শুক্রবার, ১০ জানুয়ারি ২০২৫, ২৭ পৌষ ১৪৩১

ব্যাংক মুনাফার উল্লাসে বিপন্ন অর্থনীতি

প্রকাশিতঃ ১০ জানুয়ারী ২০২৫ | ৫:০০ অপরাহ্ন


নজরুল কবির দীপু : ব্যাংক ঋণের ক্রমবর্ধমান সুদের হার বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য এক বিরাট বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিনিয়োগ ও শিল্পায়নের গতি থমকে গেছে, দেখা দিয়েছে দুশ্চিন্তার কালো মেঘ। একদিকে ব্যাংকগুলো যখন ফুলেফেঁপে উঠছে রেকর্ড মুনাফায়, অন্যদিকে নতুন বিনিয়োগ বন্ধ হয়ে স্থবির হয়ে পড়ছে শিল্প-কারখানা। ঋণের সুদের হার প্রায় দ্বিগুণের কাছাকাছি গিয়ে ঠেকায় দেশে ব্যবসা পরিচালনার ব্যয় বহুলাংশে বৃদ্ধি পেয়েছে। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে সর্বস্তরে, কর্মসংস্থান হ্রাস, আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যে স্থবিরতা, এবং ক্রমবর্ধমান মূল্যস্ফীতি – এ যেন এক দুষ্টচক্রের আবর্তে ঘুরপাক খাচ্ছে দেশের অর্থনীতি।

মজার ব্যাপার হলো, এই ঋণের সুদের হার বৃদ্ধির পেছনে যুক্তি হিসেবে দেখানো হয়েছিল মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের কথা! আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) দীর্ঘদিন ধরে এই দাবি জানিয়ে আসছিল। বাংলাদেশ ব্যাংক দফায় দফায় ঋণের সুদের হার বৃদ্ধি করে, যার ফলে রেপো রেট বা নীতি সুদহার ৫ শতাংশ থেকে বেড়ে ১০ শতাংশে গিয়ে দাঁড়ায়। ব্যাংক ঋণের সুদের হারও সর্বোচ্চ ৯ শতাংশ থেকে বেড়ে দাঁড়ায় প্রায় ১৬ শতাংশে। এর ফলে, ব্যবসার খরচ বা ‘কস্ট অব ডুইং বিজনেস’ অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে গেছে। এই বৃদ্ধি আবার প্রত্যক্ষভাবে ইন্ধন যোগাচ্ছে মূল্যস্ফীতিতে। বর্তমানে, দেশে মূল্যস্ফীতি ১২ শতাংশ ছুঁই ছুঁই করছে।

এই চড়া মূল্যস্ফীতির বাজারে ব্যাংক ঋণের সুদের হার বৃদ্ধি পাওয়ায় সাধারণ মানুষের জীবনে তেমন কোনো ইতিবাচক পরিবর্তন আসেনি। অন্যদিকে, ব্যাংকগুলো কিন্তু ঠিকই তাদের মুনাফার ভাণ্ডার পূর্ণ করে চলেছে। পরিচালন মুনাফায় একের পর এক রেকর্ড গড়ছে ব্যাংকগুলো। এক বছরের ব্যবধানে কোনো কোনো ব্যাংকের মুনাফা বৃদ্ধির হার ৭০ শতাংশেরও বেশি! ইতোমধ্যে বিভিন্ন ব্যাংক তাদের বাৎসরিক হিসাব প্রকাশ করেছে।

এই হিসাব অনুযায়ী, ব্র্যাক ব্যাংক ২০২৪ সালে পরিচালন মুনাফা করেছে প্রায় ২ হাজার ৪০০ কোটি টাকা। গত বছর, অর্থাৎ ২০২৩ সালে ব্যাংকটির পরিচালন মুনাফা ছিল ১ হাজার ৩৯৩ কোটি টাকা। এক বছরের ব্যবধানে ব্যাংকটির মুনাফা বেড়েছে ৭২.২৯ শতাংশ! ব্র্যাক ব্যাংকের পরে, পূবালী ব্যাংকও রেকর্ড পরিমাণ পরিচালন মুনাফা অর্জন করেছে। সদ্য বিদায়ী বছরে ব্যাংকটি ২ হাজার ৩৭৫ কোটি টাকা পরিচালন মুনাফা করে, যা আগের বছরের তুলনায় ৫১.৬৬ শতাংশ বেশি। সিটি ব্যাংকও তাদের ইতিহাসে সর্বোচ্চ মুনাফা অর্জন করেছে। গত বছর ব্যাংকটি ২ হাজার ২৮৭ কোটি টাকা পরিচালন মুনাফা অর্জন করে, যা আগের বছরের তুলনায় ৬৯.৫৩ শতাংশ বেশি। ডাচ-বাংলা ব্যাংকও পিছিয়ে নেই। গত বছর ব্যাংকটি ২ হাজার ২৮৫ কোটি টাকা পরিচালন মুনাফা অর্জন করেছে, যা আগের বছরের তুলনায় ৬১.৭১ শতাংশ বেশি।

