শনিবার, ১৮ জানুয়ারি ২০২৫, ৫ মাঘ ১৪৩১

প্লাস্টিকের বোতলের আড়ালে লুকানো বিপদ

| প্রকাশিতঃ ২৮ ডিসেম্বর ২০২৪ | ৯:১৯ পূর্বাহ্ন

Plastic bottle waste
নজরুল কবির দীপু : প্লাস্টিকের বোতল আমাদের দৈনন্দিন জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। হাতের কাছে সহজেই পাওয়া যায় এবং ব্যবহারে সুবিধাজনক হওয়ায় এর প্রচলন ব্যাপক। কিন্তু এই সহজলভ্যতার আড়ালে লুকিয়ে আছে স্বাস্থ্য ও পরিবেশের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর দিক, যা আমাদের গভীরভাবে ভাবা উচিত।

একটি সাম্প্রতিক গবেষণা অনুসারে, বাংলাদেশে প্রায় ৮৩.৬ শতাংশ মানুষ প্রতিদিন অন্তত একবার প্লাস্টিকের বোতলে পানি পান করেন। এই পরিসংখ্যান থেকে বোঝা যায়, প্লাস্টিকের বোতল আমাদের দৈনন্দিন জীবনের কতটা গভীরে প্রবেশ করেছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, এই বোতলগুলো কি সত্যিই নিরাপদ?

গবেষণায় দেখা গেছে, প্লাস্টিকের বোতল থেকে বিসফেনল এ (বিপিএ) নামক একটি রাসায়নিক পদার্থ নির্গত হয়, যা আমাদের শরীরের হরমোন ব্যবস্থায় মারাত্মক প্রভাব ফেলে। বিপিএ আমাদের শরীরের স্বাভাবিক হরমোন উৎপাদনে বাধা দেয়, যার ফলে বিভিন্ন ধরনের স্বাস্থ্য সমস্যা দেখা দিতে পারে। দীর্ঘমেয়াদী ব্যবহারে এটি ক্যানসারের ঝুঁকিও বাড়িয়ে দেয়। হরমোনের ভারসাম্যহীনতা ছাড়াও, বিপিএ হৃদরোগ, ওজন বৃদ্ধি এবং ডায়াবেটিসের ঝুঁকিও বৃদ্ধি করে। তাই, এই রাসায়নিক পদার্থের ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে আমাদের সতর্ক থাকা অত্যন্ত জরুরি।

প্লাস্টিকের অতিরিক্ত ব্যবহার শুধু আমাদের স্বাস্থ্যের ক্ষতি করে না, বরং পরিবেশের উপরও মারাত্মক প্রভাব ফেলে। প্লাস্টিকের বোতল, বিশেষ করে পলিথিন টেরেফথ্যালেট (পিইটি) দিয়ে তৈরি বোতলগুলো প্রায় ৪৫০ বছর পর্যন্ত অবিকৃত থাকে। এই দীর্ঘস্থায়ী জীবাশ্ম পদার্থগুলো সময়ের সাথে সাথে ভেঙে মাইক্রোপ্লাস্টিকে পরিণত হয়, যা পরিবেশে ছড়িয়ে পড়ে এবং ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থ নির্গত করে। এই মাইক্রোপ্লাস্টিক মাটি ও পানিতে মিশে পরিবেশ, জীববৈচিত্র্য এবং মানব স্বাস্থ্যের ওপর মারাত্মক ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে।

নদী ও সাগরে প্লাস্টিকের বর্জ্য জমে পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট করছে। কচ্ছপ, মাছ, পাখি সহ অনেক জলজ প্রাণী প্লাস্টিককে খাদ্য মনে করে খেয়ে ফেলে এবং মারা যায়। প্লাস্টিক বর্জ্য খাদ্য শৃঙ্খলে প্রবেশ করে মানুষের শরীরেও প্রবেশ করে, যা আমাদের স্বাস্থ্যের জন্য আরও বিপজ্জনক।

সত্তরের দশকে আমাদের দেশে অনেক পণ্য কাঁচের বোতলে বিক্রি হতো। কাঁচের বোতল ছিল টেকসই এবং পরিবেশবান্ধব। কিন্তু এখন কাঁচের বোতলের জায়গা দখল করেছে প্লাস্টিকের বোতল। প্লাস্টিকের বোতল তুলনামূলকভাবে সস্তা এবং সহজে বহনযোগ্য হওয়ায় ব্যবসায়ীরা এর প্রতি আকৃষ্ট হয়েছেন। কিন্তু এই পরিবর্তনের ফলে পরিবেশ ও মানুষের স্বাস্থ্য মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

প্লাস্টিকের ব্যবহারের ফলে শুধু পরিবেশ নয়, আমাদের সমাজেও পরিবর্তন এসেছে। আগেকার দিনে শহর ও গ্রামের প্রায় সব বাড়িতেই কাঁচ ও ধাতব পাত্র ব্যবহার করা হতো। কিন্তু এখন প্লাস্টিকের সামগ্রী সর্বত্র ব্যবহার করা হচ্ছে। প্লাস্টিকের পাত্র সহজে ভাঙে না এবং পরিবেশে দীর্ঘ সময় ধরে টিকে থাকে। এই পরিবর্তনের ফলে আমাদের পরিবেশ ও স্বাস্থ্য দুটোই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

