পাঁচ বছর ধরে প্রকাশিত হচ্ছে না জাতীয় শিক্ষার্থী মূল্যায়ন প্রতিবেদন


ঢাকা : মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তর (মাউশি) মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের অর্জিত দক্ষতা যাচাইয়ের জন্য ‘ন্যাশনাল স্টুডেন্টস অ্যাসেসমেন্ট রিপোর্ট অব সেকেন্ডারি স্টুডেন্টস’ শিরোনামে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিবেদন প্রকাশ করে থাকে। এই প্রতিবেদনের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের বাংলা, ইংরেজি ও গণিতের দক্ষতার স্তর বিশ্লেষণ করা হয়। নিয়ম অনুযায়ী প্রতি দুই বছর পর পর এই শিক্ষার্থী মূল্যায়ন প্রতিবেদন প্রকাশের কথা থাকলেও, মাউশি সর্বশেষ এই প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল ২০১৯ সালে। এরপর প্রায় পাঁচ বছর অতিক্রান্ত হলেও, জাতীয় পর্যায়ে মাধ্যমিক শিক্ষার্থীদের নতুন কোনো মূল্যায়ন প্রতিবেদন প্রকাশ করেনি প্রতিষ্ঠানটি।

এই দীর্ঘসূত্রিতার ফলে মাধ্যমিক শিক্ষার মান উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণে এক ধরনের প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হচ্ছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। তাদের মতে, এই মূল্যায়ন প্রতিবেদন থেকে সহজেই মাধ্যমিক স্তরের সংকটগুলো নির্ণয় করা সম্ভব। শুধু তাই নয়, এই প্রতিবেদনের মাধ্যমে কোন কোন ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের দুর্বলতা রয়েছে এবং শিক্ষাব্যবস্থার কোথায় কোথায় ঘাটতি বিদ্যমান, তা-ও চিহ্নিত করা যায়। ফলে, মাধ্যমিক শিক্ষার মান উন্নয়নবিষয়ক পরিকল্পনা গ্রহণ এবং যথাযথ পদক্ষেপ বাস্তবায়নে এই মূল্যায়ন রিপোর্ট অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক শেখ কাওসার আহমেদ এই প্রতিবেদনের গুরুত্ব সম্পর্কে বলেন, ‘শিক্ষার্থীদের বর্তমান অর্জিত দক্ষতা বিশ্লেষণ করলেই বোঝা যায় আমাদের শিক্ষার্থীরা কতটা শিখতে পারছে, কোন কোন ক্ষেত্রে তাদের ঘাটতি রয়েছে এবং আমাদের কোন ক্ষেত্রে উন্নয়ন দরকার। এই কারণে কারিকুলাম পরিবর্তন বা শিক্ষা ক্ষেত্রে যেকোনো প্রকল্প গ্রহণের ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের বর্তমান দক্ষতার স্তর মূল্যায়ন অত্যন্ত জরুরি। কিন্তু কয়েক বছর ধরেই করোনা প্রাদুর্ভাবসহ বিভিন্ন কারণে এই মূল্যায়ন প্রতিবেদন প্রকাশ হয়নি। ফলে আমাদের শিক্ষার্থীদের বর্তমান অবস্থা কী, তারা কতটা শিখতে পারছে এবং শিখন-শেখানোর ক্ষেত্রে সংকটগুলো কী সে বিষয়ে কোনো সুস্পষ্ট চিত্র পাওয়া যাচ্ছে না।’

তিনি আরও বলেন, ‘এখন পর্যন্ত প্রকাশিত প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের মূল্যায়ন প্রতিবেদনগুলো বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, প্রতিটি শ্রেণীতেই আমাদের বেশির ভাগ শিক্ষার্থীই কাঙ্ক্ষিত দক্ষতামান অর্জন করতে পারেনি। অর্থাৎ আমাদের শিখন-শেখানোর যে সংকট সেটি প্রাথমিক স্তর থেকেই শুরু হচ্ছে এবং এটি পরবর্তী স্তরেও দূর হচ্ছে না। এর একটি কারণ হলো আমাদের এ ঘাটতি দূর করতে যে ধরনের উদ্যোগ দরকার, বাস্তবে সে ধরনের উদ্যোগ নেই। এখন পর্যন্ত কারিকুলাম পরিবর্তনসহ যেসব উদ্যোগ নেয়া হয়েছে, তার বেশির ভাগই যথাযথ প্রস্তুতিসহ নেয়া হয়নি এবং মাঠ পর্যায়ের বাস্তবতা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই উপেক্ষিত হয়েছে।’

