বুধবার, ৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ২৩ মাঘ ১৪৩১

উপকূল থেকে সারাদেশে আলো ছড়িয়ে দেওয়া এক গণপাঠাগার

মোহাম্মদ বেলাল উদ্দিন | প্রকাশিতঃ ৫ ফেব্রুয়ারী ২০২৫ | ১২:০১ পূর্বাহ্ন


উপকূলের এক অজপাড়া গাঁ থেকে ছোটো পরিসরে যাত্রা শুরু করেছিল ‘উপকূলীয় পাবলিক লাইব্রেরি’। ১৫ বছর আগে যাত্রা করা সেই ছোটো গণপাঠাগারটি আজ পরিণত হয়েছে দেশের প্রান্তিক জনপদের এক সমৃদ্ধ গণপাঠাগারে। নতুনত্ব ও সৃজনশীল কার্যক্রম পরিচালনার মাধ্যমে দেশের ঝিমিয়ে পড়া অনেকগুলো পাঠাগারকে আবারও সক্রিয় করে তুলেছে এই পাঠাগার। ২০১০ সালের ২৯ এপ্রিল চট্টগ্রামের বাঁশখালী উপজেলার প্রত্যন্ত উপকূলীয় এলাকা ছনুয়া ইউনিয়নের খুদুকখালী গ্রামের জীর্ণশীর্ণ এক সাইক্লোন শেল্টার থেকে চারটি চেয়ার, একটি টেবিল, একটি বুকসেলফ ও ২০টি বই নিয়ে যাত্রা শুরু করে এই পাঠাগার। আজ সেই পাঠাগারটি ৯ হাজার ৫০০ বইয়ের এক সমৃদ্ধ গ্রন্থাগারে পরিণত হয়েছে।

উপকূলের বাতিঘরখ্যাত এই পাঠাগার সম্পর্কে খুদুকখালী গ্রামের স্থানীয়দের সাথে কথা বলে জানা গেছে, এখানকার মানুষ আগে পাঠাগার সম্পর্কে কিছুই জানতো না। শুরুতে অনেকে এটিকে বই-বেচাকেনার লাইব্রেরি মনে করতো। গ্রামের মানুষের কাছে পাঠাগারের ধারণা একেবারেই নতুন ছিল, তাই প্রথম প্রথম অনেকে না বুঝে পাঠাগার সম্পর্কে বিরূপ মন্তব্য করতো। শুরুর দিকে তেমন কেউ গুরুত্ব দিতে চাইতো না। তবে ধীরে ধীরে গ্রামের মানুষের ভুল ভাঙতে শুরু করে। তারা পাঠাগারকে আপন করে নেয়। সময়ের ব্যবধানে পাঠাগারটি ছনুয়া ইউনিয়নসহ আশেপাশের ইউনিয়ন সমূহের হাজারো শিক্ষার্থীর জ্ঞানার্জনের তীর্থস্থান হয়ে উঠেছে।

খুদুকখালী গ্রামের স্থানীয় মাদরাসার পরিচালক আব্বাস উদ্দীন নুরী জানান, একটি সক্রিয় পাঠাগার পুরো একটি জনপদের চিত্র পাল্টে দিতে পারে, যার বাস্তব প্রমাণ হলো উপকূলীয় পাবলিক লাইব্রেরি। তিনি বলেন, এই পাঠাগারের মাধ্যমে আমাদের গ্রামসহ আশেপাশের অনেক গ্রামের শতশত শিক্ষার্থী হাজারো বইয়ের সান্নিধ্য পেয়েছে। আমাদের সন্তানেরা এক সময় পাঠ্যবই ছাড়া অন্য কোনো বইয়ের দেখা পেত না, তবে এই পাঠাগারের কল্যাণে এখন পাঠ্যবইয়ের বাইরে খুব সহজে হাজারো বইয়ের সান্নিধ্য লাভ করেছে।

‘অন্ধকারে আলোর প্রদীপ’—এই স্লোগান ধারণ করে যাত্রা শুরু করেছিল এই পাঠাগার। বাঁশখালীর উপকূলীয় অঞ্চলে শিক্ষা-সাহিত্য-সংস্কৃতি চর্চার দিক থেকে অন্ধকারাচ্ছন্ন জনপদগুলোর মধ্যে ছনুয়া ইউনিয়ন অন্যতম। যুগ যুগ ধরে এখানে একদল অশিক্ষিত স্বার্থান্বেষী মহলের ধারাবাহিক নেতৃত্বের কারণে শিক্ষিতজনের সম্মানজনক অবস্থান গড়ে ওঠেনি। উপরন্তু যেসব শিক্ষিতজনেরা এখানে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য সামাজিক কর্মকাণ্ডে আগ্রহী হতেন, তাঁদের উপর নেমে আসতো বিভিন্ন লাঞ্ছনা। গ্রামের উচ্ছৃঙ্খল মানুষদের লেলিয়ে দিয়ে তাঁদের সামাজিকভাবে এবং পারিবারিকভাবে নাজেহাল করা হতো। বিভিন্ন কটূক্তি করে এলাকা ছাড়তে বাধ্য করা হতো।

