জনরোষ থেকে শিশু ছিনতাইকারীকে বাঁচালেন একুশে সম্পাদক

আবু আজাদ : নগরীর জামালখান আইডিয়াল স্কুলের গেইট থেকে এক নারীর হাতব্যাগ ছিনতাই করে পালানোর সময় ধরাপড়া এক শিশু ছিনতাইকরীকে ক্ষিপ্র জনতার রোষানল থেকে বাঁচালেন একুশে পত্রিকা সম্পাদক আজাদ তালুকদার। উত্তেজিত জনতার হাতে থাকলে হয়তো সিলেটের ‘রাজন’র’ পরিণতিই বরণ করতে হতো ওই শিশু ছিনতাইকারীর।

প্রত্যক্ষদর্শী সূত্র জানায়, হাতব্যাগ ছিনতাই করে পালানোর সময় নগরীর গণিবেকারী এলাকায় শিশু আকাশকে (১০) ধরে ফেলে উত্তেজিত জনতা। পুলিশ পৌঁছার আগে ক্ষিপ্ত জনতা শিশুটিকে ঘিরে ফেলে। এসময় তারা শিশুটিকে যেখানে খুশি আঘাত করছিলো। উত্তপ্ত ওই পরিস্থিতির মধ্যে মাথা ঠাণ্ডা রেখে কাজ করতে দেখা গেছে চট্টগ্রামের এই সাংবাদিককে। পুলিশ না আসা পর্যন্ত উত্তেজিত জনতার হাত থেকে শিশুটিকে সুরক্ষা দিয়েছেন আজাদ তালুকদার।

এরইমধ্যে এই সাহসী ও মানবিক পদক্ষেপের জন্য একুশে পত্রিকা সম্পাদককে ধন্যবাদ জানিয়েছেন সাংবাদিক, পুলিশসহ সমাজের সচেতন মহল। তারা বলছেন, আজাদ তালুকদারের সাহস ও নির্ভীকতার কারণে তাৎক্ষণিকভাবে পরিস্থিতি শান্ত করা সম্ভব হয়েছে, কিশোর রাজনের মত আরেকটি মর্মান্তিক ঘটনা ঠেকানো গেছে।

কোতোয়ালী থানার এসআই আবদুর রহিম একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘ঘটনার পরপরই জনগণ ওই শিশুটির ওপর চড়াও হয়। আরেকটু হলে সে হয়তো মারা যেত, কারণ সবাই তাকে কিল-ঘুষি দিচ্ছিল। তখনই আজাদ তালুকদার ভাই এসে শিশুটিকে উদ্ধার করেন। পুলিশ আসার আগ পর্যন্ত তাকে তিনি নিজের জিম্মায় রাখেন।’ পরে তার ফোন পেয়ে পুলিশ এসে ওই শিশুটিকে থানায় নিয়ে আসে।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে নিজের স্ট্যাটাসে একুশে পত্রিকা সম্পাদক আজাদ তালুকদার লেখেন, ‘ সোমবার সকাল ১১টা। পায়ে হেঁটে অতিক্রম করছিলাম গণিবেকারি এলাকা। গুডস হিলের সামনে পৌছতেই চোখ আটকে গেলো এক কিশোরকে ঘিরে মানুষের জটলায়। কাছে যেতেই স্পষ্ট হলো ব্যাপারটি; কিশোর ছিনতাইকারী হাতেনাতে ধরা পড়েছে। তাই আর রক্ষা নেই। গণপিটুনিতেই প্রাণ যাবে! যাওয়া উচিত- একশ্রেণীর মানুষের এমন পৈশাচিক মনেবৃত্তি থেকে মুক্ত নয় এই কিশোর ছিনতাইকারীও; শুরু হয়ে গেছে তার উপর বর্বর নির্যাতন, নারকীয় উল্লাস। উপস্থিত অনেকে শিশুটিকে মেরে-কেটে ভর্তা বানানোর পক্ষে। কিন্তু নাইন-টেন পড়–য়া স্কুল ড্রেস পরা কিছু ছাত্রের মুখ মলিন, বিষণ্ন। তারা চাইছে না ছেলেটিকে এভাবে মারা হোক। সাহস করে কিছু বলতেও পারছে না তারা।’