২০১২ সালে প্রথমবারের মতো সেকেন্ডারি এডুকেশন কোয়ালিটি অ্যান্ড অ্যাকসেস এনহ্যান্সমেন্ট প্রজেক্টের আওতাভুক্ত বিদ্যালয়গুলোর শিক্ষার্থীদের মূল্যায়ন প্রতিবেদন প্রকাশ করে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের মনিটরিং অ্যান্ড ইভালুয়েশন উইং। সে বছর শুধুমাত্র নবম শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের দক্ষতা যাচাই করা হয়েছিল। পরবর্তীতে ২০১৩ ও ২০১৫ সালে ষষ্ঠ ও অষ্টম শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের দক্ষতা যাচাই করা হয়। ২০১৫ সাল থেকে জাতীয় পর্যায়ে এই প্রতিবেদন প্রকাশ শুরু হয়। ২০১৭ ও ২০১৯ সালে ষষ্ঠ ও অষ্টম শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি দশম শ্রেণীর শিক্ষার্থীদেরও বাংলা, ইংরেজি ও গণিতের দক্ষতা যাচাই করা হয়।

সর্বশেষ ২০১৯ সালে প্রকাশিত ‘ন্যাশনাল স্টুডেন্টস অ্যাসেসমেন্ট রিপোর্ট অব সেকেন্ডারি স্টুডেন্টস’ রিপোর্টে শিক্ষার্থীদের ইংরেজি ও গণিতে অধিক দুর্বলতার চিত্র উঠে আসে। রিপোর্টে সারা দেশের ২৮ হাজার ১৯৪ জন ষষ্ঠ শ্রেণীর শিক্ষার্থী, ২৭ হাজার ৭৩৭ জন অষ্টম শ্রেণীর শিক্ষার্থী এবং ২৭ হাজার ২৮৪ জন দশম শ্রেণীর শিক্ষার্থীর তথ্য বিশ্লেষণ করা হয়। শিক্ষার্থীদের পারফরম্যান্সকে পাঁচটি স্তরে ভাগ করা হয়েছিল, যার মধ্যে সর্বনিম্ন স্তর ব্যান্ড ২ এবং সর্বোচ্চ স্তর ব্যান্ড ৬।

প্রতিবেদনে দেখা যায়, ষষ্ঠ শ্রেণীর মাত্র ৯ দশমিক ৩ শতাংশ শিক্ষার্থী, অষ্টম শ্রেণীর ২৬ দশমিক ৪ শতাংশ ও দশম শ্রেণীর ৪০ দশমিক ৪ শতাংশ শিক্ষার্থী ইংরেজিতে ব্যান্ড ৬ পর্যায়ের দক্ষতা অর্জন করেছে। গণিতের ক্ষেত্রে ষষ্ঠ শ্রেণীর মাত্র ৫ দশমিক ১ শতাংশ শিক্ষার্থী, অষ্টম শ্রেণীর ১৪ দশমিক ৫ শতাংশ ও দশম শ্রেণীর ২৮ দশমিক ৪ শতাংশ শিক্ষার্থী ব্যান্ড ৬ পর্যায়ের দক্ষতা অর্জন করেছে। তবে এই প্রতিবেদনে শিক্ষার্থীরা বাংলায় তুলনামূলক ভালো ফল করে। ষষ্ঠ শ্রেণীর ২৫ দশমিক ৮ শতাংশ শিক্ষার্থী, অষ্টম শ্রেণীর ৪৭ দশমিক ৭ শতাংশ ও দশম শ্রেণীর ৬৪ দশমিক ৩ শতাংশ শিক্ষার্থী বাংলায় ব্যান্ড ৬ পর্যায়ের দক্ষতা অর্জন করেছে।

