রবিবার, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ৮ পৌষ ১৪৩১

টাকা চুরি করে পালালো শিশু, হলো অপহরণ মামলা গ্রেফতারি পরোয়ানা

প্রকাশিতঃ ১৮ নভেম্বর ২০১৭ | ১১:০৪ অপরাহ্ন

চট্টগ্রাম : তদন্তের জন্য পুলিশের রয়েছে বিশেষায়িত ইউনিট। অপরাধ তদন্তের জন্য তাদের রয়েছে বিশেষ প্রশিক্ষণ ও অভিজ্ঞতা। এ ছাড়া থানার মাধ্যমে পুলিশের নেটওয়ার্ক দেশের সর্বত্র বিস্তৃত। পুলিশের পক্ষেই সম্ভব প্রত্যন্ত এলাকার প্রান্তিক মানুষের কাছে পৌঁছানো। কিন্তু চট্টগ্রামে শিশু নিখোঁজের একটি মামলা লক্ষীপুরের একজন ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যানকে তদন্তের জন্য দিয়েছেন আদালত। শেষ পর্যন্ত ফলটা কী হয়েছে, তা শুনলে অবাক হতে হবে।

চট্টগ্রাম নগরের বন্দর থানা এলাকার একটি দোকান থেকে নিখোঁজ হয়ে যায় এক শিশু কর্মচারী। এ ঘটনায় লক্ষ্মীপুরের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে মামলা করেন ওই শিশুর বাবা কামাল উদ্দিন। মামলাটি তদন্তের জন্য লক্ষ্মীপুরের কমলনগর উপজেলার চরমার্টিন ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ইউসুফ আলীকে আদেশ দেয় ট্রাইব্যুনালের বিচারক।

ওই মামলায় চট্টগ্রামের ওই দোকানটির মালিক আলী মুছা, তার ব্যবসায়িক পার্টনার ওমর ফারুক এবং ফারুকের শ্বশুর মো. চৌধুরী মিস্ত্রিকে আসামি করা হয়।

আদালতের আদেশে তদন্ত শেষ করে গত ৯ অক্টোবর আদালতে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেন ইউপি চেয়ারম্যান ইউসুফ আলী। ইউনিয়ন পরিষদের প্যাডে দেওয়া ওই প্রতিবেদনে রয়েছে ভুল বানানের ছড়াছড়ি। এ ছাড়া প্রতিবেদনটি পড়ে জানা গেছে, ওই তদন্তপর্বটি কার্যত ফলাফল শূন্য।

তদন্ত প্রতিবেদনটির মূল কথা হচ্ছে, ‘তদন্তভার নিয়ে ইউপি চেয়ারম্যান ইউসুফ আলী বাদি ও বিবাদি এবং স্বাক্ষীদের কাছ থেকে দুই দফা বক্তব্য নিয়েছেন। বিবাদিদের দোকানে ওই শিশুটি চাকরি করতেন বলেও সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলো কাছ থেকে তিনি তথ্য পান। এই ঘটনায় চট্টগ্রাম নগরের ডবলমুরিং ও বন্দর থানায় দুটি জিডি হয়েছে। বর্তমানে ওই শিশুটি কোথায় আছে তিনি তা অবগত নন।’

তদন্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী আসামিরা শিশুটিকে অপহরণ করেছে- এমন কোন তথ্য ছিল না। এরপরও ওই তদন্ত প্রতিবেদনটি আমলে নিয়ে লক্ষ্মীপুরের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারক আসামিদের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেন।

জানতে চাইলে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক মো. জাকির হোসেন বলেন, ‘সরাসরি আদালতে মামলা দায়ের হলে বিচারক যাকে তদন্তের জন্য উপযুক্ত মনে করেন, তাকেই দায়িত্বভার দিতে পারেন। এক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী কোন সংস্থাকে অবশ্যই দিতে হবে- এমন বাধ্যবাধকতা নেই। ওই মামলাটি তদন্তের জন্য ইউপি চেয়ারমানকে হয়তো উপযুক্ত মনে করেছিলেন বিচারক।’

‘তবে যাকে তদন্ত করার জন্য দেয়া হচ্ছে, তিনি তদন্ত করার মতো যোগ্যতা রাখেন কিনা- সেটা বিবেচনার বিষয় আছে।’ বলেন অধ্যাপক মো. জাকির হোসেন।

