চট্টগ্রাম : কিছুদিন আগেও আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরকে চট্টগ্রামের রাজনীতিতে মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীনের শক্তি ও নির্ভরতা ভাবা হতো। মেয়র হওয়ার পর থেকে ক্রমশ আ জ ম নাছিরের প্রতি ঝুঁকে পড়েন ওবায়দুল কাদের। চট্টগ্রামে নানা সভা-সমাবেশ, বিভিন্ন সরকারি অনুষ্ঠানমালায় উপস্থিত হলে ওবায়দুল কাদেরের কথায়, ইঙ্গিতে নাছিরের প্রতি আলাদা একটা স্নেহের জায়গা ফুটে উঠতো।
চলতি বছরের শুরুর দিকে নানা ইস্যুতে সদ্য প্রয়াত মহিউদ্দিন চৌধুরীর সঙ্গে আ জ ম নাছিরের বিরোধ-বিসম্বাদের সময়ও প্রচ্ছন্নভাবে আ জ ম নাছিরের পক্ষ নিতে দেখা যায় ওবায়দুল কাদেরকে।
চরম বিরোধ সামনে রেখে অনুষ্ঠিত চট্টগ্রাম নগর আওয়ামী লীগের প্রতিনিধি সম্মেলনে ওবায়দুল কাদের মহিউদ্দিন চৌধুরী এবং নাছিরকে সামনে রেখে বলেছিলেন, ‘দল করলে দলের শৃঙ্খলা মানতে হবে। যত বড় প্রভাবশালী হোন না কেন, দলে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।’
একই অনুষ্ঠানে প্রয়াত সাবেক মেয়র মহিউদ্দিন চৌধুরীকে উদ্দেশ্য করে ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘আমি মহিউদ্দিন ভাইকে বলি, নাছির আপনার সন্তানের মতো। নাছির দোষ করলে তাকে ডেকে শাসন করার অধিকার আপনার আছে। কিন্তু ঘরের কথা বাইরে বলতে যাবেন কেন?’
এভাবেই মেয়র নাছিরের প্রতি বাড়তি ‘স্নেহ’ দেখানো ওবায়দুল কাদেরের সঙ্গে গত ৬ মাসেরও বেশি সময় ধরে কোনো অনুষ্ঠানে দেখা যাচ্ছে না আ জ ম নাছিরকে। যদিও সর্বশেষ লালদিঘী ময়দানে মহিউদ্দিন চৌধুরীর জানাজায় ওবায়দুল কাদেরের পাশাপাশি যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল নাছিরের।
এর আগে গত ৬ এপ্রিল নগর আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক মুক্তিযোদ্ধা সেকান্দর হায়াত খানের স্মরণসভায় ওবায়দুল কাদের ও আ জ ম নাছিরকে এক মঞ্চে দেখা গিয়েছিল।
২৯ এপ্রিল নগরীর পাঁচলাইশে একটি কমিউনিটি সেন্টারে চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের প্রতিনিধি সম্মেলনে প্রধান অতিথি ছিলেন ওবায়দুল কাদের। সেই সভায় সঞ্চালনায় ছিলেন সাধারণ সম্পাদক ও সিটি মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দিন।
১৫ জুন চট্টগ্রামের লালখান বাজারের ঝুঁকিপূর্ণ মতিঝর্ণা পাহাড়ি এলাকা পরিদর্শনের সময় ওবায়দুল কাদেরের সঙ্গে মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দিন, সাবেক মন্ত্রী ডা. আফছারুল আমীন উপস্থিত ছিলেন।
এরপর আর কোনো অনুষ্ঠানে ওবায়দুল কাদেরের সঙ্গে আ জ ম নাছিরকে দেখা যায়নি। অথচ গত ছয় মাসে চট্টগ্রাম ও এর আশপাশে বেশ কয়েকটি অনুষ্ঠানে ওবায়দুল কাদের উপস্থিত হয়েছেন, বক্তৃতা করেছেন।
১৬ জুলাই নগরীর একটি কনভেনশন সেন্টারে চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের প্রতিনিধি সভায় প্রধান অতিথি ছিলেন আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। সেই সভায় দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মোছলেম উদ্দিন চৌধুরী, সাধারণ সম্পাদক মফিজুর রহমান, ভূমি প্রতিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদ, সাংগঠনিক সম্পাদক ব্যারিস্টার মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল, উপ-প্রচার সম্পাদক আমিনুল ইসলাম, উপ-দপ্তর সম্পাদক বিপ্লব বড়ুয়াসহ অনেকেই ছিলেন; শুধু দেখা যায়নি আ জ ম নাছিরকে।
