চট্টগ্রাম : এখলাস মিয়া। বয়স পঁচাত্তর ছুঁই ছুঁই। এই বয়সেও থামছে না তার ‘বিয়েযুদ্ধ’। করছেন একের পর এক বিয়ে।
প্রথম স্ত্রী জীবিত থাকাকালে বিয়ে করেছেন তিনটা। প্রথম স্ত্রী মারা যান তিনবছর আগে। এসময়ের মধ্যে বিয়ে করলেন আরও চারটা। প্রথম স্ত্রী ছাড়া আর কোনো স্ত্রীর সঙ্গেই ৫-৬ মাসের বেশি ঘর করা হয়নি তার। একটা ছাড়েন, আরেকটা করেন।
এই ‘বিয়েযুদ্ধ’ ঠেকাতে ক্ষুব্ধ, বিব্রত সন্তানেরা জোটবদ্ধ হয়ে বাবা এখলাস মিয়াকে এক স্ত্রীসহ বাড়ির একটা কক্ষে তালাবদ্ধ করে রেখেছেন ১৫ দিন ধরে।
ঘটনাটি ঘটেছে চট্টগ্রামের পটিয়া উপজেলার জঙ্গলখাইন ইউনিয়নের সাহাবুদ্দিন মার্কেট এলাকায়। সস্ত্রীক গৃহবন্দী এখলাস মিয়া রোববার তার এক ঘনিষ্ঠজনের সহযোগিতায় টেলিফোনে একুশে পত্রিকার সঙ্গে যোগাযোগ করে এই বন্দীত্ব থেকে মুক্তি চেয়েছেন।
বলেন, ”আমার ৫ ছেলে ১ মেয়ে। সবাইকে বিয়ে করিয়েছি। দুই ছেলেকে বিদেশ পাঠিয়েছি। এক ছেলে শহরের ডিসি রোড কালাম কলোনীতে বাড়ি করেছে। আরেক ছেলেকে পটিয়া থানার মোড়ে লাইব্রেরি করে দিয়েছি। ছোট ছেলে গ্রামে মুদির দোকান ও মুরগীর ফার্ম করে। অনেক কষ্ট করে সন্তানদের বড় করেছি। কিন্তু সেই সন্তানেরা আমার খোঁজ রাখে না। বরং তারাই এখন আমার সুখের পথে কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
আখলাস মিয়া বলেন, জীবনে অনেক কষ্ট করেছি। শুরুতে রিক্সা চালিয়েছি, এরপর রিক্সা ভাড়া দিয়েছি। গরু-ছাগল পালন করেছি। আমার মা-বাবার দোয়া আছে বলে আল্লাহ আমার দিকে ফিরে তাকিয়েছেন। আমি জমির মালিক হয়েছি। দোকানঘর করে ভাড়া দিয়েছি। ৫ ছেলের জন্য গ্রামে পাকা বাড়ি নির্মাণ করেছি।
মসজিদের জন্য জমি দান করেছি। দোকানভাড়ার ৮ হাজার টাকা দিয়ে আমি আমা সংসার নিয়ে চলি। কিন্তু ছেলেদের জন্য আমি আজ শান্তিতে থাকতে পারছি না। তারা আমাকে সহ্যই করতে পারে না। বিদেশে থাকা দুই ছেলের সঙ্গে কথাবলা বন্ধ অনেকদিন থেকে। বলেন আখলাস মিয়া।
ছেলেরা কেন এমন করছে, কী চাইছে তারা- জানতে চাইলে এখলাস মিয়া বলেন, পাঁচ বছর আগে তাদের মা মারা যাওয়ার পর ২০১৬ সালের শুরুর দিকে আনোয়ারার কইখাইন থেকে স্বামী পরিত্যক্ত, আধবয়সী এক নারীকে আমি বিয়ে করি। ঠিকমতো নামাজ-কালাম পড়ে না, তদুপরি অবাধ্য আচরণ করায় ৫-৬ মাস পর কাবিনের টাকা-পয়সা দিয়ে তাকে বিদায় করে দিয়েছিলাম। কিছুদিন আগে ওই মহিলা আমার সঙ্গে যোগাযোগ করে অনুতপ্ত হয়, বলে আমার কথামতো চলবে, নামাজ পড়বে। এরপর পুনরায় তাকে ঘরে তুলি। আমার ছেলেমেয়েরা এটা কিছুতেই মানতে পারছে না। তারা আমার স্ত্রীকে ছেড়ে দেয়ার জন্য চাপ দিচ্ছে। আমি বলি, বউকে ছেড়ে দেওয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়। সেও আমাকে ছাড়তে রাজি নয়। আমরা এখন ভালো আছি, সুখে আছি। তারা আমার ‘ভালো’ চায় না বলে তালা লাগিয়ে একরুমে বন্দী করে রেখেছে। বলেন এখলাস মিয়া।
