মোর্শেদ নয়ন : চট্টগ্রামের কর্ণফুলী থানা গঠনের পর পাঁচ ইউনিয়নের সব ওয়ার্ড কর্ণফুলী থানায় হস্তান্তর করতে প্রজ্ঞাপন জারি হলেও গত ১৭ বছরেও তা হয়নি; শিকলবাহা ও বড়উঠান ইউনিয়নের ১১ ওয়ার্ড এখনো পটিয়া থানার অধীনেই রয়েছে।
এতে পুলিশ ও সরকারের বিভিন্ন সংস্থার কাছ থেকে সেবা নিতে গিয়ে কর্ণফুলী উপজেলার বাসিন্দারা জটিলতায় পড়ছেন বলে অভিযোগ উঠছে।
২০০০ সালের ২৭ মে বন্দর ও পটিয়া থানা ভেঙে চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশের (সিএমপি) অধীনে কর্ণফুলী থানা গঠন করা হয়। এরপর ২০১৬ সালের ৯ মে প্রশাসনিক পুনর্বিন্যাস সংক্রান্ত জাতীয় বাস্তবায়ন কমিটি (নিকার)-এর ১২ তম সভায় পটিয়া উপজেলাধীন চরলক্ষ্যা, চরপাথরঘাটা, শিকলবাহা, জুলধা ও বড় উঠান ইউনিয়ন সমন্বয়ে কর্ণফুলী থানাকে উপজেলায় উন্নীতকরণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে সরকার।
কর্ণফুলী উপজেলা ও থানার আয়তন একই করার মাধ্যমে জনগণের দুর্ভোগ কমাতে স্থানীয় সাংসদ ও ভূমি প্রতিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদ এবং কর্ণফুলী উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ফারুক চৌধুরী নানা দৌড়ঝাঁপ করে আসছেন।
গত বছরের ১৫ নভেম্বর কর্ণফুলী থানার সীমানা ঠিক করতে স্বরাষ্ট্রসচিবকে আধা সরকারি পত্র (ডিও) দিয়েছেন ভূমি প্রতিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদ। ২৩ নভেম্বর জেলা পুলিশ সুপার ও নগর পুলিশ কমিশনারকে চিঠি দিয়েছেন কর্ণফুলী উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ফারুক চৌধুরী।
কর্ণফুলী উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ফারুক চৌধুরী একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘সর্বশেষ কর্ণফুলী উপজেলা পরিষদ গঠনের প্রজ্ঞাপনেও বলা আছে, কর্ণফুলী উপজেলার পাঁচটি ইউনিয়নের সব ওয়ার্ডই কর্ণফুলী থানার আওতাধীন হবে। কিন্তু জেলা পুলিশকে বিষয়টি একাধিকবার জানানোর পরও জেলা পুলিশের গড়িমসির কারণে ১১টি ওয়ার্ড কর্ণফুলী থানায় হস্তান্তর করা হয়নি। এ কারণে ওই ১১ ওয়ার্ডের বাসিন্দাসহ উপজেলাবাসীকে চরম দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে।’
ফারুক চৌধুরী বলেন, ‘গত বছরের ২৯ এপ্রিল কর্ণফুলী উপজেলার দাপ্তরিক কার্যক্রম আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনী অনু্ষ্ঠানে পুলিশ কমিশনার ইকবাল বাহার সাহেবের দৃষ্টি আর্কষণ করেছিলাম এ বিষয়ে। চেয়ারম্যান হিসেবে শপথ নিয়ে বিভাগীয় কমিশনার মহোদয়ের কাছে উত্থাপন করেছি। গত ১২ নভেম্বর অনুষ্ঠিত জেলা আইন-শৃঙ্খলা কমিটির সভায়ও উত্থাপন করি। কিন্তু দু:খজনক হলেও সত্য, কোনভাবেই সমস্যাটির সুরাহা হচ্ছে না।’
