মঙ্গলবার, ২১ জানুয়ারি ২০২৫, ৮ মাঘ ১৪৩১

আইএমএফের শর্ত মানতে গিয়ে কি আত্মঘাতী হচ্ছে সরকার?

একুশে প্রতিবেদক | প্রকাশিতঃ ২১ জানুয়ারী ২০২৫ | ৯:০০ পূর্বাহ্ন


আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিলের (আইএমএফ) ঋণের শর্ত বাস্তবায়নের জেরে ক্রমশঃ জটিল হচ্ছে দেশের অর্থনীতি। জনজীবনে নেমে আসছে ভোগান্তি, ক্ষোভ বাড়ছে ব্যবসায়ী ও সাধারণ জনগণের মধ্যে। ঋণের শর্ত পূরণে সরকার যেসব পদক্ষেপ নিয়েছে তার প্রভাবে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য ও সেবার মূল্য লাগামহীনভাবে বেড়ে চলেছে। বৃদ্ধি পেয়েছে ব্যবসা-বাণিজ্যের খরচ, টাকার মান ক্রমাগত কমে যাচ্ছে, লাগামছাড়া মূল্যস্ফীতিতে নাভিশ্বাস উঠেছে সাধারণ মানুষের। নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে শিল্প ও ব্যবসা-বাণিজ্যের ওপর। এ পরিস্থিতিতে ব্যবসায়ীসহ সর্বস্তরের মানুষের মনে প্রশ্ন, আইএমএফের এই শর্ত মেনে চলা কি আসলেই জরুরি?

সরকার ঋণের সুদ হার বৃদ্ধি, টাকার প্রবাহ হ্রাস, ডলারের দাম বৃদ্ধি, খেলাপি ঋণের সংজ্ঞা আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত করা, গ্যাসের দাম বৃদ্ধির পদক্ষেপ, ভ্যাটের আওতা ও হার বৃদ্ধি এবং ভর্তুকি কমানো সহ আইএমএফের নানামুখী শর্ত বাস্তবায়ন করছে। এসকল শর্ত বাস্তবায়নের ফলে জনজীবনে নেমে আসছে দুর্ভোগ। ইতোমধ্যে ভ্যাট প্রত্যাহারের দাবিতে বিভিন্ন সংগঠন আন্দোলন শুরু করেছে এবং এই আন্দোলন ক্রমশঃ তীব্র হচ্ছে। এ অবস্থায় সরকার কিছু খাত থেকে ভ্যাট প্রত্যাহারের বিষয়ে ইতিবাচক চিন্তা করছে বলে জানা গেছে।

বৈশ্বিক মন্দার প্রভাব মোকাবিলায় ২০২৩ সালের জানুয়ারিতে ৪৭০ কোটি ডলারের ঋণ চুক্তির পর থেকেই শর্ত বাস্তবায়ন শুরু করে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকার। ঋণ গ্রহণের পরও শর্ত পূরণে দফায় দফায় বাড়ানো হয়েছে গ্যাস, বিদ্যুৎ, সারসহ বিভিন্ন খাতের দাম। এর ফলে পণ্যমূল্য বৃদ্ধি পেয়ে জনজীবনে নেমে আসে চরম ভোগান্তি।

গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের আগ পর্যন্ত আইএমএফের শর্ত বাস্তবায়ন অব্যাহত ছিল। এ সময় ব্যবসায়ী ও রাজনৈতিক দলগুলো শর্ত বাস্তবায়নের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছিল। যদিও উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ ও অর্থনীতিকে শৃঙ্খলার মধ্যে আনার কথা বলে এসব শর্ত বাস্তবায়ন করা হচ্ছিল, বাস্তবতা হলো মূল্যস্ফীতি না কমে বরং বেড়েছে, অর্থনৈতিক সংকটও কাটেনি বরং তা আরও প্রকট হয়েছে।

আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারও আইএমএফের শর্ত আরও কঠোরভাবে বাস্তবায়ন শুরু করে। এর ফলে মূল্যস্ফীতির হার না কমে বরং আরও বেড়েছে। তবে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ব্যাংক খাতের ব্যাপক লুটপাট ও অর্থপাচার অনেকাংশে কমে যাওয়ায় বাজারে ডলারের সংকট কিছুটা হ্রাস পেয়েছে। কিন্তু অন্যান্য অর্থনৈতিক সূচকে সংকট আরও ঘনীভূত হয়েছে।

গত তিন অর্থবছর ধরে সংকোচনমুখী মুদ্রানীতি অনুসরণ করা হচ্ছে। গত ৫ আগস্ট বর্তমান সরকার ক্ষমতা নেওয়ার পর মুদ্রানীতিকে আরও কঠোর করা হয়েছে। এর ফলে বাজারে টাকার প্রবাহ কমানো হয়েছে। ফলে বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবাহ কমে প্রবৃদ্ধি মাত্র দেড় শতাংশে নেমেছে। ঋণের সুদ হার ৯ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১৬ শতাংশ করা হয়েছে। ডলারের দাম ৮৬ টাকা থেকে বেড়ে ১১৮ টাকা হয়েছে (আমদানিতে ১৩০-১২২ টাকা)। টাকার মান কমেছে। এসবের প্রভাবে পণ্য ও সেবার দাম বৃদ্ধি পেয়েছে। বাজারে চাহিদা অনুযায়ী ডলার মিলছে না। আমদানি খাতে স্থবিরতা বিরাজ করছে।

