নজরুল কবির দীপু : বড়দিন, যা ক্রিসমাস নামেও পরিচিত, বিশ্বের অন্যতম প্রধান উৎসব। এটি খ্রিষ্ট ধর্মাবলম্বীদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উৎসবগুলির মধ্যে একটি। প্রতি বছর ২৫শে ডিসেম্বর তারিখে যিশুখ্রিষ্টের জন্মদিন উপলক্ষে এই উৎসব পালিত হয়। এই দিনটি শুধু খ্রিষ্টানদের জন্য নয়, বরং জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকলের জন্য এক আনন্দ ও মিলনের বার্তা নিয়ে আসে।
বড়দিনের ইতিহাস প্রায় দুই হাজার বছর পুরনো। বাইবেলের নতুন নিয়ম অনুসারে, বেথলেহেম শহরে কুমারী মেরীর গর্ভে যিশুর জন্ম হয়। মেরীর স্বামী জোসেফ ছিলেন একজন কাঠমিস্ত্রী। যিশুর জন্ম এক গোয়ালঘরে হয়েছিল, কারণ সেই সময় মেরী ও জোসেফের থাকার কোনো জায়গা ছিল না। যিশুর জন্মকালে এক উজ্জ্বল তারা আকাশে দেখা যায়, যা জ্ঞানী ব্যক্তিদের পথ দেখিয়েছিল এবং তারা এসে নবজাতককে শ্রদ্ধা জানিয়েছিল।
বড়দিন বিভিন্ন ঐতিহ্য ও প্রথার সাথে জড়িত। এর মধ্যে কয়েকটি উল্লেখযোগ্য হলো ক্রিসমাস ট্রি। এটি সাধারণত সবুজ রঙের ফার গাছ হয়ে থাকে, যা আলো, তারা, ঘণ্টা, খেলনা এবং অন্যান্য অলঙ্কার দিয়ে সাজানো হয়। ক্রিসমাস ট্রির শীর্ষে একটি তারা বসানো হয়, যা বেথলেহেমের তারার প্রতীক। উপহার আদান-প্রদান বড়দিনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। বন্ধু-বান্ধব ও পরিবারের সদস্যরা একে অপরের সাথে উপহার বিনিময় করে। এটি ভালোবাসার ও স্নেহের প্রতীক।
ক্রিসমাস ক্যারল, অর্থাৎ বড়দিনের গান বা স্তোত্র এই উৎসবের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। এই গানগুলি যিশুর জন্ম ও বড়দিনের তাৎপর্য নিয়ে রচিত। বড়দিনে বিশেষ ভোজের আয়োজন করা হয়, যেখানে পরিবারের সদস্যরা একসাথে খাবার খায়। টার্কি রোস্ট, হ্যাম, আলু, সবজি এবং ক্রিসমাস পুডিং এই ভোজের প্রধান আকর্ষণ। সান্তা ক্লজ বড়দিনের একটি জনপ্রিয় চরিত্র। তিনি উত্তর মেরুতে বাস করেন এবং ক্রিসমাসের রাতে শিশুদের জন্য উপহার নিয়ে আসেন বলে বিশ্বাস করা হয়।
বড়দিন শুধু একটি ধর্মীয় উৎসব নয়, এটি মানবতা, প্রেম, ক্ষমা ও মিলনের উৎসব। এই দিনটি আমাদের মনে করিয়ে দেয় যিশুর শান্তির বাণী, ভালোবাসার কথা। বড়দিন আমাদের সকলকে একসাথে এসে আনন্দ ভাগ করে নিতে উৎসাহিত করে। এটি আমাদের মধ্যেকার ভেদাভেদ ভুলে গিয়ে মানবতাকে সম্মান জানাতে শেখায়।
বড়দিনের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট বেশ জটিল। যিশুর প্রকৃত জন্মতারিখ অজানা। প্রথম দিকে, খ্রীষ্টানরা ৬ই জানুয়ারীতে যিশুর জন্ম উদযাপন করত, যা “এপিফেনি” নামে পরিচিত। চতুর্থ শতাব্দীতে, পশ্চিমা চার্চ ২৫শে ডিসেম্বরকে যিশুর জন্মদিন হিসেবে গ্রহণ করে। এই তারিখটি সম্ভবত শীতকালীন অয়নকালের (Winter Solstice) সাথে সম্পর্কযুক্ত, যা বিভিন্ন পৌত্তলিক সংস্কৃতিতে উদযাপিত হত।
বিভিন্ন দেশে বড়দিন পালনের রীতি ভিন্ন ভিন্ন। জার্মানিতে ক্রিসমাস ট্রি সাজানোর প্রথা শুরু হয়। পোল্যান্ডে ক্রিসমাসের আগের রাতে ১২টি পদযুক্ত নিরামিষ খাবার খাওয়া হয়, যা ১২ জন ধর্মপ্রচারকের প্রতীক। ইতালিতে “বেফানা” নামক এক বৃদ্ধা এসে শিশুদের উপহার দিয়ে যায়, যা এপিফেনির রাতে ঘটে। মেক্সিকোতে “পসাদাস” নামক নয় রাতের উৎসব পালিত হয়, যেখানে মেরী ও জোসেফের বেথলেহেমে আশ্রয় খোঁজার ঘটনা নাটকের মাধ্যমে দেখানো হয়। সুইডেনে সেন্ট লুসিয়ার উৎসব ১৩ই ডিসেম্বরে পালিত হয়, যা আলো ও আশার প্রতীক।
আধুনিক বিশ্বে বড়দিন বিশ্বজুড়ে পালিত হয়। বিভিন্ন দেশে এই উৎসব বিভিন্ন রূপে উদযাপিত হয়, তবে এর মূল বার্তা একই থাকে – প্রেম, শান্তি ও মিলন। বড়দিন এখন শুধু খ্রিষ্টানদের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, বরং সকল ধর্মের মানুষ এই উৎসবে অংশগ্রহণ করে। এটি একটি সার্বজনীন উৎসবে পরিণত হয়েছে।
বাংলাদেশেও খ্রিষ্টান সম্প্রদায় আনন্দ ও উৎসাহের সাথে বড়দিন পালন করে। এই দিনে গির্জাগুলোতে বিশেষ প্রার্থনা সভা হয়, ঘরবাড়ি সাজানো হয়, ক্রিসমাস ট্রি বসানো হয় এবং বিশেষ ভোজের আয়োজন করা হয়। বাংলাদেশের মুসলমান সম্প্রদায়ও খ্রিষ্টানদের সাথে এই উৎসবে যোগ দেয়, যা আমাদের দেশের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।
বড়দিন হলো এক আনন্দময় উৎসব, যা আমাদের জীবনে প্রেম, শান্তি ও মিলনের বার্তা নিয়ে আসে। এই উৎসব আমাদের সকলকে একসাথে এসে আনন্দ ভাগ করে নিতে উৎসাহিত করে এবং মানবতাকে সম্মান জানাতে শেখায়। আসুন, এই বড়দিনে আমরা সকলে মিলেমিশে আনন্দ করি এবং বিশ্বের শান্তি ও সমৃদ্ধির জন্য প্রার্থনা করি।
লেখক : ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক, একুশে পত্রিকা।