বৃহস্পতিবার, ২৬ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২ পৌষ ১৪৩১

ক্ষমতার পরিবর্তনে কাঁপছেন চট্টগ্রামের স্বাস্থ্য তত্ত্বাবধায়ক সুজন বড়ুয়া?

প্রকাশিতঃ ২৫ ডিসেম্বর ২০২৪ | ৬:৩৭ অপরাহ্ন


চট্টগ্রাম : চট্টগ্রাম জেলা স্বাস্থ্য তত্ত্বাবধায়ক সুজন বড়ুয়া আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর নিজের জীবনের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে চট্টগ্রাম ছেড়ে যাওয়ার জন্য আবেদন করেছেন। তিনি গত ২৪ সেপ্টেম্বর স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের কাছে কক্সবাজার অথবা নোয়াখালীতে বদলির আবেদন করেন।

তিনি তার আবেদনে উল্লেখ করেন, “বর্তমান পরিস্থিতির পরিবর্তনের কারণে, আমি আমার জীবনের নিরাপত্তার জন্য চট্টগ্রাম জেলা থেকে কক্সবাজার/নোয়াখালী জেলা সিভিল সার্জন কার্যালয়ে বদলি হতে আকুল আবেদন জানাচ্ছি।”

এই আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে প্রশ্ন উঠেছে, সুজন বড়ুয়া কি আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে চট্টগ্রামে এমন কোন অন্যায় করেছিলেন যার ফলে এখন তিনি চট্টগ্রামে চাকরি করতে ভয় পাচ্ছেন?

যদিও চট্টগ্রাম জেলা স্বাস্থ্য তত্ত্বাবধায়ক সুজন বড়ুয়ার বিরুদ্ধে সনদ জালিয়াতি এবং অন্যান্য অনিয়মের বিস্তর অভিযোগ আছে। এসব অভিযোগ সত্ত্বেও তিনি পদোন্নতি পেতে যাচ্ছেন। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের কাছে তার পদোন্নতির সুপারিশ করেছেন চট্টগ্রামের বিদায়ী সিভিল সার্জন মোহাম্মদ ইলিয়াস চৌধুরী। ইলিয়াস গত ১৮ আগস্ট স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের কাছে সুজনের পদোন্নতির জন্য চিঠি দিয়েছেন।

এরপর ২৪ সেপ্টেম্বর সুজন বড়ুয়া চট্টগ্রাম ছেড়ে যেতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের কাছে আবেদন করেন।

এই আবেদনের কথা জানতে পেরে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন। অভিযোগ ছিল সুজনের দুই জন্মনিবন্ধন, ভুয়া নাগরিকত্ব সনদ এবং একই সাথে দুই সরকারি চাকরি করা নিয়ে। স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মকর্তারা দাবি করেন, এসব বিষয়ে সঠিক তদন্ত করে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।

কিন্তু স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কিছু অসাধু কর্মকর্তা সুজনের অপরাধগুলোকে উপেক্ষা করার চেষ্টা করছেন। অধিদপ্তরের চট্টগ্রাম বিভাগীয় পরিচালক অংসুইপ্রু মারমা সুজনের বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে চাননি।

সুজন বড়ুয়ার দুই চাকরির বিষয়ে জানা যায়, তিনি ২০০৪ সালে কক্সবাজারের উখিয়া উপজেলার মরিচ্যা পালং গ্রামে বাস করতেন বলে দাবি করে স্বাস্থ্য সহকারী পদে নিয়োগ পান। এরপর ২০১২ সালে বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার ঘুমধুম বড়ুয়াপাড়ার বাসিন্দা পরিচয়ে রাঙামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদের অধীনে স্যানিটারি ইন্সপেক্টর পদে চাকরি নেন। তবে এই চাকরিতে যোগদানের সময় তার ভুয়া নাগরিকত্ব উদঘাটিত হয়। অভিযোগ উঠার মাত্র তিন মাসের মধ্যে তিনি বান্দরবান স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে বদলি হন এবং দ্রুত পদোন্নতি পেয়ে জেলা স্বাস্থ্য তত্ত্বাবায়ক পদে উন্নীত হন।