‘আমার মনে পড়ে গেলো সিলেটের কিশোর রাজনের কথা; যাকে চুরির দায়ে নির্মমভাবে পিটিয়ে হত্যা করেছিল নরপশুরা। কয়েকদিন আগে ঘটে যাওয়া নওগাঁর আকবরপুর ইউনিয়নের ঘটনাটি আরও করুণ। দ্ইু লোক মিলে এক কিশোরের পা দুটি বেঁধেছে মোটা বাঁশের কঞ্চির সঙ্গে। বাঁশের দুই দিক কাঁধে নিয়েছে লোক দুটি। মাঝখানে ঝুলছে কিশোরের নিম্মগামী দেহ। রশি দিয়ে ঝুলানো পা দুটি উপরে, আর মাথা ঝুলছে নিচের দিকে। আরেক যুবক সর্বশক্তি প্রয়োগে লাঠি দিয়ে ক্ষতবিক্ষত করছে কিশোরের পা দুটি। অপরাধ কিশোরটি পকেট কেটেছে।’

আমি স্পষ্টত: এই দুটি অমানবিক দৃশ্যের প্রতিচ্ছবি দেখতে পাচ্ছি এই কিশোরের বেলায়। এখনই এগিয়ে না গেলে এই কিশোরেরও সেই পরিণতি হবে। তাই আর এক মুহূর্ত বিলম্ব না করে গর্জে উঠি, বলি “কেউ আইন হাতে তুলে নিবেন না। ছিনতাইকারীর শাস্তি আছে, বিচার আছে। কেউ তার গায়ে আর একটি আঁচড়ও দিবেন না” বলেই কোতোয়ালী থানার ওসি জসিম উদ্দিনকে ফোন দিলাম।

তিনি আরো লিখেন, ‘মিনিট ১০ পর পুলিশের টহল টিম এসে হাজির। … ছেলেটাকে নিরাপদে পুলিশের গাড়িতে তুলে দিলাম। ১৭শ ৭৫ টাকাভর্তি একটি ভেনিটি ব্যাগ বুঝিয়ে দিলাম তাদের। এখন সাক্ষী হবার জন্য কাউকে পাওয়া যাচ্ছে না। শেষপর্যন্ত নিজেই সাক্ষী হলাম, পুলিশের খাতায় নাম-ঠিকানা লিখে দিলাম। দেড় ঘণ্টার ঝক্কিঝামেলা, হাসফাস শেষে পুলিশের হাতে তুলে দিতে পেরে স্বস্তি পেয়েছি এটুকুই-আইনগতভাবে যা হবার হোক, প্রয়োজনে জেলে যাক। জনতার রুদ্ররোষ থেকে তো এ যাত্রায় বেঁচে গেলো ছেলেটি। এই মানবিক কাজটি করতে পারার আনন্দ পৃথিবীর অনেক আনন্দের চেয়ে সেরা আনন্দ, সেরা অনুভূতি। শ্রেষ্ঠ এই অনুভূতিটুকু আজ আমার সারাদিনের অর্জন, দিনভর ভালো থাকা।’

এদিকে খোঁজ নিয়ে জানা গেলো, ছিনতাইয়ের দায়ে জেলে যেতে হয়নি শিশু আকাশকে। সোমবার বিকেলে কোতোয়ালী থানা ও সমাজসেবা অধিদপ্তরের মধ্যস্থতায় তার মায়ের কাছেই ফিরিয়ে দেয়া হয়েছে তাকে।

কোতোয়ালী থানার নারী ও শিশু সেলের দায়িত্বে থাকা এসআই শম্পা হাজারী একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘আমারা ঘটনাটি চট্টগ্রামের সমাজসেবা অধিদপ্তরকে জানিয়েছিলাম। গতকাল বিকেলে ওই শিশুর মা-বাবা, স্বজনদের থানায় ডেকে আনা হয়। পরে তাকে স্কুলে ভর্তি করে দেওয়ার শর্তে পরিবারের কাছে শিশু আকাশকে ফিরিয়ে দেয়া হয়।’