এসব অভিযোগের ব্যাপারে জানতে চাইলে এখলাস মিয়ার ছোট ছেলে মোয়াজ্জেম হোসেন একুশে পত্রিকাকে বলেন, আমার বাবার সঙ্গে আমাদের কোনো শত্রুতা নেই। সমস্যাটা অন্য জায়গায়। এই বুড়ো বয়সেও তিনি একের পর এক বিয়ে করছেন, ছাড়ছেন। কোনোটার সঙ্গে ছয়মাসের বেশি সংসার করতে পারেন না। ১৯৬৫ সালে আমাদের মাকে বিয়ে করার পর তিনি বেঁচে থাকতে তিনটি বিয়ে করেন। মা মারা যাওয়ার এক মাস যেতে না যেতে তিনি আবারও বিয়ে করেন। এরপর বিয়ে করেন একে একে আরও তিনটা। দুই বছর আগে তালাক দেয়া স্ত্রীকে আবার ঘরে নিয়ে আসেন ধর্মীয় কোনো রীতিনীতি না মেনে। আমরা বলেছি, তালাক দেয়া স্ত্রীকে ঘরে তুলতে হলে আবার বিয়ে পড়তে হয়, ধর্মীয় কিছু নিয়ম মানতে হয়। কিন্তু তিনি কিছুই তোয়াক্কা করেন না।
বাবার কথা, ঘরের কথা আপনাকে কী বলি-নারী ছাড়া তিনি এক মুহূর্তও থাকতে পারেন না। কখনো কখনো মেয়ে ভাড়া করে ঘরে নিয়ে আসেন। আমরা বিয়ে করেছি, স্ত্রী-সন্তান আছে, শ্বশুরবাড়ি আছে, সমাজ, পাড়া-প্রতিবেশি আছে। এমন অবস্থা দাঁড়িয়েছে যে, কারো কাছে আমরা মুখ দেখাতে পারছি না। তাই বাধ্য হয়ে সকল-সুযোগ সুবিধা দিয়ে তাকে এক কামরায় তালা দিয়ে রেখেছি। কক্ষটিতে ঢুকিয়ে দিয়েছি তালাক দিয়ে পুনরায় ঘরে তোলা মহিলাটিকেও। তালা দিয়ে রাখলেও তাদের জন্য দিনে তিন বেলা ভাত, চারবেলা চা পাঠাচ্ছি। কক্ষটিতে অ্যাটাচ বাথরুম, টিভি দেখা এবং মোবাইল ফোন ব্যবহারের সুবিধা রেখেছি। বলেন মোয়াজ্জেম হোসেন।
মোয়াজ্জেম বলেন, ভাড়াঘর থেকে আমার বাবা যে টাকা পান তাতে কারো সহযোগিতা ছাড়া নামাজকালাম পড়ে সুন্দরভাবে বাকিজীবন কাটিয়ে দিতে পারেন। তা না করে একের পর জমি বিক্রির টাকায় নারী নিয়ে আমোদফূর্তিতে ব্যস্ত থাকেন। তিনি ধর্ম, সমাজ, নিয়ম-কানুন কিছুই মানেন না। শুক্রবারের নামাজটা পর্যন্ত তিনি পড়তে চান না। যোগ করেন মোয়াজ্জেম।
ছেলের এই বক্তব্যের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে এখলাস মিয়া বন্দী অবস্থায় তাদের জন্য দিনে দুইবেলা ভাত, একবেলা চা পাঠানোর কথা স্বীকার করে বলেন, ’আমি বিয়ে করলে তাদের সমস্যা কী? তারা কি আমাকে খাওয়াচ্ছে, না পরাচ্ছে? আমার বয়স হয়েছে। একা চলতে পারি না। সেবাসুশ্রষার জন্য একটা মেয়ে সবসময় দরকার! তারা তো আমার খবরও নেয় না।’
এখলাস মিয়া বলেন, আমার ঘরে তারা আমাকে তালা মেরে রেখেছে। তাদের কত সাহস! আমাকে মুক্ত করার ব্যবস্থা করুন। মুক্ত হওয়ার পর তাদের সঙ্গে আমার কোনো সম্পর্ক থাকবে না। আমার বাড়ি থেকে তাদেরকে চলে যেতে হবে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এখলাস মিয়ার চাচাত ভাই সম্পর্কের একজন একুশে পত্রিকাকে জানান, ”এখলাস মিয়া খুব সাহসী লোক। তার জন্য এলাকার দুষ্টু লোকেরা প্রভাব খাটাতে পারে না। অন্যায় দেখলে তিনি দাঁড়িয়ে যান, প্রতিবাদ করেন। সেই লোকগুলোই এখন কাঁটা দিয়ে কাঁটা তুলছে। কৌশলে সন্তানদের ব্যবহার করে এখলাস মিয়াকে গৃহবন্দী করে রেখেছে।”
এদিকে একাধিকবার চেষ্টা করেও এ ব্যাপারে জঙ্গলখাইন ইউনিয়নের চেয়ারম্যান গাজী মোহাম্মদ ইদ্রিসের সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি।