ক্যান্সার চিকিৎসায় চট্টগ্রাম: ঢাকামুখী দৌঁড়ঝাঁপ, কতদিন?


চট্টগ্রামে ক্যান্সারের প্রকোপ দিন দিন বেড়েই চলেছে। প্রতিবছর নতুন নতুন রোগীর সংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। কিন্তু এ বর্ধিত রোগীর তুলনায় চিকিৎসা সেবার মান ও সুযোগ-সুবিধা সেভাবে বাড়েনি। ফলে ক্যান্সার আক্রান্ত রোগীরা সঠিক সময়ে সঠিক চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন, ভুগছেন নানাবিধ সমস্যায়।

গত বছর শুধু চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালের ক্যান্সার বিভাগেই (ক্লিনিক্যাল অনকোলজি ও রেডিওথেরাপি বিভাগ) চিকিৎসা নিয়েছেন প্রায় ১৯,৫৯৪ জন রোগী। এর মধ্যে নতুন আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ছিল ৫,৬৫8 জন, যা অত্যন্ত উদ্বেগজনক।

নতুন আক্রান্তদের মধ্যে পুরুষের সংখ্যা ৩,১৩৮ জন এবং মহিলার সংখ্যা ২,৫২০ জন। এছাড়া রেডিওথেরাপি নিয়েছেন ১,০৫১ জন, জরায়ু ক্যান্সারের ব্র্যাকিথেরাপি নিয়েছেন ২৩৮ জন, সিটি স্টিমুলেটর ১৬৫ জন এবং কেমোথেরাপি নিয়েছেন ২,৩৩৩ জন।

শুধু চমেক হাসপাতালই নয়, চট্টগ্রামের অন্যান্য সরকারি-বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকগুলোতেও ক্যান্সার রোগীর ভিড় ক্রমশ বাড়ছে। গত বছর চমেক হাসপাতালের বহির্বিভাগে স্তন ক্যান্সারের চিকিৎসা নিয়েছেন ৬১৪ জন, জরায়ু ক্যান্সারের চিকিৎসা নিয়েছেন ৪৪১ জন, হেড অ্যান্ড নেক ক্যান্সারের চিকিৎসা নিয়েছেন ৩৯৭ জন, কোলোরেক্টাল ক্যান্সারের চিকিৎসা নিয়েছেন ২০৯ জন, ফুসফুসের ক্যান্সারের চিকিৎসা নিয়েছেন ১৯৮ জন এবং অন্যান্য ক্যান্সারের চিকিৎসা নিয়েছেন ৬৬১ জন।

এই পরিসংখ্যান থেকেই স্পষ্ট যে, চট্টগ্রামে ক্যান্সার রোগীর সংখ্যা কতটা ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে। কিন্তু এই বিপুল সংখ্যক রোগীর জন্য চট্টগ্রামে প্রয়োজনীয় রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসার সুযোগ-সুবিধা কতটুকু? উত্তরটি অত্যন্ত হতাশাজনক।

ক্যান্সার চিকিৎসার প্রথম এবং গুরুত্বপূর্ণ ধাপ হলো সঠিক রোগ নির্ণয়। কিন্তু চট্টগ্রাম অঞ্চলে ক্যান্সার নির্ণয়ের জন্য প্রয়োজনীয় অত্যাধুনিক প্রযুক্তির অভাব প্রকট। ক্যান্সার নির্ণয়ের আধুনিক প্রযুক্তি, যেমন পেট-সিটি (পজিট্রন ইমিশন টোমোগ্রাফি) ল্যাব চট্টগ্রামে নেই। ফলে রোগীদের ঢাকায় ছুটতে হচ্ছে।

এছাড়া, সরকারি বা বেসরকারি পর্যায়ে গ্রহণযোগ্য কোনো মলিকিউলার ল্যাবও নেই চট্টগ্রামে। ফলে রোগীদের কোন ধরনের ক্যান্সার হয়েছে, তা শতভাগ নিশ্চিত হওয়ার জন্য নমুনা পাঠাতে হয় ঢাকা কিংবা দেশের বাইরে। এতে একদিকে যেমন রোগীদের মূল্যবান সময় নষ্ট হচ্ছে, অন্যদিকে বাড়ছে খরচের বোঝা। অনেক দরিদ্র রোগীর পক্ষে এই ব্যয় বহন করা অসম্ভব হয়ে পড়ে।

