই জায়গা শেষ পর্যন্ত বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যেই ব্যবহার করা হবে।

সোমবার (১৯ মার্চ) সকালে সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, প্রকাশ্যেই ভরাট করা হচ্ছে পুকুর। পুকুরে শ্রমিকদের মাটি ফেলার দৃশ্য দেখলে মনে হয় না, কোনো লুকোচুরি আছে। সাধারণ মানুষ দেখছেন প্রতিনিয়ত ভরাটের এই দৃশ্য। কিন্তু চোখে পড়ছে না পরিবেশ অধিদপ্তরসহ সংশ্লিষ্ট সংস্থার কর্তাব্যক্তিদের কারো।

এ প্রশ্ন তুলেছেন স্থানীয়রাই। বর্তমানে ঐতিহ্যবাহী বড়মিয়া মসজিদ পুকুরের অর্ধেকটা ভরাট করে ফেলা হয়েছে। মসজিদের উন্নয়নের জন্য এ পুকুর ভরাটের কথা বলা হলেও বাস্তবে এটি মসজিদের নামে মার্কেট গড়ে তোলার প্রক্রিয়ার অংশ বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা। তারা বলছেন, পুকুরটি ভরাট করায় মুছে যাবে অনেক স্মৃতিচিহ্ন।

স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বর্তমান মসজিদ কমিটির সভাপতি সেক্রেটারিসহ অনেকে পুকুরটির অংশীদারি মালিক। যেহেতু পুকুর ভরাট নিষিদ্ধ তাই মসজিদের নামে পুকুরটি ভরাট করে পরবর্তীতে তা প্লট আকারে বিক্রি বা মার্কেট তৈরী করা হবে। অংশীদারি মালিকানার পুকুর হওয়ায় প্রায় অর্ধশত মালিক রয়েছে এই পুকুরের।

১৯৯১ সালের জেলা মৎস্য বিভাগের জরিপ অনুযায়ী চট্টগ্রামে জলাশয়ের সংখ্যা ছিল ১৯ হাজার ২৫০টি। ২০০৬-০৭ সালের চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের জরিপে পাওয়া যায় মাত্র চার হাজার ৫২৩টি জলাশয়। বর্তমানে কী পরিমাণ জলাশয় আছে তার সঠিক তথ্য কারো কাছেই নেই। তবে পরিবেশ বিশেষজ্ঞদের মতে প্রায় ১৫ হাজার জলাধার ভরাট কিংবা দখল করে বহুতল ভবন নির্মাণ করা হয়েছে।

নগর পরকিল্পনাবদিরা বলছেন, এ বিষয়ে সচতেনতা বৃদ্ধিও কার্যক্রম জোরদার করা প্রয়োজন। এ কাজটি সরকারি এবং বেসরকারি সংস্থার মাধ্যমে করা যেতে পারে। ৬০ লক্ষ জনসাধারণরে নগরীতে কী পরমিাণ পুকুর জলাশয় দরকার তা যথাযথ জরিপ ও গবেষণার মাধ্যমে নির্ধারণ করা জরুরী।

কৌশলে ভরাট হচ্ছে বড় মিয়া মসজিদ পুকুর :
চকবাজার কে বি আমান আলী রোডের বড়মিয়া মসজিদ শত বছরের পুরনো একটি মসজিদ। সেই মসজিদের সাথে লাগোয়া রয়েছে অংশীদারি মালিকানার প্রায় ১০০ গজ আয়তনের পুকুর যা বড় মিয়া মসজিদ পুকুর হিসেবেই পরিচিত। সম্প্রতি বছরখানেক ধরে পুকুরের পূর্বপাশে ময়লা আবর্জনা ফেলে ভরাট শুরু হয়। আবর্জনা ফেলে পুকুরের পানি নষ্ট হয়ে যাওয়ার পর, রাতের ট্রাকভর্তি বালু ফেলে পুকুরটির উত্তর-পূর্ব পাড়ে ভরাটের কাজ চলছে। বলা হচ্ছে বড় মিয়া মসজিদ সম্প্রসারণের জন্য চলছে এই ভরাট কাজ।