খুদুকখালী গ্রামের বাসিন্দা আবদুল মাবুদ জানান, আমাদের এখানে ভালো কাজের মাধ্যমে সমাজের পরিবর্তন হোক সেটা একটি শক্তিশালী গোষ্ঠী কখনো চায়নি। তারা চেয়েছে এখানে তাদের আধিপত্য বজায় থাকুক এবং মানুষ অন্ধকারে নিমজ্জিত থাকুক।

তিনি বলেন, এই পাঠাগারের মাধ্যমে যখন গ্রামের ছেলে-মেয়েরা বইপড়ায় আগ্রহী হতে লাগল, তখন এলাকার একটি প্রভাবশালী মহল পাঠাগারের বিরুদ্ধে উঠে-পড়ে লেগেছিল। শুরু হয় নানান চক্রান্ত। তবে কোনো চক্রান্ত, বাধা-বিপত্তির কাছে হার না মেনে সাহসের সাথে এগিয়ে যায় পাঠাগারটি। বর্তমানে ৯ হাজার ৫০০ বইয়ের সমৃদ্ধ এই পাঠাগারের নামে রয়েছে স্থায়ী জমি ও ভবন। ২০১৭ সালে পাঠাগারের নামে ক্রয়কৃত ২২ শতক জমির উপর নিজস্ব ভবনে চলছে পাঠ কার্যক্রম। যাত্রা শুরুর পর থেকে পাঠাগারের আশপাশ সংলগ্ন ৪টি ইউনিয়নের কয়েক হাজার শিক্ষার্থী বইয়ের সান্নিধ্য পেয়েছে। বইমুখী হয়েছে অনেক শিক্ষার্থী। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমকে ব্যবহার করে পাঠ কার্যক্রমের পরিধি বিস্তৃত হয়েছে দেশব্যাপী।

প্রান্তিক এই উপকূলীয় এলাকায় পাঠ্যবইয়ের বাইরে ভিন্ন বই ও দৈনিক পত্রিকা পড়া ছিল একরকম অসম্ভব। একটি পাঠাগারের বদৌলতে এখন এলাকার শিক্ষার্থীদের হাতে হাতে বই দেখা যায়, তৈরি হয়েছে ইচ্ছেমতো বই পড়ার সুযোগ, শিক্ষার্থীদের দোরগোড়ায় এসেছে দেশ-বিদেশের বিভিন্ন সাময়িকী। গ্রামের সাত বছরের শিশুটিও এখন দৈনিক কয়েকটি পত্রিকা পড়তে পারে। এখানে পাঠকরা পছন্দের বইটি ১৫ দিনের জন্য বাড়িতে নিতে পারে। পাঠকদের সাথে পাঠাগারের একটি সাঁকো তৈরি হয়েছে, গড়ে উঠেছে আত্মার সেতুবন্ধন।

বর্তমানে পাঠাগারে দর্শন, ইতিহাস, ধর্ম, মনোবিজ্ঞান, কাব্যগ্রন্থ, প্রবন্ধ, উপন্যাস, ছোটগল্প, বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী, ঐতিহ্য, সাহিত্য, মুক্তিযুদ্ধ, ভাষা-জ্ঞান, গবেষণা, অনুবাদ সাহিত্য, অর্থনীতি বিষয়ক ৯ হাজার ৫০০ বই রয়েছে। তাছাড়া বাংলাদেশ এবং ভারতীয় উপমহাদেশের প্রখ্যাত কবি, সাহিত্যিক, গবেষক ও মনীষীদের গুরুত্বপূর্ণ বই রয়েছে।

পাঠাগারের অধিকাংশ পাঠক নারী। শুরু থেকেই নারী পাঠকদের আধিক্য ছিল পাঠাগারে, যার ধারাবাহিকতা এখনো বিদ্যমান। প্রান্তিক জনপদের অন্ধকারাচ্ছন্ন সমাজে ‘পাছে লোকে কি বলে’ সেই ভয়কে পেছনে ফেলে নারীরা পাঠাগারমুখী হয়। দীর্ঘ ১৫ বছর ধরে নারী পাঠকরা পুরো লাইব্রেরি আঙিনাকে মুখরিত করে রেখেছে। তাদের পদচারণায় গ্রন্থাগারটি একটি পাঠকপ্রিয় পাঠাগারে রূপ নিয়েছে।

