চট্টগ্রাম : নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও চট্টগ্রাম সিটি মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীনের সাথে দূরত্ব তৈরি হওয়ায় নগর আওয়ামী লীগ সভাপতি এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী মেরুতে ভেড়ার চেষ্টা করছেন চট্টগ্রাম ১১ আসনের সংসদ সদস্য এম এ লতিফ।
এরই অংশ হিসেবে গত ২২ নভেম্বর মহিউদ্দিন চৌধুরীর রোগমুক্তি কামনায় ঘটা করে দোয়া মাহফিল ও তবরুক বিতরণ অনুষ্ঠান করেছেন লতিফ।
লতিফের ৩ নং জেটি গেইটস্থ কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত দোয়া মাহফিলে মহিউদ্দিন চৌধুরীকে তিনবারের সফল মেয়র ও তাদের ‘অভিভাবক’ বলে উল্লেখ তার রোগমুক্তি কামনায় বিশেষ মোনাজাত করা হয়।
অবশ্য দোয়া মাহফিলে লতিফের অনুসারী সংসদীয় এলাকার বিভিন্ন ওয়ার্ডের আওয়ামী লীগের কিছু মাঝারীপর্যায়ের নেতা উপস্থিত থাকলেও এমপি লতিফ উপস্থিত ছিলেন না।
এ প্রসঙ্গে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক লতিফের অনুসারী পতেঙ্গা এলাকার সাবেক একজন কমিশনার একুশে পত্রিকাকে বলেন, যে লতিফ মহিউদ্দিন চৌধুরীকে সহ্যই করতে পারেন না, তাঁর প্রসঙ্গ এলে গালাগাল ও বিষোদ্গার করেন সেই লতিফই মহিউদ্দিন চৌধুরীর জন্য দোয়া মাহফিলের আয়োজন করেছেন, তাকে অভিভাবক বলে স্বীকার করছেন।
আ জ ম নাছির উদ্দীনের সাথে দূরত্ব তৈরি হওয়ায় মহিউদ্দিন চৌধুরী গ্রুপে ভেড়ার কৌশল হিসেবে এমপি লতিফ এই দোয়া মাহফিলের আয়োজন করেছেন বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
কিছুদিন আগেও মেয়র আ জ ম নাছিরই ছিলেন রাজনীতিতে এমপি লতিফের ভরসা। ২০০৮ সালে আ”লীগের টিকেটে রাতারাতি এমপি হয়ে ভারটি যেন বইতে পারছিলেন না চট্টগ্রাম-১১ আসনের সংসদ সদস্য এম এ লতিফ। চট্টগ্রাম বন্দরের তৎকালীন পরিচালক ক্যাপ্টেন জোবায়ের এবং পুলিশের এআইজি নববিক্রম কিশোর ত্রিপুরার সাথে দুর্ব্যবহার-ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ করে এমপি মেয়াদের শুরুতেই দেশজুড়ে বিতর্কের জন্ম দেন লতিফ। এর রেশ না কাটতেই ওয়াটার ট্রান্সপোর্ট সেল (ডব্লিউটিসি) ইস্যুতে বিবাদে জড়ান নগর আ-লীগের সভাপতি এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরীর সাথে। এর জেরে চেম্বারের এক অনুষ্ঠানে মহিউদ্দিন অনুসারীদের হাতে এমপি লতিফের লাঞ্ছিত হওয়ারও ঘটনা ঘটে।
জামায়াত-তোষণের অভিযোগ যখন পিছু ছাড়ছেই না, তখন এমপি লতিফ যোগ দেন জামায়াত ঘরানার সংগঠন চাষীকল্যাণ সংস্থার যৌতুকবিহীন এক বিয়ে অনুষ্ঠানে। লতিফের এই জামায়াত-প্রীতি চট্টগ্রামের রাজনীতিতে নতুন করে বিতর্কের জন্ম দেয়। এ পর্যায়ে রাজনীতিতে কোণঠাসা লতিফ ‘একলা চলো’ নীতি অনুসরণ করতে থাকেন।