৯ অক্টোবর চট্টগ্রামের পতেঙ্গায় কর্ণফুলী টানেলের ওয়ার্কিং সাইট পরিদর্শনে যান ওবায়দুল কাদের। সে সময় আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদকের সঙ্গে ছিলেন শামসুল হক চৌধুরী এমপি, তাজুল ইসলাম এমপি, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক এনামুল হক শামীম, চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মোসলেম উদ্দিন, সাধারণ সম্পাদক মফিজুর রহমান প্রমুখ।
একইভাবে ৯ অক্টোবর মুসলিম হলে আতাউর রহমান খান কায়সারের স্মরণসভায় ওবায়দুল কাদের প্রধান অতিথি ছিলেন, সেখানেও দেখা যায়নি নাছিরকে। সেদিন কর্মসূচি শেষে বের হওয়ার সময় ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা তাদের সহকর্মী সুদীপ্ত খুনের বিচার চেয়ে ওবায়দুল কাদেরের গাড়ি ঘিরে স্লোগান দেন।
এসময় সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের প্রশাসনের উদ্দেশে বলেন, এই হত্যাকা-ের সঙ্গে যারা জড়িত, তাদের গ্রেপ্তার করুন। তাদের আইনের আওতায় নিয়ে আসুন। কারণ, সন্ত্রাসীদের কোনো দল নেই। সন্ত্রাসীরা সন্ত্রাসী, দুর্বৃত্তরা দুর্বৃত্ত। এ ঘটনায় মঞ্চে এবং নেপথ্যে যারা জড়িত এবং তারা যতই প্রভাবশালী হোক, কাউকে ক্ষমা করা যাবে না। যদিও সুদীপ্ত হত্যামামলাটি এখন ধামাচাপার পথে।
গত ৫ নভেম্বর আনোয়ারায় আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবুর স্মরণসভায় ওবায়দুল কাদের প্রধান অতিথি ছিলেন। চট্টগ্রামের প্রায় সব এমপি, উত্তর-দক্ষিণ-মহানগরের নেতা, কেন্দ্রীয় নেতা আমিনুল ইসলাম, ব্যারিস্টার বিপ্লব বড়ুয়া সেখানে উপস্থিত ছিলেন, দলের সেক্রেটারিকে সঙ্গ দিয়েছেন। কিন্তু আ জ ম নাছির নেই।
রোহিঙ্গা ইস্যুতে অসংখ্যবার কক্সবাজার গেছেন দলের সাধারণ সম্পাদক। মাহবুব উল আলম হানিফ, ড. হাছান মাহমুদ থেকে শুরু করে কেন্দ্র ও জেলার অনেকেই তার সফরসঙ্গী হয়েছেন, কিন্তু আ জ ম নাছির সেই কর্মসূচিতে নেই। একইভাবে প্রধানমন্ত্রী রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শন করতে কক্সবাজার যান। সেখানেও দেখা যায়নি মেয়র আ জ ম নাছিরকে।
গত ১ সেপ্টেম্বর সকাল সাতটায় বাসায় পা পিছলে কোমড়ে আঘাত পান মেয়র নাছির। কোমড়ের তীব্র ব্যথা নিয়ে বাসায় শয্যাশায়ী ছিলেন একমাস। দলের অনেক মন্ত্রী-এমপি, কেন্দ্রীয় নেতা, তারকা খেলোয়াড় আ জ ম নাছিরকে দেখতে বাসায় ছুটে যান। তার শয্যাপাশে সময় কাটান। কিন্তু নাছিরকে দেখতে যাননি তার ‘নির্ভরতা’র নেতা হিসেবে পরিচিত দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের।
প্রশ্ন উঠেছে, ওবায়দুল কাদের হঠাৎ করে নাছিরকে এড়িয়ে চলার কারণ কী? নাছিরই বা কেন দূরপথে হাঁটছেন? আসলেই কি তারা পরস্পর এড়িয়ে চলছেন? মেয়র নির্বাচিত হওয়ার পর কিছু কর্মকাণ্ডে অসন্তুষ্ট প্রধানমন্ত্রী নাছিরকে এড়িয়ে চলছেন বলে চট্টগ্রামের রাজনীতির মাঠে প্রচার আছে।
প্রধানমন্ত্রীর মনোভাব বুঝেই ওবায়দুল কাদের নাছিরকে এড়িয়ে চলছেন? নাকি অন্য হিসাব-নিকাশ?- চট্টগ্রামের রাজনৈতিক মহলে সৃষ্ট এই কৌতূহল সামনে রেখে ওবায়দুল কাদের ও আ জ ম নাছির উদ্দীনের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়। ফোনে ওবায়দুল কাদেরকে পাওয়া না গেলেও ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে বহু চেষ্টার পর আ জ ম নাছিরকে পাওয়া ফোনে পাওয়া যায়।
কুশলাদি জানার পর মূল আলোচনায় যেতেই মিটিংয়ে আছেন, পরে কথা বলবেন জানিয়ে ফোন রেখে দেন। এরপর আ জ ম নাছিরকে আর পাওয়া যায়নি।