চট্টগ্রাম বন্দর, বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রাণকেন্দ্র। অথচ, একের পর এক বন্দর টার্মিনাল ও স্থাপনা চলে যাচ্ছে বিদেশি কোম্পানির হাতে। বিগত সরকারের আমলে শুরু হওয়া ‘স্বার্থ পরিপন্থি’ চুক্তি ও সমঝোতা বর্তমান সরকারও এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। এ নিয়ে চট্টগ্রামের ব্যবসায়ী ও বন্দর শ্রমিকদের মধ্যে তীব্র ক্ষোভ বিরাজ করছে।
সর্বশেষ, বন্দরের সবচেয়ে বেশি রাজস্ব আহরণকারী ও বৃহৎ নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনাল (এনসিটি) দুবাই পোর্টের হাতে তুলে দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। আগামী ৬ মাস থেকে ১ বছরের মধ্যে এই প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার পরিকল্পনা করছে সরকার।
এর আগে, গত বছরের ১১ জুন পতেঙ্গা কনটেইনার টার্মিনাল (পিসিটি) পরিচালনার দায়িত্ব ২২ বছরের জন্য সৌদি মালিকানাধীন অপারেটর প্রতিষ্ঠান রেড-সি গেটওয়ে টার্মিনাল ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেডের (আরএসজিটিআই) হাতে তুলে দেওয়া হয়।
চট্টগ্রাম বন্দরের এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছে শ্রমিক সংগঠনগুলো। তাদের শঙ্কা, চালু টার্মিনালগুলো বিদেশিদের হাতে চলে গেলে হাজার হাজার দক্ষ শ্রমিক ও বন্দর কর্মচারী বেকার হয়ে পড়বে। দেশ থেকে চলে যাবে বিপুল বৈদেশিক মুদ্রা। গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনার নিয়ন্ত্রণ বিদেশিদের হাতে চলে গেলে তা দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের জন্যও হুমকি হতে পারে।
এই ‘হঠকারী’ সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসার জন্য সংগঠনগুলো নৌমন্ত্রণালয় ও বন্দর কর্তৃপক্ষ বরাবর স্মারকলিপি দিয়েছে। অন্যথায় বৃহত্তর আন্দোলনের হুমকিও দিয়েছেন শ্রমিকরা।
এনসিটি, বন্দরের মূল আয়ের ৬০ ভাগ জোগান দেয়। ২০০১ সালে এর নির্মাণ কাজ শুরু হয়। বন্দর কর্তৃপক্ষ নিজস্ব তহবিল থেকে ২ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে এই টার্মিনাল নির্মাণ করে। ২০০৭ সালে চালু হওয়া এই টার্মিনাল ১ হাজার মিটার দৈর্ঘ্য ও ২৬ হেক্টর জায়গার উপর অবস্থিত।
আধুনিক যন্ত্রপাতি সমৃদ্ধ এনসিটি বন্দরের উৎপাদনশীলতা বহুগুণ বৃদ্ধি করেছে। ২০০৭ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত এই টার্মিনালে ১ কোটি ১৮ লাখ ৬৩ হাজার টিইইউএস কনটেইনার হ্যান্ডলিং হয়েছে। জাহাজের গড় অবস্থান সময় ১০-১২ দিন থেকে ২-৩ দিনে নেমে এসেছে। বিশ্বের ১০০ উন্নত বন্দরের তালিকায় চট্টগ্রাম বন্দর এখন ৫৮তম।
অথচ, ২০১৯ ও ২০২৩ সালে এনসিটি পরিচালনার জন্য দরপত্র আহ্বান করা হলেও সরকারের ঘনিষ্ঠ এক ব্যবসায়ীর নির্দেশে নৌমন্ত্রণালয় তা স্থগিত করে। বর্তমান দেশীয় অপারেটর প্রতিষ্ঠান সাইফ পাওয়ারটেক ডিপিএম পদ্ধতিতে ৬ মাসের জন্য বর্ধিত সময়ের জন্য কাজ পরিচালনা করছে। এরপর আর মেয়াদ বাড়ানো হবে না এবং এনসিটি পরিচালনার দায়িত্ব বিদেশি কোম্পানির হাতে তুলে দেওয়া হতে পারে।
২০২৩ সালের ১২ জুন সাবেক প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব এম তোফাজ্জল হোসেন মিয়ার নেতৃত্বে বাংলাদেশ-দুবাই জয়েন পিপিপি প্ল্যাটফরমের সভায় দুবাই পোর্টকে এনসিটি নেওয়ার জন্য প্রস্তাব করা হয়।
অন্যদিকে, পিসিটি নির্মাণে বন্দরের তহবিল থেকে প্রায় দুই হাজার কোটি টাকা খরচ করা হয়। ৩ থেকে ৪ লাখ টিইইউএস কনটেইনার হ্যান্ডলিংয়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল এই টার্মিনালে।
কিন্তু, পিপিপির আওতায় ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে সৌদি প্রতিষ্ঠান আরএসজিটিআই-এর সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষর করে বিগত সরকার। চুক্তি অনুযায়ী, প্রতিটি কনটেইনার উঠানো-নামানোর জন্য বন্দর কর্তৃপক্ষ পাবে মাত্র ১৮ ডলার, আর বিদেশি প্রতিষ্ঠানটি নিয়ে যাবে ৭০ থেকে ৮০ ডলার।
শ্রমিক নেতারা বলছেন, পিসিটি বিদেশিদের হাতে চলে যাওয়ায় বন্দরের শ্রমিক-কর্মচারীদের কাজের সুযোগ সংকুচিত হয়েছে। এনসিটিও চলে গেলে অন্তত ৭ হাজার শ্রমিক-কর্মচারী জীবিকা হারাবেন।
এনসিটির আশপাশে নৌবাহিনীর সামরিক ঘাঁটিসহ গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা রয়েছে। বিদেশিদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা হলে দেশের সার্বভৌমত্ব ও নিরাপত্তা ঝুঁকি তৈরি হবে।
পরিশেষে বলা যায়, চট্টগ্রাম বন্দরের টার্মিনাল ও স্থাপনা বিদেশিদের হাতে তুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত দেশের অর্থনীতির জন্য আত্মঘাতী। এই সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা না করলে, দেশের স্বার্থ হুমকির মুখে পড়বে এবং শ্রমিক অসন্তোষ আরও বৃদ্ধি পাবে।
লেখক : ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক, একুশে পত্রিকা।