২০১৩ সালে নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হয়ে আসেন মহিউিদ্দিনবিরোধী শিবিরের প্রধান নেতা আ জ ম নাছির উদ্দীন। লতিফ ভিড়ে যান আ জ ম নাছিরের সাথে, যুক্ত হন বন্দরভিত্তিক একছেটিয়া ব্যবসায়। সেই থেকে দুজনের ঘনিষ্ঠ হাত ধরাধরি। চট্টগ্রামের রাজনীতির মাঠে মনে করা হয় আ জ ম নাছিরই এমপি লতিফের বড় ভরসা, আস্থার জায়গা।
বঙ্গবন্ধুর মুখমণ্ডলের সাথে নিজের শরীরে জোড়া লাগানোর ঘটনায় লতিফের পদত্যাগ, বহিষ্কার দাবিতে প্রকাশ্যে সরব হয়ে উঠেছিলেন মহিউদ্দিন চৌধুরী। লালদিঘীর মাঠের জনসভার আয়োজন করে যেখানেই লতিফকে পাওয়া যাবে, সেখানেই ধোলাই করা হবে- ঘোষণা দিয়েই থেমে থাকেননি, মহিউদ্দিন চৌধুরীর অনুসারীরা বঙ্গবন্ধুর ছবি বিকৃতির ঘটনায় একের পর এক তিনটি মামলা করেন লতিফের বিরুদ্ধে। লতিফ অবশ্য ঠাণ্ডা মাথায় সেই পরিস্থিতি মোকাবেলা করে সঙ্কট উতরে যান। লতিফের পক্ষে যায় ছবি বিকৃত সংক্রান্ত সব মামলার ফলাফল।
জনশ্রুতি আছে, সেই টালমাটাল সময়ে আ জ ম নাছিরই লতিফকে আগলে রেখেছিলেন। আ জ ম নাছিরের বুদ্ধি-পরামর্শেই বিশাল সেই সঙ্কট কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হন লতিফ।
সাম্প্রতিক সময়ে তাদের সেই অন্তরাত্মায় চিড় ধরেছে, ভাটা পড়েছে দুজনের সম্পর্কে। গত সেপ্টেম্বরে বন্দরের সিবিএ নির্বাচনে আলাদা প্রার্থী দেওয়ার মধ্যদিয়ে দুজনের বিভক্তিটা দৃশ্যমান হয়। অনেকেরই প্রশ্ন, আ জ ম নাছিরের কথার বাইরে কদম বাড়ান না যে লতিফ, সেই তিনিই আ জ ম নাছিরের বাইরে গিয়ে পৃথক প্যানেল ঘোষণা দিয়েছেন!
মূলত এরপর থেকে নাছির-লতিফ একে অপরকে এড়িয়ে চলা শুরু করেন এবং বিভক্তিটাও দেখা দেয় তখন থেকে। গত ১৮ নভেম্বর চট্টগ্রামের পতেঙ্গায় সাউথ কন্টেইনার ইয়ার্ডে প্রধান অতিথি ছিলেন নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান। বিশেষ অতিথি ছিলেন চট্টগ্রামের মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন, নওগাঁ-৬ আসনের সাংসদ মো. ইসরাফিল আলম, চট্টগ্রাম-১১ আসনের সাংসদ মো. আব্দুল লতিফ ও চট্টগ্রাম কাস্টমস কমিশনার ড. এ কে এম নূর-উ-জামান। সেই অনুষ্ঠানে নির্ধারিত অতিথিদের সবাই উপস্থিত থাকলেও উপস্থিত ছিলেন না কেবল আ জ ম নাছির।
সূত্র মতে, এমপি লতিফের সঙ্গে দূরত্ব তৈরি হওয়ার কারণে সেই অনুষ্ঠানে উপস্থিত হননি নাছির। এর আগে একই দিনে নৌ পরিবহনমন্ত্রীর উপস্থিতিতে বন্দর সংক্রান্ত একটি মিটিংয়ে মেয়র নাছির ও এমপি লতিফ উপস্থিত থাকলেও কেউ কারো সঙ্গে সৌজন্যতাবশত ‘হ্যান্ডশেক’ করারও প্রয়োজন অনুভব করেননি।