নজরুল কবির দীপু : সারা দেশের বিদ্যালয়গুলোতে গতকাল বুধবার নতুন শিক্ষাবর্ষের বই বিতরণ শুরু হলেও প্রথম দিনেই সব শিক্ষার্থীর হাতে বই পৌঁছানো সম্ভব হয়নি। এটি কেবল একটি সাধারণ ঘটনা নয়, বরং দেশের প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষার কাঠামো এবং এর কার্যকারিতার ওপর গভীর প্রশ্ন তুলেছে।
গত কয়েক বছর ধরে দেখা যাচ্ছে, শিক্ষার্থীদের বিনামূল্যের পাঠ্যবই নিয়ে নানা সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে। বিশেষত, প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার্থীরা সময়মতো বই না পাওয়ার কারণে শিক্ষা কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। এ বছর এ সমস্যা আরও জটিল আকার ধারণ করেছে।
সব শিক্ষার্থীর হাতে বই পৌঁছাতে না পারা একটি গুরুতর সমস্যা। এ অবস্থায় সরকার বিকল্প ব্যবস্থা হিসেবে পাঠ্যবইয়ের অনলাইন ভার্সন প্রকাশের উদ্যোগ নিয়েছে। বুধবার রাজধানীর আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটে এ কার্যক্রম উদ্বোধন করেন শিক্ষা উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ।
তবে বাস্তবতার কথা হলো, দেশের হতদরিদ্র পরিবারের শিক্ষার্থীরা এই অনলাইন ভার্সনের সুবিধা নিতে পারবে না। প্রযুক্তির অভাবে কিংবা ইন্টারনেট সংযোগের সীমাবদ্ধতায় তাদের শিক্ষার সুযোগ আরও সংকুচিত হবে। এ পরিস্থিতিতে প্রশ্ন ওঠে, কেন বছরের শুরুতে সব শিক্ষার্থীর হাতে বই পৌঁছে দেওয়ার জন্য কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না?
শিক্ষা উপদেষ্টা তাঁর বক্তব্যে বলেছেন, যারা বই ছাপানোর কাজে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করেছে, তাদের তালিকা করা হচ্ছে। দুর্নীতিগ্রস্ত কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে দুর্নীতি দমন কমিশনকে (দুদক) নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এমন পদক্ষেপ নিশ্চয়ই প্রশংসনীয়।
তবে প্রশ্ন থেকে যায়, কেন প্রতি বছর একই সমস্যা পুনরাবৃত্তি হয়? বই মুদ্রণের কাজে নিয়োজিত ব্যক্তিদের মধ্যে দুর্নীতি, অব্যবস্থাপনা এবং দায়িত্বহীনতার কারণে এই জটিলতা তৈরি হচ্ছে। এসব সমস্যা সমাধানে কেবল কর্মকর্তাদের বদলি বা শাস্তি দেওয়া যথেষ্ট নয়, বরং পুরো প্রক্রিয়াটিকে স্বচ্ছ এবং কার্যকর করতে হবে।
শিক্ষার মান উন্নত করতে হলে শিক্ষার্থীদের সঠিক সময়ে সঠিক বই দিতে হবে। এ বছরের মতো যদি পাঠ্যবইয়ের অভাব দেখা দেয়, তাহলে শিক্ষার্থীদের দক্ষ জনশক্তিতে রূপান্তরের ক্ষেত্রে জটিলতা সৃষ্টি হবে। মানসম্মত বই শিক্ষার্থীদের দক্ষতা বৃদ্ধির পাশাপাশি তাদের নৈতিকতা এবং মূল্যবোধ গঠনে ভূমিকা রাখে।
অতীতে দেখা গেছে, প্রকাশিত পাঠ্যপুস্তকগুলোতে নানা ভুল ছিল। কোথাও একটি অধ্যায়ের অংশ নেই, আবার কোথাও দুই পৃষ্ঠার মধ্যে কোনো সংযোগ নেই। ভুলে ভরা এমন বই শিক্ষার্থীদের শেখার ক্ষেত্রে বড় বাধা তৈরি করে। শিক্ষার্থীরা এই ভুল তথ্য নিয়ে বিভ্রান্ত হয়, যা তাদের পড়াশোনার মান নষ্ট করে। এ সমস্যা সমাধানে কর্তৃপক্ষকে অধিক মনোযোগী হতে হবে। বই প্রকাশের আগে তা নিরীক্ষা এবং সংশোধনের জন্য একটি বিশেষ কমিটি গঠন করা যেতে পারে। এসব কমিটিতে শিক্ষাবিদ, বিষয় বিশেষজ্ঞ এবং অভিজ্ঞ সম্পাদকদের অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।
নতুন শিক্ষাবর্ষে নতুন শিক্ষাক্রম বাদ দিয়ে পুরোনো শিক্ষাক্রমে ফিরে আসা একটি গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন। তবে, শিক্ষাক্রমের পরিবর্তন মানে শিক্ষার মানোন্নয়ন নিশ্চিত করা নয়। পাঠ্যবইয়ের বিষয়বস্তু সংযোজন-বিয়োজনের ক্ষেত্রে যথাযথ চিন্তাভাবনা প্রয়োজন। বিষয়বস্তু এমন হতে হবে, যা শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যতের চাহিদা পূরণে সহায়ক হবে। একইসঙ্গে শিক্ষার্থীদের নৈতিকতা এবং মূল্যবোধের চর্চায় উদ্বুদ্ধ করা জরুরি। শিক্ষার মূল লক্ষ্য কেবল বই পড়ে ভালো ফল করা নয়, বরং শিক্ষার্থীদের জ্ঞানচর্চা, সৃজনশীলতা এবং মানবিক গুণাবলির বিকাশ ঘটানো।
প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার্থীদের বিনামূল্যের পাঠ্যবই সময়মতো সরবরাহ করতে হবে। যেকোনো প্রকার দুর্নীতি এবং অব্যবস্থাপনা বন্ধ করতে হবে। মুদ্রণশিল্প থেকে শুরু করে বই বিতরণের প্রতিটি ধাপ স্বচ্ছ এবং কার্যকর করতে প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ানো যেতে পারে। মানসম্মত ও ত্রুটিমুক্ত বই প্রকাশ করতে হবে। ভুলে ভরা বই শিক্ষার্থীদের শিক্ষার মান কমিয়ে দেয় এবং তাদের লক্ষ্য অর্জনে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। একইসঙ্গে, শিক্ষার্থীদের প্রযুক্তি ব্যবহার শেখানোর ওপরও গুরুত্ব দিতে হবে, যাতে তারা অনলাইন পাঠ্যবই ব্যবহার করতে সক্ষম হয়।
পরিবর্তিত বিশ্ব পরিস্থিতিতে আমাদের শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যতের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় প্রস্তুত করতে হবে। এজন্য মানসম্মত শিক্ষা, সময়মতো পাঠ্যবই বিতরণ এবং দুর্নীতিমুক্ত পরিবেশ নিশ্চিত করা অপরিহার্য। আমরা আশা করি, সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলো এই সমস্যাগুলো সমাধানে দ্রুত পদক্ষেপ নেবে। শিক্ষার প্রতিটি স্তরে যদি কার্যকর পরিবর্তন আনা যায়, তাহলে আমাদের শিক্ষার্থীরা দক্ষ জনশক্তিতে রূপান্তরিত হবে এবং দেশকে উন্নতির পথে এগিয়ে নেবে।
লেখক : ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক, একুশে পত্রিকা।