২০১২ সালের নিয়োগ প্রক্রিয়ায় রাঙ্গামাটি জেলায় স্যানিটারি ইন্সপেক্টর পদে যোগদানের আগে সরকারি চাকরি থেকে অব্যাহতিপত্র গ্রহণের শর্ত ছিল, যা সুজন বড়ুয়া মানেননি। পাশাপাশি নিয়োগপ্রাপ্তদের পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের স্থায়ী বাসিন্দা হতে বাধ্যবাধকতা ছিল, কিন্তু সুজন মূলত কক্সবাজারের উখিয়ার বাসিন্দা ছিলেন।

৫ নভেম্বর চট্টগ্রাম বিভাগীয় পরিচালক স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের কাছে চার পৃষ্ঠার চিঠি পাঠিয়েছেন, যেখানে সুজনের বিরুদ্ধে সনদ জালিয়াতি ও অন্যান্য অভিযোগের তদন্ত চলছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে এবং তাকে নতুন পদোন্নতি না দেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে। এই চিঠির সাথে ১৯ পৃষ্ঠার সংযুক্তি কাগজপত্রও দেওয়া হয়েছে।

সুজনের বিরুদ্ধে উঠা অভিযোগের বিষয়ে, চট্টগ্রামের সাবেক সিভিল সার্জন ডা. মো. ইলিয়াস চৌধুরী দাবি করেন যে এই অভিযোগগুলো হয়রানিমূলক এবং সত্যতা নেই। অভিযোগগুলোর বিষয়ে আদালতে মামলা রয়েছে বলেও জানিয়েছেন।

বান্দরবান পার্বত্য জেলা পরিষদ ও সিভিল সার্জন কার্যালয়ের একাধিক কর্মকর্তা জানান, রাঙামাটি জেলা স্যানিটারি ইন্সপেক্টর পদটি দশম গ্রেডের, যা পার্বত্য জেলা পরিষদের নিয়োগ বা পদোন্নতির আওতায় নয়। সাধারণত, এই পদে পদোন্নতি বোর্ডের মাধ্যমে জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে নিয়োগ দেওয়া হয়। তবে সুজন বড়ুয়া নিয়ম ভঙ্গ করে ভুয়া সনদে চাকরি পেয়েছেন এবং একের পর এক পদোন্নতি পেয়েছেন, যা প্রশ্নের সৃষ্টি করেছে।

স্বাস্থ্য বিভাগের সূত্র জানিয়েছে, সুজন বড়ুয়া রাঙামাটি জেলার স্যানিটারি ইন্সপেক্টর পদে যোগদানের সময় ভুয়া ঠিকানা ব্যবহার করেছিলেন এবং দ্রুত বদলি হয়ে বান্দরবান থেকে ফেনীতে গিয়েছিলেন। সেখানে তিনি জেলা স্যানিটারি ইন্সপেক্টর পদে পদোন্নতি পান, পরে জেলা স্বাস্থ্য তত্ত্বাবায়ক পদে উন্নীত হন।

চট্টগ্রাম জেলা সিভিল সার্জন অফিসের একজন কর্মকর্তা বলেন, সুজনের অপরাধগুলো তদন্ত করা প্রয়োজন এবং আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত। আওয়ামী লীগের কিছু নেতার আশ্রয়-প্রশ্রয়ের কারণে এতদিন তার কিছু হয়নি। এছাড়া, কিছু স্বাস্থ্য বিভাগের কিছু অসাধু কর্মকর্তা এখনও তাকে রক্ষা করার চেষ্টা করছেন। যার কারণে তিনি এখনও সিভিল সার্জন অফিসে প্রভাব বিস্তার করছেন, বিভিন্নজনকে হয়রানি করছেন।

আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর “বর্তমান পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে নিরাপত্তাহীনতায়” ভোগার বিষয়ে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম জেলা স্বাস্থ্য তত্ত্বাবধায়ক সুজন বড়ুয়া কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলেন, “আমি তো আবেদন করিনি।” আবেদনের কপি একুশে পত্রিকার কাছে আছে বলার পর তিনি বলেন, “আবেদনটি কে করেছে, জানি না।”

সনদ জালিয়াতি করে চাকরি নেওয়ার অভিযোগের বিষয়ে সুজন বড়ুয়া বলেন, “অভিযোগগুলো সত্যি না। এই বিষয়ে মামলা চলতেছে। হাইকোর্ট থেকে স্থগিতাদেশ আছে তো, এটা নিয়ে কথা বলার সুযোগ নেই।”