এদিকে শিশু নিখোঁজের ঘটনায় দোকান মালিক আলী মুছা ও ওমর ফারুকের বিরুদ্ধে বন্দর ও ডবলমুরিং থানায় পৃথক দুটি সাধারণ ডায়েরী করেন শিশুটির বাবা কামাল উদ্দিন। একপর্যায়ে ডবলমুরিং থানার এসআই হেলাল উদ্দিন আটক করেন আলী মুছাকে; পরে মুছলেকা নিয়ে ছেড়ে দেয়া হয় তাকে। অন্যদিকে এসব মামলায় পুলিশী হয়রানির মুখে পালিয়ে বেড়ান ওমর ফারুক। বন্ধ হয়ে যায় তাদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান।

এরপর আদালতের আদেশে শিশুটির হঠাৎ নিখোঁজ রহস্য নিয়ে তদন্তে নামে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। শুক্রবার (১৭ নভেম্বর) গাজীপুরে সুরুচি নামে একটি হোটেল থেকে শিশুটিকে উদ্ধার করা হয়। শনিবার চট্টগ্রাম মহানগর হাকিম আল ইমরানের আদালতে জবানবন্দি দিয়ে শিশুটি জানিয়েছে, তাকে কেউ অপহরণ করেনি। দোকানের ২২ হাজার টাকা চুরি করে সে পালিয়ে গিয়েছিল।

অভিযানে নেতৃত্ব দেওয়া পিবিআই চট্টগ্রাম মেট্রোর পরিদর্শক সন্তোষ কুমার চাকমা বলেন, ‘আদালতের আদেশে আমরা তদন্ত শুরু করি। ৪ আগস্ট থেকে নিখোঁজ থাকা শিশুটির ফেসবুক আইডিতে গিয়ে একটি ছবি দেখতে পাই। সাম্প্রতিক সময়ে তোলা ওই ছবিটিতে তার পেছনে একটি দোকানের সাইনবোর্ড দেখি। এতে আমরা শিশুটির অবস্থান নিশ্চিত হই এবং তাকে উদ্ধার করি।’

‘উদ্ধারের পর শিশুটি জানিয়েছে, সে নিজেই দোকান থেকে পালিয়ে গিয়েছিল। যাবার সময় ২২ হাজার টাকা ও আলী মুছার মোবাইল চুরি করে নিয়ে গিয়েছিল। তাকে কেউ অপহরণ করেনি। একই তথ্য উল্লেখ করে সে শনিবার আদালতে জবানবন্দিও দিয়েছে।’

উদ্ধার অভিযানে অংশ নেয়া পিবিআই’র সহকারি উপ-পরিদর্শক (এএসআই) তারেক হোসাইন বলেন, ‘ছেলেটি নিজের ইচ্ছায় পালিয়েছে। অন্যদিকে এই ঘটনায় আদালতে সিআর মামলা, নারী ও শিশু নির্যাতন আইন ও মিস মামলা মিলিয়ে মোট তিনটি মামলা হয়েছে। এ ছাড়া দুই থানায় পৃথক জিডিও হয়েছে। ছেলেটিকে উদ্ধারের মধ্য দিয়ে এসব মামলা নিষ্পত্তি ও ন্যায়বিচার নিশ্চিত হয়েছে।’

এদিকে অভিযোগ পাওয়া গেছে, লক্ষ্মীপুরে একই এলাকায় ডবলমুরিং থানার এসআই হেলালের শ্বশুরবাড়ি, নিখোঁজ শিশু এবং ওমর ফারুকের বাড়ি। ওমর ফারুকের সঙ্গে বিরোধ আছে হেলালের শ্বশুরপক্ষের। এর জের ধরে হয়রানির জন্য তাদের প্ররোচনায় কামাল উদ্দিনকে দিয়ে অপহরণের মামলা করা হয়। একইভাবে হেলালের প্ররোচণায় ডবলমুরিং থানায় জিডিও নেওয়া হয়।

এদিকে ব্যবসায়ী আলী মুছা অভিযোগ করে বলেন, ‘শিশুটি নিজেই চুরি করে পালিয়েছে। এরপর পুলিশ আর তার বাবা মিলে আমাকে অনেক হয়রানি করেছে। এসআই হেলাল আমাকে ধরে নিয়ে মামলার আসামি করবে বলে ৭০ হাজার টাকা নিয়েছে।’

তবে এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন ডবলমুরিং থানার এসআই হেলাল উদ্দিন।