এদিকে, জনতার হাতে আটকের পর শিশুটি একুশে পত্রিকার সম্পাদককে জানায়, তার নাম আকাশ। তার বাবা নেই, মা আছে। মাস্টারপুল বউবাজার এলাকায় অসুখে কাতরাচ্ছে তার মা রিজিয়া বেগম। মা’র চিকিৎসার জন্য অনেক টাকা দরকার। সেই টাকার সংস্থান করতেই ছিনতাই করতে নেমেছিল সে। সোমবার সকাল থেকে জামালখান আইডিয়াল স্কুলে ওঁৎ পেতেছিল। সুযোগ পেয়ে এক মহিলার ভ্যানিটি ব্যাগ ছোঁ মেরে দৌড় দেয়। ব্যাগ উচিয়ে দৌড়ে পালাতে গিয়ে অবশেষে ধরা পড়ে গুডস হিলের সামনে অন্য পথচারীদের হাতে।

এদিকে অনুসন্ধানে জানা গেছে, আকাশ তার মা রিজিয়া বেগমের সঙ্গে নগরের বাকলিয়া মাস্টারপুল বউবাজার বস্তিতে থাকে। তার আরো চার বোন রয়েছে, যারা এক সঙ্গেই থাকে। রিজিয়া বেগম পলিথিন কুড়ান। বেশ কিছুদিন ধরে তিনি অসুস্থ। আকাশের বাবা আনু মিয়া আবারো বিয়ে করেছেন। তিনি ওই স্ত্রীর সঙ্গে থাকেন। আকাশদের ভরণ-পোষণ করেন না।

সাংবাদিক শরীফুল রোকন বলেন, ‘আজাদ ভাইয়ের কাছ থেকে খবর পেয়েই কোতোয়ালী জোনের সিনিয়র সহকারী পুলিশ কমিশনার জাহাঙ্গির আলমকে ঘটনাটি জানাই। ঘটনার দশ মিনিটের মধ্যেই তিনি ফোর্স পাঠান।’

এদিকে এ মানবিক ও সাহসী পদক্ষেপকে স্বাগত জানিয়ে ফেসবুক ব্যবহারকারিদের প্রসংসায় ভাসছে আজাদ তালুকদারের ওয়াল। চীনের হুয়ান টিভি সিক্স’র নিউজ প্রেজেন্টার করিম ফয়সাল লিখেছেন, ‘ That’s really a great work vai..hats off’।

দীপংকর দে নামে আরো এক ফেসবুক ব্যবহারকারি লিখেছেন, “ধন্যবাদ ভাই। মনটা ভালোলাগায় ভরে গেল। প্রচলিত কিশোর আইনে তার বিচার হোক, কিন্তু বিকারগ্রস্থ কিছু মানুষের পিটুনিতে আর একটা কিশোরের মৃত্যু সভ্য সমাজে মেনে নেয়া যায়না। আপনাকে দিয়ে শুরু, অন্যরাও এগিয়ে আসবে। ভাল থাকবেন।”

মো. শাহিদুর রহমান নামে একজন লিখেছেন, “মানবিক চিন্তা চেতনাসহ এই অবদানের জন্য সংগতভাবেই আপনাকে ধন্যবাদ। এই কিশোর তো আপনার উসিলায় নারকীয় হত্যাযজ্ঞ থেকে ভাগ্যক্রমে বেঁচে গেল। এই লতা চোর পাতা চোরদেরই তো এমন হয়। কিন্তু দেশ বিধ্বংসী ব্যাংক চোর ভূমি চোর, সনদ চোররা আছে রাজকীয় হালে!! এই কিশোরের বাবাও নেই। কিন্তু ওদের বাপ দাদা চাচা মামা আংকেল বিগ ব্রাদারসহ আছে বিগ গড ফাদার।”

হাবিব রেজা নামের একজন লিখেছেন, আজাদ ভাই, আপনাকে কাছ থেকে যতটুকু দেখেছি এর আরও অনেক উর্দ্বে আপনি। শুভকামনা রইলো।

রাউজানে পৌরসভার মেয়র দেবাশীষ পালিত লিখেন, ‘‘খুবই ভালো করেছেন, ভাই’’।

ইবনে জালাল লিখেন, মুল্যবোধ জাগ্রত হোক সবার ই, আজাদ তালুকদার এগিয়ে যাক ।

একুশে/এএ