স্থানীয় বাসিন্দা জামসেদ একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘আমরা ছোট বেলা থেকে এই পুকুরে গোসল করি। গত কয়েক বছরে পুকুরের চারদিক থেকেই বিভিন্ন ময়লা-আবর্জনা ফেলে পুকুরেরর পরিবেশ নষ্ট করে ফেলা হয়েছে। এতে এটি কি পুকুর না কোনো বিল তা আলাদা করা যাচ্ছে না।’

চট্টগ্রাম জলাশয়-জলাধার রক্ষা কমিটির সভাপতি ও বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা), চট্টগ্রামের সহ সভাপতি অ্যাডভোকেট রেহেনা বেগম রানু একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘ নগরীর বেশিরভাগ পুকুর-জলাশয় ভরাট করে ফেলা হচ্ছে। অপরিকল্পিতভাবে পুকুর জলাশয় ভরাটের কারণে পরিবেশ ভারসাম্য হুমকির মুখে পড়ছে। গত দুই-তিন দশকে নগরীতে কী পরিমাণ পুকুর জলাশয় বিলীন হয়েছে তা শীঘ্রই অনুসন্ধান করে দেখা উচিত। মহানগরীতে জনগণের বহুমুখী নিরাপত্তার জন্য কী পরিমাণ জলাশয় থাকা দরকার তা নিশ্চিত করে জানানোর দায়িত্ব চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ ও সিটি কর্পোরেশনের।’

তিনি বলেন, ‘মানুষের জীবনধারনে পুকুরের প্রয়োজনীয়তা অপার। খেলার মাঠ যেমন প্রযোজণ তেমনি পুকুরের প্রয়োজন রয়েছে। জলাধার হচ্ছে লক্ষ জীবনের আধার। শিশুরা এখানে সাঁতার কেটে জীবন শুরু করবে। অগ্নিকান্ডে মানুষ পুকুরের সাহায্য নেবে।’

‘জলাধারে যেকোনো ধরনের স্থাপনা নির্মাণে চট্টগ্রাম উন্নয়ন র্কতৃপক্ষ অনুমতি দেবে না। প্রয়োজনে মসজিদটি বহুতল করা হোক। কিন্তু কোনো ভাবেই পুকুর ভরাট করা যাবেনা। পুকুরের জীবন নেওয়ার অধিকার কারো নেই। সেই জীবন ফিরিয়ে দিতে হবে। যারা ভরাট করেছে তাদেরকেই দিতে হবে। যতটুকু ভরাট হয়েছে তাও ভরাট কারীদের নিজের খরচে তা উদ্ধার করে দিতে হবে। অন্যথায় আইনের সাহায্য নিতে আমরা বাধ্য হব। বলেন চট্টগ্রাম উন্নয়ন র্কতৃপক্ষ নগর উন্নয়ন কমিটির সদস্য ও সাবেক সিটি করপোরেশন কাউন্সিলর রেহানা বেগম রানু।

পরিবেশ অধিদপ্তরের চট্টগ্রাম অঞ্চলের পরিচালক আজাদুর রহমান মল্লিক একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘যারা নগরীতে পুকুর-জলাশয় ভরাট করছে তারা এর ক্ষতিকর দিকটি জেনে শুনেই তা করছে। এর সাথে তাদের ব্যক্তিগত স্বার্থ জড়িত। যাদেরই মালিকানাধীন হোক না কেন, পরিবেশ অধিদপ্তরের অনুমতি ছাড়া পুকুর ভরাট করা যাবে না। বিষয়টি আমার জানা ছিলোনা। আমি এখনি ফোর্স পাঠাচ্ছি।’

এদিকে ঘটনাস্থলে গিয়ে মসজিদ কমিটির কাউকে পাওয়া যায়নি। আশপাশের কেউ এ নিয়ে কথা বলতে রাজি নয়।
পরে মসজিদের ইমামের কাছ থেকে মুঠোফোন নম্বারে মসজিদ কমিটির সভাপাতি মারুফের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করে তাকে পাওয়া যায়নি।

সিডিএ’র ডিটেইলড এরিয়া প্ল্যানে দশমিক ৫ একরের নিচের পুকুরের ব্যবহারের ক্ষেত্রে সিডিএ’র অনুমোদন নিতে হবে। কিন্তু এক্ষেত্রে এর কোনো অনুমোদন নেয়া হয়নি জানিয়েছেন সিডিএ’র ভারপ্রাপ্ত প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ স্থপতি শাহীনুল ইসলাম খান।

একুশে/ এএ