পাঁচটি ইউনিয়ন নিয়ে কর্ণফুলী থানা ও নতুন উপজেলা গঠিত হলেও শিকলবাহা ইউনিয়নের ছয়টি ওয়ার্ড এবং বড়উঠান ইউনিয়নের পাঁচটি ওয়ার্ড এখনো কর্ণফুলী থানার অধীনে আসেনি। এ কারণে বড়উঠান ও শিকলবাহা এই দুই ইউনিয়নের মানুষকে আইন-শৃঙ্খলার প্রয়োজনে ছুটতে হচ্ছে দুই থানায়। কেউ যাচ্ছে পটিয়া থানায়, কেউ যাচ্ছে কর্ণফুলী থানায়। আবার অনেকেই নিজেদের থানা সঠিকভাবে না চেনায় পটিয়া ও কর্ণফুলী থানায় ঘুরপাক খাচ্ছে।
অভিযোগ আছে, সীমানা জটিলতার সুযোগে এক থানার পুলিশ অপরাধ সংগঠনের স্থানটি সংশ্লিষ্ট থানায় নয়, অন্য থানায় উল্লেখ করে বাসিন্দাদের হয়রানি করে আসছে।
সম্প্রতি শাহমীরপুরে এক বাড়িতে ডাকাতির সময় চার নারীকে ধর্ষণের ঘটনায় কর্ণফুলী থানায় মামলা করতে যায় ভুক্তভোগী পরিবার। তখন ঘটনাস্থল কর্ণফুলী থানা এলাকায় পড়েনি দাবি করে মামলা গ্রহণ করতে অপারগতা প্রকাশ করেন ওসি। তখন ভুক্তভোগী পরিবারকে পরামর্শ দেয়া হয় পটিয়া থানায় যেতে।
পরিবারটি পটিয়া থানায় গেলে পটিয়া পুলিশ বলেছিল ঘটনাস্থল পটিয়া থানা এলাকায় পড়েনি, এটি কর্ণফুলী থানার আওতাধীন। তাই যেতে হবে কর্ণফুলী থানায়। এ নিয়ে পাঁচ দিন কর্ণফুলী ও পটিয়া থানায় দৌড়ঝাঁপের পরও মামলা গ্রহণ করা হচ্ছিল না। এরপর ভূমি প্রতিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান জাবেদের হস্তক্ষেপে কর্ণফুলী থানা মামলা গ্রহণ করে।
একাধিক ভুক্তভোগী জানিয়েছেন, প্রতি বছর হজ্বযাত্রীদের চরম বিপাকে পড়তে হয়। পুলিশ ক্লিয়ারেন্সের স্লিপ কারও আসে কর্ণফুলী থানায়, আবার কারও স্লিপ চলে যায় পটিয়ায়। ফলে হজ্বযাত্রীদের ঘুরপাক খেতে হয়। পুলিশ ক্লিয়ারেন্সের কাজ সময় মত না হওয়ায় অনেক হজ্বযাত্রীকে ফ্লাইট পেছাতে হয়।
সীমানা জটিলতায় ‘হয়রানির’ শিকার খোদ কর্ণফুলী উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) বিজেন ব্যানার্জীও। রাষ্ট্রীয়ভাবে পালিত বিজয় দিবসের অনুষ্ঠান পণ্ড করে দেওয়ার ঘটনায় একজন ইউপি চেয়ারম্যান ও তার পাঁচ শতাধিক সহযোগীর বিরুদ্ধে একটি অভিযোগ কর্ণফুলী থানায় পাঠান ইউএনও। কিন্তু কর্ণফুলী থানা পুলিশ এই অভিযোগ মামলা হিসেবে গ্রহণ না করে দুই দিন থানায় ফেলে রাখে। দুইদিন পর ২০ ডিসেম্বর অভিযোগটি ইউএনও পাঠান পটিয়া থানায়। তখন মামলাটি পটিয়ায় রেকর্ড হয়।
এ প্রসঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে চট্টগ্রাম জেলার পুলিশ সুপার নুরেআলম মিনা সীমানা সংক্রান্ত জটিলতায় ভোগান্তির কথা স্বীকার করেছেন।
একুশে পত্রিকাকে পুলিশ সুপার বলেন, ‘কর্ণফুলী উপজেলা ও থানার আয়তন একই হলে এসব সমস্যা থাকবে না। সীমানাসংক্রান্ত বিরোধ এড়ানোর জন্য জেলা পুলিশের পক্ষ থেকে একটি চিঠি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠানো হয়েছে। সিএমপি এবং জেলা প্রশাসনও চিঠি পাঠিয়েছে। এ সংক্রান্ত সরকারি আদেশ (জিও) ইস্যু হলে সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে।
দ্রুত সময়ের মধ্যে জিও ইস্যু হবে বলে আশা করছেন চট্টগ্রাম জেলার পুলিশ সুপার নুরেআলম মিনা।