পাঠাগারটির বর্তমান অবকাঠামো খুবই দুর্বল। প্রতিবছর বিভিন্ন ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে পাঠাগারটি ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন হয়। সর্বশেষ গত বছরের ২৪ অক্টোবর ঘূর্ণিঝড় ‘হামুন’-এর তাণ্ডবে পাঠাগারটি লণ্ডভণ্ড হয়ে যায়। ঝড়ের তাণ্ডবে প্রায় ১ মাস খোলা আকাশের নিচে পড়ে থাকে বই ও আসবাবপত্র।

পাঠাগারের সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর আলম জানান, পাঠাগারের বর্তমান অবকাঠামো অনেকটা দুর্বল। পাঠাগারের সংগ্রহে থাকা হাজারো দুর্লভ বই, গুরুত্বপূর্ণ সাময়িকী, আসবাবপত্র ঘূর্ণিঝড়-জলোচ্ছ্বাস থেকে রক্ষার জন্য আমাদের টেকসই একটি ভবনের দরকার। প্রতিষ্ঠার পর থেকে পাঠাগারটি এ পর্যন্ত তিনটি ঘূর্ণিঝড়ের সম্মুখীন হয়েছে। ২০১৪ সালে এক টর্নেডোর আঘাতে পাঠাগারটি লণ্ডভণ্ড হয়ে যায়। ২০১৬ সালে ঘূর্ণিঝড় ‘রোয়ানুর’ আঘাতে ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয় পাঠাগারটি। সর্বশেষ ২০২৩ সালের ২৪ অক্টোবর ঘূর্ণিঝড় ‘হামুন’-এর আঘাতে লণ্ডভণ্ড হয়ে যায় সবকিছু।

পাঠাগারের নিয়মিত সদস্য রেশমি জানান, আমি লাইব্রেরি সম্পর্কে কিছুই জানতাম না, আমার তেমন কোনো ধারণা ছিল না। কিন্তু একদিন সহপাঠীদের সাথে এই পাঠাগারে প্রবেশ করার পর একসাথে হাজারো বই দেখে নিজের মধ্যে এক ধরণের অনুভূতি তৈরি হয়। সেই অনুভূতি থেকে আমি পাঠাগারের সদস্য হই এবং বইয়ের সাথে আমার একটি সম্পর্ক তৈরি হয়।

পাঠাগারের নিয়মিত পাঠক নবম শ্রেণির ছাত্রী শারমিন আকতার জানান, পাঠাগারটির মাধ্যমে আমরা আলোর সন্ধান পেয়েছি। আমাদের এখানে পাঠ্যবই ছাড়া অন্য কোনো বইয়ের দেখা মিলতো না, মানুষের মাঝে ঐ রুচিবোধও ছিল না, এখানে দৈনিক পত্রিকা পড়া ছিল আকাশ কুসুম কল্পনা। এই পাঠাগারের ফলে আজ আমরা হাজারো বইয়ের দেখা পেয়েছি।

উপকূলীয় পাবলিক লাইব্রেরি আগামীতে শিক্ষা-সাহিত্য-সংস্কৃতি ও বহুমুখী জ্ঞানচর্চাকে বহুদূর এগিয়ে নিতে চায়। পাঠাগারটির প্রতিষ্ঠাতা সাঈফী আনোয়ারুল আজীমের সাথে কথা বলে একটি দুরদর্শী পরিকল্পনার কথা জানা যায়। তিনি জানান, পাঠাগার নিয়ে আমাদের সুদূর পরিকল্পনা আছে, আছে বিশাল লক্ষ্য। পাঠাগারটি একদিন সত্যিকার অর্থে বহুমুখী জ্ঞানের চারণক্ষেত্র হয়ে উঠুক সেই প্রত্যাশা নিয়ে কাজ করে যাচ্ছি।

তিনি আরও জানান, আমাদের উদ্যোগে সরকারের সংশ্লিষ্ট মহলের সাড়া দেওয়া দরকার। সচল গণপাঠাগার সমূহকে কীভাবে টিকিয়ে রাখা যায়, সে ব্যাপারে উদ্যোগ নেওয়া সরকারের একান্ত দায়িত্ব। পাঠাগারটি ২০১৭ সালে গণগ্রন্থাগার অধিদফতর থেকে নিবন্ধন লাভ করে। ৪ জন কর্মকর্তা-কর্মচারীর মাধ্যমে পরিচালিত হচ্ছে পাঠ কার্যক্রম। নিবন্ধিত পাঠকের সংখ্যা প্রায় ৩০০। প্রান্তিক জনপদের এই সচল পাঠাগারে দৈনিক ৩০-৩৫ জন পাঠক বই পড়তে আসেন।