এছাড়াও, ২০২৪ সালে ব্যাংক এশিয়া ১ হাজার ৭০০ কোটি (আগের বছর ১,১৫৩ কোটি টাকা), ইস্টার্ন ব্যাংক ১ হাজার ৬৭৫ কোটি টাকা (আগের বছর ১,১৪৫ কোটি টাকা), প্রাইম ব্যাংক ১ হাজার ৫০০ কোটি (আগের বছর ৯৩৭ কোটি টাকা), মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক (এমটিবি) ১ হাজার ১১০ কোটি টাকা (আগের বছর ৭৩১ কোটি টাকা), শাহ্‌জালাল ইসলামী ব্যাংক ১ হাজার ৫০ কোটি টাকা (আগের বছর ৮৮৮ কোটি টাকা), এক্সিম ব্যাংক ৯৭৫ কোটি (আগের বছর ৭৩৬ কোটি টাকা), প্রিমিয়ার ব্যাংক ৮৫০ কোটি টাকা (আগের বছর এই ব্যাংক পরিচালন মুনাফা অর্জন করেছিল ৯১৪ কোটি টাকা), ওয়ান ব্যাংক ৮৩০ কোটি টাকা (আগের বছর ৩৬১ কোটি টাকা), মার্কেন্টাইল ব্যাংক ৬৪৪ কোটি টাকা (আগের বছর ৫৫৮ কোটি টাকা) এবং মেঘনা ব্যাংক ২০৪ কোটি টাকা (আগের বছর ১৬০ কোটি টাকা) পরিচালন মুনাফা লাভ করেছে।

এই ব্যাংকগুলোর মধ্যে কেবলমাত্র প্রিমিয়ার ব্যাংকের পরিচালন মুনাফা আগের বছরের তুলনায় কিছুটা কমলেও, বাকি সবকটি ব্যাংকই বিপুল পরিমাণে মুনাফা বৃদ্ধি করতে সক্ষম হয়েছে।

একাধিক ব্যাংকারের সাথে কথা বলে জানা গেছে, ব্যাংকিং সেক্টরে বর্তমানে বেশ কিছু সমস্যা বিরাজমান থাকলেও, গত বছর ব্যাংকগুলোর আয় অনেক বেড়েছে। আয় থেকে ব্যয় বাদ দিয়ে নির্ধারণ করা হয় পরিচালন মুনাফা। এই পরিচালন মুনাফা থেকে আবার খেলাপি ঋণ ও অন্যান্য সম্পদের বিপরীতে প্রভিশন (নিরাপত্তা সঞ্চিতি) সংরক্ষণ এবং সরকারকে কর পরিশোধ করার পর যে অর্থ অবশিষ্ট থাকে, সেটিই হলো একটি ব্যাংকের প্রকৃত মুনাফা। ব্যাংকাররা বলছেন, পরিচালন মুনাফার একটি বড় অংশ নিরাপত্তা সঞ্চিতি এবং কর হিসেবে চলে যায়। তবুও, এবছর প্রতিটি ব্যাংকের নিট মুনাফা আশাতীত হবে বলে তারা ধারণা করছেন।

তবে, দেশের ব্যাংকিং সেক্টরের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, ২০২৪ সালের মতো এতটা অস্থিতিশীল সময় আগে কখনো আসেনি। গত ১৫ বছর ধরে এই সেক্টরে যে পরিমাণ লুটপাট, মুদ্রা পাচার, ঋণ কেলেঙ্কারির ঘটনা ঘটেছে, তা নজিরবিহীন। এসব ঘটনা প্রকাশ্যে আসার পর, ব্যাংকিং সেক্টরের প্রতি মানুষের আস্থা তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে। এই সময়, গ্রাহকরা বিভিন্ন দুর্বল ব্যাংক থেকে তাদের আমানত তুলে নিয়ে অপেক্ষাকৃত ভালো ব্যাংকগুলোতে জমা রেখেছেন। ভালো ব্যাংকগুলো এই সুযোগে স্বল্প সুদে প্রচুর পরিমাণে আমানত সংগ্রহ করতে পেরেছে। এই আমানত কাজে লাগিয়ে তারা প্রচুর মুনাফা করেছে। অন্যদিকে, দুর্বল ব্যাংকগুলোর অধিকাংশই তেমন মুনাফা করতে পারেনি। অনেক ব্যাংক এখনো পর্যন্ত তাদের বাৎসরিক হিসাব প্রকাশ করতে পারেনি।