খেলাপি ঋণের সংজ্ঞা আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত করা হচ্ছে, যা আগামী এপ্রিল থেকে কার্যকর হবে। এর ফলে খেলাপি ঋণের পরিমাণ আরও বৃদ্ধি পাবে। গত সেপ্টেম্বর পর্যন্ত খেলাপি প্রায় তিন লাখ কোটি টাকার কাছাকাছি চলে গেছে। ডিসেম্বরে তা আরও বাড়তে পারে। এখন পর্যন্ত খেলাপি ঋণের হার ১৭ শতাংশ, যা বেড়ে ৩০ শতাংশে পৌঁছতে পারে। এ অবস্থায় উদ্যোক্তারা খেলাপি ঋণের আন্তর্জাতিক মানের সংজ্ঞার বাস্তবায়ন পিছিয়ে দিতে বলেছেন।

কারণ বৈশ্বিক মন্দা ও মূল্যস্ফীতির প্রভাবে ভোক্তার ক্রয়ক্ষমতা কমায় পণ্যের বিক্রি কমে গেছে। ঋণ পরিশোধের সক্ষমতা হ্রাস পেয়েছে। এ অবস্থায় নতুন নিয়ম কার্যকর হলে ব্যবসায়ীরা নতুন করে খেলাপি হয়ে পড়বেন, তখন নতুন ঋণ নিতে পারবেন না। ফলে ব্যবসার গতি থমকে যাবে। ঋণের সুদ হার বৃদ্ধি পাওয়ায় শিল্পের খরচ বেড়ে গেছে। শিল্প ও ব্যবসা-বাণিজ্য টিকিয়ে রাখা কঠিন হয়ে পড়েছে।

নতুন শিল্পে গ্যাসের দাম শতভাগের বেশি বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। এর ফলে গ্যাসনির্ভর নতুন শিল্প স্থাপন বন্ধ হয়ে যাবে। কর্মসংস্থানে নেতিবাচক প্রভাব আরও বাড়বে। গ্যাসের নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহ না থাকায় চালু শিল্পগুলো গ্যাস সংকটে ভুগছে।

অর্থনৈতিক মন্দার কারণে সরকারের রাজস্ব আয় কমে গেছে। সরকার ঋণ নিয়ে চলছে। আইএমএফের শর্ত বাস্তবায়ন করতে সরকার ব্যাংক থেকে ঋণ নিচ্ছে কম। তারল্য সংকটের কারণেও ঋণ নেওয়া কমিয়েছে। ফলে উন্নয়ন প্রকল্পে সরকারের ব্যয় কমে গেছে। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। রাজস্ব আয় বাড়াতে ভ্যাটের আওতা ও হার বৃদ্ধি করা হয়েছে। এর ফলে ক্ষুব্ধ ভোক্তা ও ব্যবসায়ীরা। ভ্যাট প্রত্যাহারের দাবি উঠেছে। ভর্তুকি কমানোর ফলে বিভিন্ন পণ্য ও সেবার দাম বৃদ্ধি পেয়েছে। জনজীবনে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। মানুষের জীবনযাত্রার মান কমে গেছে।

আইএমএফ বিদ্যুতের দামও বাড়াতে বলেছে। কিন্তু সরকার থেকে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে তারা এর দাম বাড়াবে না। কারণ এখন বিদ্যুতের দাম বাড়ালে মূল্যস্ফীতির হারে আরও চাপ বাড়বে। কারণ সরকার চাচ্ছে এখন মূল্যস্ফীতির ঊর্ধ্বগতি কমাতে।

গত নভেম্বরের তুলনায় ডিসেম্বরে মূল্যস্ফীতির হার কিছুটা কমেছে। তবে তা কমার কারণ হচ্ছে শীতকালে সবজিসহ পণ্যের সরবরাহ বৃদ্ধি পাওয়া। কিন্তু এখন ভর মৌসুমেও চালের দাম বাড়ছে। ভ্যাটের প্রভাবেও পণ্যের দাম বাড়তে শুরু করেছে। এতে আগামীতে মূল্যস্ফীতিতে আরও চাপ বাড়তে পারে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে বলা হয়েছে, আগামী জুনের মধ্যে তারা মূল্যস্ফীতির হার ৭ শতাংশের মধ্যে নামিয়ে আনতে চায়। এরপর থেকে ঋণের সুদের হার কমানো হবে।

আইএমএফের সব শর্ত বাস্তবায়ন না করার বিষয়টি সংস্থাটি ভালোভাবে নিচ্ছে না। আগামী মাসে ঋণের কিস্তি কমিয়ে দিয়েছে। ফেব্রুয়ারিতে কিস্তি ছাড় করতে পারে।

সরকার আইএমএফের কাছে আরও ৩০০ কোটি ডলারের সহযোগিতা চেয়েছে। এ ব্যাপারে আইএমএফ এখন পর্যন্ত কিছু বলেনি। আগামী মাসে আইএমএফের নির্বাহী কমিটির সভায় এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত হতে পারে।

এমতাবস্থায়, শিল্প, ব্যবসা-বাণিজ্য রক্ষা এবং জনজীবনে স্বস্তি ফেরাতে আইএমএফের শর্ত থেকে সরে এসে উদ্যোক্তা ও ভোক্তার অনুকূল পরিবেশ তৈরির দাবি উঠেছে।