স্কুল কর্মচারীর রাজকীয় বিদায়


বিদ্যালয়ের শেষ ঘণ্টা বাজিয়ে কর্মজীবনের ইতি টানলেন নুরুল আবছার। চার পুরুষের দীর্ঘ পথচলার পর মিরসরাই উপজেলার শতবর্ষী জোড়াগঞ্জ আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয় থেকে অবসর নিলেন তিনি। পরিবারে তিনি চতুর্থ ব্যক্তি যিনি এই বিদ্যালয়ে কর্মচারীর দায়িত্ব পালন করেছেন। তার প্রপিতামহ বাদশা মিয়া, দাদা ছেরাজুল হক এবং বাবা মুন্সি মিয়ার পর নুরুল আবছার এই বিদ্যালয়ে ১২ বছর বয়সে যোগদান করেন। তাঁর ৪৮ বছরের কর্মজীবনে শিক্ষার্থীরা তাকে ‘আবছার কাকু’ এবং শিক্ষকরা ‘আবছার ভাই’ বলে সম্বোধন করতেন।

রবিবার (২ ফেব্রুয়ারি) বিদ্যালয়ের শ্রেণীকক্ষে এক বিশেষ বিদায় সংবর্ধনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। বিদ্যালয় পরিচালনা পরিষদের সভাপতি মোহাম্মদ আবদুল হাইয়ের সভাপতিত্বে এবং শিক্ষক নিতাই দাশের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন প্রধান শিক্ষক সাইফুল আলম, শিক্ষক আছিউর রহমান, রেজাউল করিম, তারেক নিজামী, বিদ্যালয় পরিচালনা পরিষদের অভিভাবক সদস্য আবু সুফিয়ান চৌধুরী এবং শিক্ষার্থীরা।

শিক্ষার্থীরা তাদের প্রিয় ‘আবছার কাকু’র দীর্ঘ ও কর্মময় জীবনের বিভিন্ন দিক তুলে ধরেন। শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা তাদের বক্তব্যে নুরুল আবছারের সততা, নিষ্ঠা ও আন্তরিকতার প্রশংসা করেন। তারা বলেন, নুরুল আবছার শুধু একজন কর্মচারী ছিলেন না, ছিলেন একজন বিশ্বস্ত বন্ধু ও পথপ্রদর্শক।

অনুষ্ঠানে নুরুল আবছার তার দীর্ঘ কর্মজীবনের স্মৃতিচারণ করেন এবং বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে ধন্যবাদ জানান। তিনি বলেন, “আমি ১৬০ টাকা বেতনে এই স্কুলে চাকরি শুরু করি। আজ আমার বিদায়ের মধ্য দিয়ে আমাদের ৪ প্রজন্মের কর্মচারী হিসেবে চাকরি জীবনের সমাপ্তি হলো। আমার চাকরি জীবনে অনেক শিক্ষক, কর্মচারী এই স্কুলে চাকরি করেছেন, চাকরি ছেড়েছেন। তবে আমাকে যেভাবে বিদায় সংবর্ধনা দিয়েছে তা আমি আগে কখনো দেখিনি। আমি বর্তমান প্রধান শিক্ষক সাইফুল আলমসহ সকল শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের প্রতি কৃতজ্ঞ।”

বিদ্যালয়ের শিক্ষক মোশাররফ হোসেন বলেন, “আমাদের স্কুলের সকলের প্রিয় নুরুল আবছার ভাই তার জীবনের বেশির ভাগ সময় এই স্কুলের জন্য দিয়ে গেছেন। তিনি সততার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেছেন। এই স্কুলের প্রতিটি ধূলিকণা নুরুল আবছারের অবদানকে স্মরণ করবে। তার অবসরকালীন সময় ভালোভাবে কাটুক এই কামনা করি।”

বিদ্যালয় পরিচালনা পরিষদের সভাপতি মোহাম্মদ আবদুল হাই বলেন, “আমাদের বিদ্যালয়ের কর্মচারী নুরুল আবছার তার জীবনের মূল্যবান সময়টুকু এই বিদ্যালয়ে কাটিয়েছেন। তার বর্ণাঢ্য বিদায় অনুষ্ঠানের মাঝেও আমাদের অনেক কিছু শেখার আছে। এখানে শেখার আছে যে বিষয়টি সেটা হলো ভালো কাজ করলে সততার সাথে চললে তার কখনো না কখনো স্বীকৃতি মেলে। অবশেষে নুরুল আবছারও তার ভালোভাবে কাটানো কর্মজীবনের স্বীকৃতি পেলেন।”

বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সাইফুল আলম বলেন, “১২ বছর বয়স থেকে নুরুল আবছার এই স্কুলে কর্মচারী পদে যোগ দেন। আমার খুবই বিশ্বস্ত তিনি। তিনি এতটাই বিশ্বস্ত যে বিদ্যালয়ের সব লেনদেন তিনিই করতেন। অনেক সময় ৮-১০ লাখ টাকা ব্যাংকে জমা দেওয়ার জন্য নিয়ে যেতেন আবার বিদ্যালয়ের প্রয়োজনে ব্যাংক থেকে ৮-১০ লাখ টাকা তুলে আনতেন। আমি এই বিদ্যালয়ে পাঠদান করছি প্রায় ১৮ বছর। এর মধ্যে তিনি কখনো ১ টাকাও এদিক-সেদিক করেননি। এ রকম বিশ্বস্ত কর্মচারী আমরা আর পাব কি না জানি না। তিনি বেশি শিক্ষিত না হলেও প্রতিটি ফাইলপত্র অত্যন্ত দক্ষতার সাথে দেখভাল করতেন।”

সংবর্ধনা শেষে নুরুল আবছারকে ঘোড়ার গাড়িতে করে রাজকীয় ভাবে বিদায় জানানো হয়। স্কাউট দলের সদস্যরা বাদ্যের তালে তালে এবং বিদ্যালয়ের শত শত শিক্ষার্থী সারিবদ্ধভাবে তাকে জোড়াগঞ্জ বাজার প্রদক্ষিণ শেষে বাড়ি পৌঁছে দেন।