প্লাস্টিকের বোতলের ব্যবহার কমাতে হলে আমাদের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। এই সমস্যা সমাধানে সরকারের পাশাপাশি জনগণেরও সক্রিয় ভূমিকা নিতে হবে। প্লাস্টিকের উৎপাদন ও ব্যবহারের উপর কঠোর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করতে হবে। প্লাস্টিকের বিকল্প উপকরণ ব্যবহারে উৎসাহিত করতে হবে। প্লাস্টিক ব্যাগ ব্যবহার বন্ধের উদ্যোগ আরও জোরদার করতে হবে।

প্লাস্টিকের বিকল্প হিসেবে আমরা কাঁচ, স্টেইনলেস স্টিল, বাঁশ বা বায়োডিগ্রেডেবল উপকরণ দিয়ে তৈরি বোতল ব্যবহার করতে পারি। এই ধরনের বোতল পরিবেশবান্ধব এবং পুনর্ব্যবহারযোগ্য।

সরকারের পাশাপাশি আমাদের ব্যক্তিগত প্রচেষ্টা ও দায়িত্বও অপরিহার্য। প্রতিটি মানুষকে প্লাস্টিকের ব্যবহার কমিয়ে পরিবেশ রক্ষার জন্য সচেষ্ট হতে হবে। প্লাস্টিকের পরিবর্তে পুনর্ব্যবহারযোগ্য সামগ্রী ব্যবহার করতে হবে। প্রতিদিনের জীবনে ছোট ছোট পরিবর্তন এনে আমরা বড় ধরনের ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে পারি।

প্লাস্টিকের বোতল ব্যবহারের ফলে জল ও মাটি দূষিত হচ্ছে। প্লাস্টিক সহজে মাটিতে মিশে যায় না, বরং বিভিন্ন জীববৈচিত্র্যের উপর ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে। প্লাস্টিকের বোতল নদী, সাগর ও জলাশয়ে জমে জলজ প্রাণীর জীবন বিপন্ন করে তোলে। মাটিতে জমে থাকা প্লাস্টিক মাইক্রোপ্লাস্টিকে পরিণত হয়ে মাটির গুণাগুণ নষ্ট করে এবং উর্বরতা কমিয়ে দেয়।

প্লাস্টিকের বর্জ্য খাদ্য শৃঙ্খলে প্রবেশ করে মানবদেহেও মাইক্রোপ্লাস্টিক প্রবেশ করায়। খাদ্যের মাধ্যমে প্লাস্টিকের ক্ষতিকর পদার্থ আমাদের শরীরে পৌঁছে নানা রোগ সৃষ্টি করতে পারে।

প্লাস্টিকের বোতল ব্যবহারের পরিমাণ কমাতে হলে আমাদের সমাজে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি। প্রথমত, জনগণের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি করা। দ্বিতীয়ত, সরকারের কঠোর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা। তৃতীয়ত, প্লাস্টিকের বিকল্প উপকরণের ব্যবহার বাড়ানো।

প্লাস্টিকের বোতল ব্যবহারের বিপদ মোকাবেলা করতে আমাদের সবাইকে একযোগে কাজ করতে হবে। শুধুমাত্র সরকারের উপর নির্ভর করে এই সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়। ব্যক্তিগত প্রচেষ্টা ও সামাজিক দায়বদ্ধতার মাধ্যমে আমরা এই সমস্যা মোকাবেলা করতে পারি।

প্লাস্টিকের বোতল ব্যবহারের ফলে আমাদের পরিবেশ ও স্বাস্থ্য দুটোই বিপন্ন। এই সমস্যা সমাধানে সচেতনতা বৃদ্ধি, সরকারের কঠোর পদক্ষেপ এবং ব্যক্তিগত প্রচেষ্টা—এই তিনটিই অত্যন্ত জরুরি। প্লাস্টিকের পরিবর্তে পরিবেশবান্ধব উপকরণ ব্যবহার করে আমরা আমাদের পরিবেশ ও স্বাস্থ্যকে রক্ষা করতে পারি।

পরিশেষে, প্লাস্টিকের বোতল ব্যবহারের বিপদ সম্পর্কে আমাদের গভীরভাবে চিন্তা করতে হবে। আমাদের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের স্বাস্থ্য এবং পরিবেশের সুরক্ষার জন্য প্লাস্টিকের ব্যবহার কমাতে হবে। এটা শুধু আমাদের দায়িত্ব নয়, বরং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের প্রতিও আমাদের দায়বদ্ধতা। তাই, আসুন, আমরা সবাই মিলে প্লাস্টিকের ব্যবহার কমিয়ে একটি সুন্দর ও সুস্থ পৃথিবী গড়ে তুলি।

লেখক : ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক, একুশে পত্রিকা।