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে পতেঙ্গা এলাকার আরেক আ’লীগ নেতা আ জ ম নাছিরের সাথে লতিফের দূরত্বের বিষয়টি স্বীকার করে একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘নাছির ভাইয়ের সঙ্গে সুসম্পর্ক ছিল বলেই আমরা লতিফকে গেলার চেষ্টা করেছি। সে কারণে আমাদেরকে লতিফের অনুসারী বলা হয়। এটা সত্য যে, যতক্ষণ নাছির ভাইয়ের সাথে আছেন ততক্ষণ আমরাও লতিফের সাথে আছি। নাছির ভাই নাই, আমরাও নাই।’
তিনি বলেন, পতেঙ্গায় সাউথ কন্টেইনার ইয়ার্ডের অনুষ্ঠানে কর্মীবাহিনী নিয়ে এমপি লতিফ আমাকে যেতে অনুরোধ করেছিলেন। কিন্তু আমাদের নেতা নাছির ভাই আসবেন না জেনে কর্মীবাহিনী দূরের কথা, আমরা নিজেরাও আর সেই অনুষ্ঠানে যাইনি।
রবিবার বেলা ১২ টার দিকে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হলে সংসদ সদস্য এম এ লতিফ একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘আমি চাই না যে কোনোধরনের মতপার্থক্য, অন্তকোন্দল লালন-পালন করতে। এতে আমার লাভটা কী, তাঁরও (মহিউদ্দিন) বা লাভ কী? ভাইয়ে ভাইয়ে অনেক সময় বিভেদ হয়। এটাকে জিইয়ে রাখা কি ঠিক? ওনি আমার দলের সভাপতি। ওনি অসুস্থ। এরকম অসুস্থ তিনি আগে কখনো হননি। এ পরিস্থিতিতে তার পাশে থাকা, তার জন্য দোয়া কামনা করা মানুষ হিসেবেও কমিটমেন্টের অংশ।’
এখানে মহিউদ্দিন চৌধুরীর সঙ্গে ভিড়ে যাওয়ার মতো কোনো ঘটনা নেই জানিয়ে এমপি লতিফ বলেন, আ জ ম নাছির আমার দলের সাধারণ সম্পাদক, আর মহিউদ্দিন চৌধুরী সভাপতি। উভয়ের সুখে-দুঃখে আমরা সাথী হবো এটাই স্বাভাবিক। এখানে কিছু মানুষ আছে যারা এটাকে পুঁজি করতে চায়। আমি রাজনীতি করি দলীয় আদর্শে, বঙ্গবন্ধুর আদর্শে, শেখ হাসিনার পদাঙ্ক অনুসরণ করে। ওনাদের রাজনীতিও একই আদর্শকে ধারণ করে। সুতরাং আমাদের মধ্যে আদর্শিক কোনো পার্থক্য নেই।’
নাছিরের সাথে সম্পর্কের অবনতি হয়নি দাবি করে এম এ লতিফ বলেন, তাঁর সঙ্গে আমার কোনো দূরত্ব তৈরি হয়নি। একশ্রেণীর মানুষ এগুলো রটাচ্ছে। এধরনের কথা বলে উসকে দিয়ে পরিস্থিতি ঘোলাটে করার চেষ্টা করছে। প্রকৃতপক্ষে আমি কোনো গ্রুপিংয়ে নাই, কোন্দলে নাই।
আ জ ম নাছিরের সাথে দূরত্ব না থাকলে বন্দরের সিবিএ নির্বাচনে পৃথক প্রার্থী দিলেন কেন- এই প্রশ্নে লতিফ বলেন, ভাই আপনি তো আবার পেছনে চলে গেছেন। এর উত্তর এখন নাই বা দিলাম।’
এ ব্যাপারে কথা বলতে চট্টগ্রাম সিটি মেয়র ও নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আ জ ম নাছির উদ্দীনের মোবাইল ফোনে একাধিকবার চেষ্টা করেও তাকে পাওয়া যায়নি। রিং হলেও তিনি রিসিভ করেন নি।
এছাড়া চট্টগ্রাম নগর আ’লীগের সভাপতি এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী অসুস্থ থাকায় এ প্রসঙ্গে তাঁর বক্তব্য জানার সুযোগ হয়নি।