বালুখেকোদের গ্রাসে বিপন্ন দেশ, রুখে দাঁড়ানোর এখনই সময়

বাংলাদেশের নদীমাতৃক পরিচয় আজ হুমকির মুখে। লোভী, ক্ষমতাবান, অর্থপিপাসু একটি গোষ্ঠী, যারা ‘বালুখেকো’ নামে পরিচিত, তাদের বেপরোয়া থাবায় ক্ষতবিক্ষত আমাদের নদ-নদী, বিপন্ন আমাদের পরিবেশ, হুমকিতে জনজীবন। খবরের কাগজে চোখ রাখলেই ভেসে ওঠে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে অবৈধভাবে বালু উত্তোলনের ভয়াবহ চিত্র। নদী থেকে, খাল থেকে, যেখানে-সেখানে, দিনদুপুরে, প্রশাসনের নাকের ডগায় চলছে এই লুটপাট। লাভ হচ্ছে গুটিকয়েক প্রভাবশালী ব্যক্তির, কিন্তু অপরিসীম ক্ষতি হচ্ছে আমাদের দেশের, দেশের মানুষের।

বালু, আপাতদৃষ্টিতে তুচ্ছ মনে হলেও, নদীর বাস্তুতন্ত্রে এর ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অপরিকল্পিতভাবে বালু উত্তোলন নদীর তলদেশের গঠন পরিবর্তন করে ফেলে, যার ফলে দেখা দেয় নানাবিধ সমস্যা। নদীর তলদেশ থেকে অতিরিক্ত বালু উত্তোলনের ফলে নদীর তীর দুর্বল হয়ে পড়ে। ফলে দেখা দেয় তীব্র ভাঙন।

প্রতিবছর নদীগর্ভে বিলীন হচ্ছে হাজার হাজার একর ফসলি জমি, বসতভিটা, স্কুল, কলেজ, মসজিদ, মন্দির, রাস্তাঘাট। সর্বস্ব হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে পড়ছে অসংখ্য পরিবার। নদীর তলদেশের গঠন পরিবর্তন হয়ে যাওয়ায় নদীর গতিপথ পরিবর্তিত হয়। অনেকসময় নদীর স্রোতের ধাক্কা সরাসরি সেতুর পিলারে আঘাত হানে। ফলে সেতুর স্থায়িত্ব হুমকির মুখে পড়ে। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে বেশ কিছু সেতু ইতিমধ্যেই ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে। যেকোনো সময় ঘটতে পারে ভয়াবহ দুর্ঘটনা। বালু উত্তোলনের ফলে নদীর পানি ঘোলাটে হয়ে যায়। এতে সূর্যের আলো পানির তলদেশে পৌঁছাতে পারে না। ফলে জলজ উদ্ভিদ ও প্রাণীর জীবনচক্র ব্যাহত হয়। মাছের প্রজনন কমে যায়। নদীর জীববৈচিত্র্য নষ্ট হয়।

নদীভাঙনের ফলে কৃষি জমি কমে যাচ্ছে। এছাড়াও, অনেকসময় বালু উত্তোলনের ফলে নদীর পানি লবণাক্ত হয়ে পড়ে। এই লবণাক্ত পানি কৃষি জমিতে সেচের কাজে ব্যবহার করা যায় না। ফলে কৃষিক্ষেত্রে দেখা দেয় বিরূপ প্রভাব। অতিরিক্ত বালু উত্তোলনের ফলে অনেক জায়গায় ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যায়। ফলে টিউবওয়েল থেকে পানি পাওয়া যায় না। দেখা দেয় তীব্র পানীয় জলের সংকট।

দেশের বিভিন্ন প্রান্তে দীর্ঘদিন ধরে অবাধে বালু উত্তোলনের মহোৎসব চললেও, প্রশাসনের ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, প্রশাসনের চোখের সামনেই চলছে অবৈধ বালু উত্তোলন। কিন্তু তারা রহস্যজনকভাবে নীরব ভূমিকা পালন করে। অতীতে, বিভিন্ন জায়গায় স্থানীয় প্রশাসন, অবৈধ বালু উত্তোলনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিয়ে, বরং তাদেরকে প্রশ্রয় দিয়েছে। তাদের এই রহস্যময় নীরবতার কারণেই বালুখেকোরা দিন দিন আরও বেপরোয়া হয়ে উঠেছে।

