বন্যা নিয়ন্ত্রণ প্রকল্পের নামে লুটপাটের খেলা!


চট্টগ্রাম মহানগরীকে বন্যার হাত থেকে রক্ষা করার লক্ষ্যে গৃহীত বহুল আকাঙ্ক্ষিত ‘চট্টগ্রাম মহানগরীর বন্যা নিয়ন্ত্রণ, জলমগ্নতা নিরসন ও নিষ্কাশন উন্নয়ন’ প্রকল্পটি বাস্তবায়নে ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে।

প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হওয়ার ছয় মাস পর সংশোধন প্রস্তাব দেওয়া, খরচ কমানোর কথা বলে উন্নয়ন পরিকল্পনায় ব্যাপক পরিবর্তন আনা, ফ্ল্যাড ও রিটেইনিং ওয়াল নির্মাণে ব্যয় বৃদ্ধিসহ নানা অনিয়মের অভিযোগ পাওয়া গেছে। এসব অনিয়মের ফলে প্রকল্পের বাস্তবায়ন ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা।

সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) চট্টগ্রাম চ্যাপ্টারের সাধারণ সম্পাদক আখতার কবির চৌধুরী এ অনিয়মের তীব্র নিন্দা জানিয়ে বলেন, “চট্টগ্রামের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এ প্রকল্পে এমন নিয়মের ব্যত্যয় কাম্য নয়। কেননা একটু বৃষ্টি হলেই চট্টগ্রাম শহর ডুবে যায়। ড্রেনে পড়ে মানুষ মারাও যাচ্ছেন। সেখানে একটি প্রকল্প বছরের পর বছর চলবে, কিন্তু শেষ হবে না, আবার কার্যকর বাস্তবায়নও হবে না, এটা মেনে নেওয়া যায় না।”

তিনি প্রকল্প বাস্তবায়নে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার দাবি জানান।

গত ১৮ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত চট্টগ্রাম মহানগরীর বন্যা নিয়ন্ত্রণ, জলমগ্নতা নিরসন ও নিষ্কাশন উন্নয়ন প্রকল্পের প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির (পিইসি) সভায় এসব অনিয়মের চিত্র উঠে আসে। সভা থেকে এসব প্রশ্নের ব্যাখ্যাসহ সংশোধিত প্রকল্প প্রস্তাব নতুন করে পাঠাতে বলা হয়েছে।

প্রকল্পটি ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে ২০২২ সালের জুন পর্যন্ত বাস্তবায়নের কথা ছিল। দুই দফায় মেয়াদ বাড়িয়ে ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত করা হলেও এখন আবার দুই বছর বাড়িয়ে ২০২৬ সালের জুন পর্যন্ত করার প্রস্তাব করা হয়েছে। প্রকল্পের অনুমোদিত ব্যয় ছিল ১ হাজার ৬২০ কোটি টাকা। এখন ৫৫ কোটি ৯৬ লাখ টাকা কমিয়ে সংশোধিত ব্যয় ধরা হয়েছে ১ হাজার ৫৬৪ কোটি ৭৭ লাখ টাকা।

পরিকল্পনা কমিশনের সূত্রে জানা গেছে, রিটেইনিং ওয়াল নির্মাণে প্রায় শতভাগ অর্থ ব্যয় হওয়ার পরও এই খাতে ব্যয় বৃদ্ধি করে ২৭৮ কোটি ৬৪ লাখ ১৪ হাজার টাকা প্রস্তাব করা হয়েছে। যা মূল অনুমোদিত ব্যয়ের চেয়ে প্রায় ২৫৩ দশমিক ৩১ শতাংশ বেশি।

মূল অনুমোদিত ডিপিপিতে ফ্ল্যাডওয়াল নির্মাণ কাজ ১৮ দশমিক ৯৬৫ কিলোমিটারের জন্য ৮১০ কোটি ২৬ লাখ টাকার সংস্থান ছিল। প্রকল্পের ৫ বছর মেয়াদে মাত্র শূন্য দশমিক ৬০০ কিলোমিটার ফ্ল্যাডওয়াল নির্মাণের জন্য এর মধ্যেই ১৩৯ কোটি ৫০ লাখ টাকা ব্যয় করা হয়েছে।

