চট্টগ্রাম : চট্টগ্রামের বোয়ালখালী থানার ওসি হিমাংসু কুমার দাস রানার সাথে ছবি তুলে ফেইসবুকে দিয়েছেন সিআরবিতে জোড়া খুন মামলার প্রধান আসামি অজিত বিশ্বাস; অথচ ‘কিলার অজিত’ নামে পরিচিত এই যুবলীগকর্মী পুলিশের কাছে পলাতক।
২০১৩ সালের ২৪ জুন চট্টগ্রামের সিআরবিতে রেলওয়ের দরপত্র নিয়ে ছাত্রলীগ ও যুবলীগের মধ্যে গোলাগুলির সময় অজিতের গুলিতেই দুজনের মৃত্যু হয়েছিল বলে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) তদন্তে উঠে এসেছে।
ওসির সঙ্গে তোলা ছবিটি ২০১৭ সালের ২ নভেম্বর নিজের ফেইসবুক ওয়ালে আপলোড করেন অজিত বিশ্বাস। ছবিটি দেখে স্পষ্ট, সেটি বোয়ালখালী থানার ওসির কক্ষে তোলা।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বোয়ালখালী থানার ওসি হিমাংসু কুমার দাস রানা একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘কোন্ অজিত, আমি এই নামের কাউকে চিনি না। তাছাড়া প্রতিদিন কত লোকই তো আসে। ফুল দেয়, সেলফি তোলে। সবাইকে কি আর চেনা বা মনে রাখা যায়?’
কিন্তু জোড়া খুন মামলার আসামী, সন্ত্রাসী অজিত বিশ্বাসের সঙ্গে আপনার যে ছবি তা সেলফি কিংবা অচেনা কারো ছবি বলে মনে হয় না। ছবিটি বরং ইঙ্গিত করছে আপনাদের মাঝে বেশ অন্তরঙ্গতা- একুশে পত্রিকার এমন প্রশ্ন এড়িয়ে যান ওসি হিমাংসু কুমার দাশ।’
এ ব্যাপারে কথা বলার জন্য শনিবার সকালে একুশে পত্রিকার পক্ষ থেকে প্রথমেই ফোন করা হয় চট্টগ্রাম রেঞ্জের ডিআইজি এসএম মনির উজ জামান পিপিএমকে। কিন্তু তিনি ফোন ধরেন না। এবার চট্টগ্রামের পুলিশ সুপার নূরেআলম মিনার কাছে ফোন করা হয়।
বিষয়টি শুনে পুলিশ সুপার বিচলিত হন, বলেন তাই নাকি। আপনি দয়া করে আমার ভাইভার বা ওয়াটসআপে ছবিটা পাঠান। বাকি দায়িত্ব আমার। এটুকু নিশ্চিত থাকেন সে (ওসি বোয়ালখালী) উপযুক্ত শাস্তি পাবেই।
প্রসঙ্গত, ১৯৯৮ সালে রিয়াজউদ্দিন বাজারের ব্যবসায়ী মাবুদ হত্যা মামলায় যাবজ্জীবন জেল খেটে ২০১১ সালে জামিনে মুক্তি পান বোয়ালখালীর কানুনগোপাড়া এলাকার বাসিন্দা অজিত। যুবলীগের কেন্দ্রীয় নেতা হেলাল আকবর চৌধুরী বাবরের অনুসারী হিসেবে রেলে টেন্ডার নিয়ন্ত্রণ করে ফোর স্টার গ্রুপ। অজিত বিশ্বাস এই গ্রুপের সক্রিয় সদস্য।
এদিকে আদালতের নির্দেশে প্রায় ১৫ মাস তদন্ত শেষে জোড়া খুনের মামলায় বৃহস্পতিবার (২২ ফেব্রুয়ারি) অভিযোগপত্র জমা দেন তদন্তকারী কর্মকর্তা পিবিআই চট্টগ্রামের পরিদর্শক মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর।
অভিযোগপত্রে তিনি উল্লেখ করেছেন, আগের বিভিন্ন দরপত্রের ভাগের টাকা পাওনা থাকায় সাজু পালিত ও অজিত বিশ্বাসের মধ্যে বিরোধ চলছিল। ঘটনার দিন সিআরবি সাত রাস্তার মাথায় একটি টং দোকানে পুরি খাচ্ছিল সাজু। পাওনা টাকার জন্য সেখানে উপস্থিত অজিত বিশ্বাসকে গালাগালি করে সাজু। এসময় অজিত কোমরে থাকা অবৈধ পিস্তল বের করে সাজুর মাথায় পিস্তল ঠেকিয়ে গুলি করে। তখন লিমনের অনুসারীরা এগিয়ে এলে অজিত এলোপাতাড়ি গুলি চালায়, এতে নিহত হয় শিশু আরমান।