এই পরিস্থিতিতে, ব্যাংকগুলো যখন বিপুল মুনাফা করছে, তখন দেশের সাধারণ মানুষ ভুগছে ক্রমবর্ধমান মূল্যস্ফীতির কষাঘাতে। বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ প্রফেসর ড. মঈনুল ইসলাম অবশ্য আশা প্রকাশ করেছেন যে, আগামী মাসগুলোতে মূল্যস্ফীতি কমে আসবে। তার মতে, স্থানীয় উৎপাদন বৃদ্ধি পাওয়ায় মূল্যস্ফীতির উপর চাপ কমবে। এছাড়াও, সরকার বিভিন্নভাবে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের জন্য কাজ করছে বলে তিনি উল্লেখ করেন।

সুদের হার বৃদ্ধি এবং ব্যাংকগুলোর বিপুল মুনাফার এই পরিস্থিতিতে, প্রিমিয়ার সিমেন্ট লিমিটেড এবং বাংলাদেশের এলপিজি অপারেটরস ওনার্স এসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান আমিরুল হক উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তার মতে, ব্যাংক ঋণের চড়া সুদের কারণে শিল্প-কারখানা স্থাপন এবং বিনিয়োগে স্থবিরতা নেমে এসেছে। এই স্থবিরতা দেশের কর্মসংস্থান, আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। মূল্যস্ফীতিও মানুষকে চরম ভোগান্তির মধ্যে ফেলেছে। এই পরিস্থিতিতে, দেশে শিল্প-কারখানা স্থাপন কিংবা ব্যবসা পরিচালনা করা অত্যন্ত কঠিন হয়ে পড়েছে। তিনি মনে করেন, এই বিষয়টিকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে সংস্কার না করলে, পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ আকার ধারণ করবে।

এই দীর্ঘ আলোচনা থেকে স্পষ্ট যে, ব্যাংক ঋণের চড়া সুদের হার দেশের অর্থনীতির জন্য এক বিরাট ঝুঁকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। একদিকে, ব্যাংকগুলো যখন বিপুল মুনাফা করছে, তখন অন্যদিকে বিনিয়োগ ও শিল্পায়ন স্থবির হয়ে পড়েছে। কর্মসংস্থানের সুযোগ সংকুচিত হচ্ছে, আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্য ঝিমিয়ে পড়ছে। মূল্যস্ফীতির চাপে পিষ্ট হচ্ছে সাধারণ মানুষ। এই দুষ্টচক্র থেকে বের হতে না পারলে, দেশের অর্থনীতির ভবিষ্যৎ অন্ধকার।

এই মুহূর্তে, সরকারকে এই বিষয়টির উপর সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। ঋণের সুদের হার কমানোর জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। বিনিয়োগের পরিবেশ উন্নত করতে হবে, শিল্পায়নের গতি বৃদ্ধি করতে হবে। কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে, আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যকে উৎসাহিত করতে হবে। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের জন্য দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে।

পাশাপাশি, ব্যাংকিং সেক্টরের সংস্কারও জরুরি। লুটপাট, মুদ্রা পাচার, ঋণ কেলেঙ্কারির মতো ঘটনা বন্ধ করতে হবে। ব্যাংকিং সেক্টরের উপর মানুষের আস্থা ফিরিয়ে আনতে হবে।

পরিশেষে, ঋণের ফাঁদে আটকে থাকা অর্থনীতিকে টেনে তুলতে হলে, এখনই সময় সম্মিলিত প্রচেষ্টার। সরকার, ব্যাংক, ব্যবসায়ী, অর্থনীতিবিদ – সবাইকে একসাথে কাজ করতে হবে। অর্থনীতির গতি ফিরিয়ে আনতে, ঋণের বোঝা হালকা করে, বিনিয়োগের পরিবেশ উন্নত করে, শিল্পায়নের চাকা সচল করতে হবে। তবেই, দেশের অর্থনীতির ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল হবে, সমৃদ্ধি আসবে দেশজুড়ে।

লেখক : ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক, একুশে পত্রিকা।