বালু উত্তোলনের বিষয়ে সুনির্দিষ্ট আইন থাকলেও, তার প্রয়োগে রয়েছে অনেক দুর্বলতা। অনেক সময় আইনের ফাঁকফোকর গলে বেরিয়ে যায় বালুখেকোরা। আবার, অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, আইন থাকলেও কর্তৃপক্ষ তা প্রয়োগে খুব একটা সক্রিয় নয়। আইনের কঠোর প্রয়োগ না হলে, বালুখেকোদের দৌরাত্ম্য বন্ধ করা অসম্ভব। অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায়, স্থানীয় প্রভাবশালী রাজনৈতিক ব্যক্তিরা অবৈধ বালু উত্তোলনের সাথে জড়িত। তাদের ছত্রছায়ায় চলে এই অবৈধ ব্যবসা। প্রশাসনের কর্মকর্তারাও তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে ভয় পায়। ফলে, বালু উত্তোলন হয়ে ওঠে রাজনীতির হাতিয়ার।

অবৈধ বালু উত্তোলনের এই ভয়াবহ থাবা থেকে দেশকে বাঁচাতে হলে, এখনই কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। বালু উত্তোলনের বিষয়ে যে আইন রয়েছে, তার কঠোর প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। যারা অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করছে, তাদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। প্রশাসনের কর্মকর্তাদের জবাবদিহিতার আওতায় আনতে হবে। যেসব কর্মকর্তা অবৈধ বালু উত্তোলনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিয়ে নীরব ভূমিকা পালন করবেন, তাদের বিরুদ্ধেও শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। জনগণকে অবৈধ বালু উত্তোলনের কুফল সম্পর্কে সচেতন করতে হবে। বালুখেকোদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে জনগণকে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। বালু উত্তোলনের উপর নির্ভরতা কমাতে হবে। নির্মাণকাজে বালুর বিকল্প হিসেবে অন্য সামগ্রী ব্যবহার করার বিষয়ে উৎসাহ প্রদান করতে হবে। যেসব জায়গায় সরকারিভাবে বালু উত্তোলনের অনুমতি দেওয়া হয়, সেসব জায়গায় ইজারা ব্যবস্থায় স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হবে। ইজারা প্রক্রিয়ায় কোনো দুর্নীতি হলে, তার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

যেসব এলাকায় অবৈধ বালু উত্তোলনের প্রবণতা বেশি, সেসব এলাকায় কঠোর নজরদারি বাড়াতে হবে। প্রয়োজনে মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করতে হবে। নদীকে বাঁচাতে হলে দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। নদী খনন, নদীর তীর সংরক্ষণ, নদীর নাব্যতা রক্ষা – এসব বিষয়ে সরকারকে গুরুত্ব দিতে হবে। অবৈধ বালু উত্তোলনের বিরুদ্ধে জনমত গঠনে গণমাধ্যমকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে। বালুখেকোদের মুখোশ উন্মোচন করতে হবে।

নদী আমাদের জীবন, নদী আমাদের সম্পদ। এই সম্পদ রক্ষা করার দায়িত্ব আমাদের সবার। লোভী বালুখেকোদের গ্রাস থেকে নদীকে বাঁচাতে হলে, আমাদের সবাইকে ঐক্যবদ্ধভাবে রুখে দাঁড়াতে হবে। প্রশাসনকে হতে হবে আরও দায়িত্বশীল, আরও কঠোর। আইন প্রয়োগে হতে হবে আরও তৎপর। জনগণকে হতে হবে আরও সচেতন। সম্মিলিত প্রচেষ্টার মাধ্যমেই আমরা পারবো নদীমাতৃক বাংলাদেশকে রক্ষা করতে, আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে উপহার দিতে পারবো একটি সুন্দর, সবুজ, বাসযোগ্য বাংলাদেশ। আর দেরি নয়, এখনই সময়, বালুখেকোদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর। আসুন, সবাই মিলে আওয়াজ তুলি, “থামাও বালুখেকোদের তাণ্ডব! বাঁচাও নদী, বাঁচাও দেশ!”

লেখক : ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক, একুশে পত্রিকা।