চট্টগ্রামে সরকারি পর্যায়ে ক্যান্সার চিকিৎসার একমাত্র প্রতিষ্ঠান চমেক হাসপাতালের ক্যান্সার বিভাগ। এই বিভাগের সক্ষমতা আগের চেয়ে কিছুটা বাড়লেও, ক্যান্সারের আধুনিক চিকিৎসার তুলনায় তা এখনও অপ্রতুল।

চমেক হাসপাতালে বর্তমানে প্রতিদিন গড়ে ১৩০ জন রোগী রেডিওথেরাপি নিতে পারছেন, কেমোথেরাপি নিচ্ছেন গড়ে ৩৫ জন এবং প্রতি সপ্তাহে গড়ে ১৫ জন নারী জরায়ু ক্যান্সারের চিকিৎসার জন্য ব্রেকিথেরাপি নিতে পারছেন।

কিন্তু, ক্যান্সারের আধুনিক চিকিৎসার জন্য এখানে মলিকিউলার ল্যাব স্থাপন জরুরি। পাশাপাশি মাইক্রোওয়েভ অ্যাভলেশন মেশিন, বোনমেরু ট্রান্সপ্লান্টেশন সেন্টার, অনকো ইমেজিং, ইন্টারভেনশনাল প্যাথলজিস্টও প্রয়োজন।

বর্তমানে বিভাগে অনকো নার্সের সংখ্যা মাত্র ১২ জন। অথচ যে হারে রোগীর চাপ বাড়ছে, তাতে অন্তত ১৫ থেকে ২০ জন অনকো নার্স প্রয়োজন।

চট্টগ্রামে ক্যান্সার চিকিৎসার ক্ষেত্রে কিছু আশার আলোও দেখা যাচ্ছে। চমেক হাসপাতালে নির্মাণাধীন ১৮০ শয্যার বিশেষায়িত ক্যান্সার ইউনিট এই অঞ্চলের ক্যান্সার চিকিৎসায় নতুন দিগন্ত উন্মোচন করবে বলে আশা করা যায়।

তবে, শুধু অবকাঠামোগত উন্নয়নই যথেষ্ট নয়। ক্যান্সার চিকিৎসার জন্য প্রয়োজন দক্ষ জনবল, অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি এবং প্রয়োজনীয় ল্যাবরেটরি সুবিধা।

আজ বিশ্ব ক্যান্সার দিবস। এই দিবসে আমাদের অঙ্গীকার হোক, চট্টগ্রামে ক্যান্সার রোগীদের জন্য উন্নত চিকিৎসা ব্যবস্থা নিশ্চিত করা। অত্যাধুনিক ল্যাব স্থাপন, প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি সরবরাহ, এবং দক্ষ জনবল নিয়োগের মাধ্যমে এই অঞ্চলের রোগীদের দুর্ভোগ লাঘব করা সম্ভব।

সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, বিত্তবান ব্যক্তি এবং সমাজের সকল স্তরের মানুষকে এগিয়ে আসতে হবে। সম্মিলিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে ক্যান্সার চিকিৎসায় স্বয়ংসম্পূর্ণ চট্টগ্রাম গড়ে তোলা সম্ভব।

ক্যান্সার প্রতিরোধে জনসচেতনতা বৃদ্ধিও অত্যন্ত জরুরি। নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা, স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন এবং ক্যান্সারের প্রাথমিক লক্ষণগুলো সম্পর্কে জ্ঞান থাকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

আসুন, আমরা সবাই মিলে ক্যান্সার প্রতিরোধে সোচ্চার হই এবং চট্টগ্রামে ক্যান্সার চিকিৎসায় নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করি।

লেখক : ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক, একুশে পত্রিকা।