সিআরবি’তে যুবলীগকর্মী সাজু পালিত ও আট বছর বয়সী স্থানীয় শিশু আরমান হোসেন টুটুলের খুনি হিসেবে চিহ্নিত অজিত বিশ্বাস কখনো এই মামলায় কারাগারে যাননি। অথচ জোড়া খুনের এই মামলায় যুবলীগ নেতা হেলাল আকবর চৌধুরী বাবর ও সাইফুল আলম লিমনসহ অন্তত ৫৭ জনকে গ্রেফতার হতে হয়েছিল।
আদালত সূত্র জানায়, ঘটনার পর উচ্চ আদালত থেকে জামিন নেন অজিত বিশ্বাস। পরে মামলার ধার্য্য দিনে আদালতে হাজির না হওয়ায় এক বছর আগে নিম্ন আদালত তার জামিন বাতিল করে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করে।
আদালতের আদেশের পরও অজিতকে গ্রেফতারে পুলিশের তৎপরতা নেই। প্রকাশ্যে তিনি ঘুরে বেড়াচ্ছেন। সিআরবি ও বোয়ালখালী এলাকায় নানা অনুষ্ঠানে অতিথি হন। জেলা প্রশাসকের কার্যালয়, পুলিশ সুপারের কার্যালয় ও থানা- সবখানেই তার সরব উপস্থিতি দেখা যায়।
অজিত গ্রেফতার না হওয়ার কারণ হিসাবে একাধিক পুলিশ কর্মকর্তা একুশে পত্রিকাকে ‘রাজনৈতিক চাপের’ কথা বলেছেন। তবে তারা কেউ নাম প্রকাশ করতে চাননি।
সর্বশেষ পিবিআইয়ের দেয়া অভিযোগপত্রে অজিতকে প্রধান আসামি করা হলেও জোড়া খুনের ঘটনার পরপরই কোতোয়ালি থানার এসআই মহিবুর রহমান বাদী হয়ে ৮৭ জনের বিরুদ্ধে যে মামলা করেছিলেন তাতে ৭৮ নম্বরে ছিল অজিতের নাম।
ঘটনার এক মাস পর যুবলীগকর্মী সাজু পালিতের মা মিনতি পালিত বাদী হয়ে অজিতকে প্রধান আসামি করে চারজনের বিরুদ্ধে আদালতে হত্যা মামলা করেন। তখন জোড়া খুনের বিষয়ে পুলিশ ও সাজু পালিতের মায়ের করা মামলা একসঙ্গে তদন্ত করে অভিযোগপত্র দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন আদালত।
এদিকে অভিযোগ আছে, বোয়ালখালী উপজেলা দুর্গাপূজা উদযাপন পরিষদের সভাপতি পদটি ২০১৫ সালে জোরপূর্বক বাগিয়ে নেন অজিত বিশ্বাস। এ নিয়ে সাধারণ পূজার্থীদের মধ্যে ক্ষোভ আছে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, ২০১৫ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর উপজেলা সদরে পূজা উদযাপন পরিষদের কমিটি গঠন নিয়ে এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। এতে সভাপতি প্রার্থী ছিলেন অজিত বিশ্বাস, মিন্টু সিকদার ও সাধারণ সম্পাদক প্রার্থী ছিলেন সাজিব বৈদ্য, লিটন শীল, বিশ্বজিৎ চৌধুরী। প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীরা সদলবলে সম্মেলনে যোগ দিলে উত্তেজনা বিরাজ করে। এতে সম্মেলনস্থলে কমিটি ঘোষণা না করে ফিরে আসেন জেলার নেতৃবৃন্দ। সম্মেলনের দুইদিন পর জেলা পূজা উদযাপন পরিষদ অজিত বিশ্বাসকে সভাপতি ও লিটন শীলকে সাধারণ সম্পাদক করে বোয়ালখালী পূজা উদযাপন পরিষদের কমিটি ঘোষণা করেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে বোয়ালখালী উপজেলার বাসিন্দা সনাতন সম্প্রদায়ের একজন নেতা একুশে পত্রিকাকে বলেন, অতীতে কখনো বোয়ালখালী পূজা পরিষদের সঙ্গে অজিত বিশ্বাস জড়িত ছিলেন না। পূজা কমিটি গঠনের আগে হঠাৎ করে তৎপর হয়ে উঠেন। একজন সন্ত্রাসী পূজা কমিটির সভাপতি হওয়ায় কমিটির অতীতের সুনাম ম্লান হয়েছে।
একুশে/শরু/এটি