এখন নতুন করে এই অংশের কাজের পরিমাণ কমিয়ে ৬ দশমিক ৮৮৫ কিলোমিটার ফ্ল্যাডওয়াল নির্মাণের জন্য ৪২৭ কোটি ৭০ লাখ টাকা ব্যয় প্রস্তাব করা হয়েছে। এই খাতে ইউনিট প্রতি ব্যয় ১৪৫ দশমিক ৪০ শতাংশ বৃদ্ধি করা হয়েছে।

মূল অনুমোদিত প্রকল্পে ২৩টি রেগুলেটর নির্মাণের কথা থাকলেও তা কমিয়ে ২১টি করার প্রস্তাব করা হয়েছে। কিন্তু ইতোমধ্যে এ খাতে অনুমোদিত ১৭৮ কোটি টাকার মধ্যে ১৫১ কোটি ৪৮ লাখ টাকা ব্যয় করা হয়। এই অর্থে মাত্র ৩টি রেগুলেটরের কাজ শেষ করা হয়েছে।

কিন্তু কাজ কমলেও এ খাতে এখন প্রস্তাব করা হয়েছে ২৮৮ কোটি ৩৯ লাখ টাক। যা মূল অনুমোদিত ব্যয়ের চেয়ে ১৭৭ শতাংশ বেশি।

এ বিষয়ে পরিকল্পনা কমিশনের কৃষি, পানিসম্পদ ও পল্লী প্রতিষ্ঠান বিভাগের প্রধান (অতিরিক্ত সচিব) ছায়েদুজ্জামান বলেন, প্রকল্পটিতে যেসব অনিয়মের ঘটনা ঘটেছে সেগুলো সংশোধন করতে বলা হয়েছে।

সাবেক পরিকল্পনা সচিব মামুন-আল-রশীদ বলেন, এ প্রকল্পে পরিকল্পনা কমিশন যেসব বিষয় তুলে ধরেছে এতে শুধু অনিয়ম বললে ভুল হবে, এখানে গুরুতর অনিয়ম হয়েছে।

চট্টগ্রাম পানি উন্নয়ন বোর্ডের পওর বিভাগ-১ এর নির্বাহী প্রকৌশলী শওকত ইবনে সাহীদ বলেন, এ প্রকল্পটি আমরা সরাসরি বাস্তবায়ন করছি না। এটি সেনাবাহিনীকে ডেলিগেট করে দেওয়া হয়েছে। এরপরও বলতে পারি এটি বাস্তবায়নে কোনো অনিয়মের ঘটনা ঘটেনি।

প্রকল্প পরিচালক কর্নেল মোহাম্মদ মহিউদ্দিন বলেন, এ বিষয়ে কথা বলবে পানি উন্নয়ন বোর্ড বা সংশ্লিষ্ট পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়।

পরিকল্পনা কমিশন সূত্র জানায়, প্রকল্পটির মেয়াদ ৩০ জুন শেষ হয়ে গেছে। সরকারের এ সংক্রান্ত নীতিমালা অনুসারে প্রকল্প সংশোধনের ক্ষেত্রে অনুমোদিত মেয়াদ শেষ হওয়ার অন্তত ৩ মাস আগে সংশোধনের জন্য প্রক্রিয়াকরণ করতে হয়।

সুজন নেতা আখতার কবির চৌধুরী আরও বলেন, “চট্টগ্রামের পাহাড় কাটা বন্ধ না হলে জলাবদ্ধতা সংক্রান্ত কোনো প্রকল্পই কার্যকর হবে না। কারণ পাহাড়গুলো বালু মাটির হওয়ায় যখন কাটা হয় তখন একটু বৃষ্টি হলেই বালু শহরে নেমে আসে। খাল, ড্রেন সব ভরাট হয়ে যায়।”