শিক্ষাবিদরা বলছেন, শিক্ষার মান উন্নয়নের জন্য দুই বছরের পরিবর্তে প্রতি বছরই শিক্ষার্থী মূল্যায়ন প্রতিবেদন প্রকাশ করা প্রয়োজন। শুধু তাই নয়, শিক্ষা ক্ষেত্রে বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণের ক্ষেত্রে এসব প্রতিবেদনের ফল কতটা ব্যবহার করা হয়েছে, সে তথ্যও প্রকাশ করা উচিত। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের শিক্ষক অধ্যাপক ড. এসএম হাফিজুর রহমান এই বিষয়ে বলেন, ‘আমাদের দেশে একটি বড় সংকট হলো সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় এসব প্রতিবেদনে উঠে আসা ফলাফলের ব্যবহার খুব একটা দেখা যায় না। আর সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে যদি এ প্রতিবেদন ব্যবহার না-ই করা হয় তাহলে প্রতিবেদন তৈরি করেও উপকারিতা নেই। তাই শুধু নিয়মিত প্রতিবেদন প্রকাশই নয়, বরং কোন কোন ক্ষেত্রে কীভাবে প্রতিবেদনের ফলাফল ব্যবহার করা হয়েছে, সে তথ্যও প্রকাশ করা উচিত। শিক্ষা ক্ষেত্রে কার্যকর পদক্ষেপ নিশ্চিত করতে প্রতি বছরই এ ধরনের মূল্যায়ন হওয়া উচিত এবং মূল্যায়নে যাতে প্রকৃত চিত্রই উঠে আসে, সেটিও নিশ্চিত করা উচিত।’

অন্যদিকে, মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের গণিত ও ইংরেজিতে দুর্বলতার চিত্র উঠে এসেছে ২০২৪ সালের মাধ্যমিক ও সমমানের পরীক্ষার ফলেও। এই পরীক্ষার ফলাফলে দেখা গেছে, অন্যান্য বিষয়ের তুলনায় গণিতে অধিক সংখ্যক শিক্ষার্থী ফেল করেছে। প্রকাশিত ফলে দেখা গেছে, গণিতে নয়টি সাধারণ শিক্ষা বোর্ড ও মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড মিলে ফেলের হার ৮ দশমিক ৮১ শতাংশ। সংখ্যার হিসাবে প্রায় ১ লাখ ৬৬ হাজার ৬০২ শিক্ষার্থী বিষয়টিতে ফেল করেছে। গণিতের পর শিক্ষার্থীরা সবচেয়ে বেশি ফেল করেছে ইংরেজিতে।

মাউশির মনিটরিং অ্যান্ড ইভালুয়েশন উইং সূত্রে জানা গেছে, নভেল করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের কারণে ২০১৯ সালে মূল্যায়ন প্রতিবেদন প্রকাশ করা সম্ভব হয়নি। উইংয়ের পরিচালক প্রফেসর মোহা. আবেদ নোমানী বলেন, ‘বর্তমানে ন্যাশনাল স্টুডেন্টস অ্যাসেসমেন্ট রিপোর্ট অব সেকেন্ডারি স্টুডেন্টস রিপোর্ট ২০২৩-এর কাজ চলমান। এরই মধ্যে অষ্টম ও দশম শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের তথ্য সংগ্রহ সম্পন্ন হয়েছে। আশা করছি, আগামী এক-দুই মাসের মধ্যেই আমরা ২০২৩ সালের মূল্যায়ন প্রতিবেদন প্রকাশ করতে পারব।’

এই দীর্ঘ বিলম্বের ফলে মাধ্যমিক শিক্ষার মান উন্নয়নের জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণে এক ধরনের অস্পষ্টতা ও স্থবিরতা দেখা দিয়েছে। শিক্ষার মানোন্নয়নের জন্য নিয়মিতভাবে এই মূল্যায়ন প্রতিবেদন প্রকাশ করা এবং প্রতিবেদনের ফলাফলের ভিত্তিতে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা অত্যন্ত জরুরি বলছেন সংশ্লিষ্টরা।