নতুন করে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ: সমাধান কোন পথে?


নজরুল কবির দীপু : বাংলাদেশে নতুন করে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের ঘটনা ক্রমেই উদ্বেগজনক হয়ে উঠছে। মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের অস্থির পরিস্থিতি, বিশেষত আরাকান আর্মির নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার কারণে রোহিঙ্গারা নৌকা কিংবা অন্যান্য পথ দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করছে। সীমান্তে দুর্নীতি ও নিয়ন্ত্রণের অভাব তাদের অনুপ্রবেশ ঠেকাতে আরও কঠিন পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে। অন্তর্বর্তী সরকারের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা জানিয়েছেন, গত দুই মাসে নতুন করে প্রায় ৬০ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। এ অবস্থায় সীমান্ত পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ ও রাখাইন রাজ্যের সমস্যার সমাধানে মিয়ানমারের ওপর চাপ বাড়ানো ছাড়া আর কোনো পথ খোলা নেই।

বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্ত দীর্ঘদিন ধরেই নানা সমস্যায় জর্জরিত। সীমান্ত অঞ্চলে মাদক, অস্ত্র, এবং মানব পাচার নিয়ে বহুদিন ধরেই আলোচনা হয়ে আসছে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে, এই দুর্নীতির কারণেই রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের ঘটনাগুলো ঠেকানো সম্ভব হচ্ছে না। সীমান্তে টহল ব্যবস্থা এবং আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি শক্তিশালী করার দাবি বিভিন্ন মহল থেকে বহুবার উঠলেও কার্যকর কোনো পদক্ষেপ দেখা যায়নি।

রোহিঙ্গাদের অনুপ্রবেশ কেবল সীমান্তের সমস্যা নয়। কক্সবাজারসহ আশপাশের এলাকাগুলোতেও এটি আর্থ-সামাজিক এবং পরিবেশগত সংকট তৈরি করেছে। রোহিঙ্গাদের উপস্থিতি সেই এলাকায় বিশাল জনসংখ্যার চাপ সৃষ্টি করেছে, যা স্থানীয় জনগণের জীবনযাত্রার মান নষ্ট করছে।

রোহিঙ্গাদের মধ্যে অপরাধপ্রবণতা আশঙ্কাজনক হারে বেড়েছে। কক্সবাজার ও উখিয়ার রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে একাধিক সশস্ত্র সন্ত্রাসী গ্রুপ গড়ে উঠেছে। মাদক ব্যবসা, আধিপত্য বিস্তার, এবং অন্যান্য অপরাধমূলক কার্যক্রম ক্যাম্পের ভেতরে ও বাইরে ছড়িয়ে পড়েছে। শুধু তাই নয়, কক্সবাজার এবং বান্দরবানের সীমান্তবর্তী এলাকা, বিশেষত নাইক্ষ্যংছড়ির ঘুমধুম ও আশপাশের দ্বীপগুলোতে অপরাধীদের ঘাঁটি তৈরির খবর পাওয়া গেছে।

এই পরিস্থিতি স্থানীয় প্রশাসন এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সশস্ত্র সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলোর কার্যক্রম শুধু ক্যাম্পের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়; তারা পুরো সীমান্ত এলাকায় একটি অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি করেছে। ফলে, এই অঞ্চল নিরাপত্তার জন্য একটি ঝুঁকিপূর্ণ স্থানে পরিণত হয়েছে।

রোহিঙ্গা সংকট সমাধানের জন্য মিয়ানমারের ওপর আন্তর্জাতিক চাপ সৃষ্টি করা অত্যন্ত জরুরি। কিন্তু বাস্তবতা হলো, মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে কখনোই আন্তরিক ছিল না। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের চাপের মুখে মিয়ানমার বারবার প্রতিশ্রুতি দিলেও কার্যকর পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হয়েছে।

বিগত সাত বছরে বাংলাদেশ বহুবার রোহিঙ্গাদের স্বদেশে প্রত্যাবাসনের চেষ্টা করেছে। কিন্তু মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ সংঘাত এবং তাদের সরকারের অনীহা এই প্রক্রিয়াকে অসম্ভব করে তুলেছে। আন্তর্জাতিক মহলের আগ্রহও ধীরে ধীরে কমে গেছে। বৃহৎ শক্তিগুলোর মধ্যে কেউ কেউ কেবল মৌখিকভাবে মিয়ানমারের সমালোচনা করলেও বাস্তবে কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়নি।

এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের কূটনৈতিক তৎপরতা চালিয়ে যাওয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে প্রত্যাবাসনের জন্য একটি আন্তর্জাতিক সমাধান খুঁজে বের করা ছাড়া বাংলাদেশের জন্য অন্য কোনো দীর্ঘমেয়াদি উপায় নেই।

রোহিঙ্গারা বাস্তুচ্যুত জনগোষ্ঠী। তাদের অনেকেই চরম দারিদ্র্য এবং ভবিষ্যৎ নিয়ে অনিশ্চয়তায় ভুগছে। এই হতাশাজনক পরিস্থিতি থেকে তারা উগ্রবাদী গোষ্ঠীগুলোর প্রভাবে পড়ে যেতে পারে। আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, যদি দ্রুত রোহিঙ্গা সংকটের সমাধান না করা যায়, তবে এই জনগোষ্ঠীর উগ্রবাদে জড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা বাড়বে। এটি শুধু বাংলাদেশ নয়, পুরো অঞ্চলের নিরাপত্তার জন্য বড় হুমকি হয়ে দাঁড়াবে।

উগ্রবাদের বিস্তার ঠেকাতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিশ্বের শক্তিশালী দেশগুলোর উচিত মিয়ানমারের ওপর চাপ সৃষ্টি করা, যাতে তারা রোহিঙ্গাদের ফেরত নেওয়ার বিষয়ে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়। একইসঙ্গে, রোহিঙ্গাদের জন্য শিক্ষা এবং পুনর্বাসন কার্যক্রম পরিচালনার মাধ্যমে তাদের মধ্যে হতাশা এবং উগ্রবাদী চিন্তার বিস্তার রোধ করা যেতে পারে।

বাংলাদেশ ইতোমধ্যেই রোহিঙ্গা সংকটের কারণে প্রচুর চাপে রয়েছে। বিপুল সংখ্যক রোহিঙ্গা শরণার্থীকে আশ্রয় দেওয়ার ফলে অর্থনৈতিক, সামাজিক, এবং পরিবেশগত সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে। এই পরিস্থিতিতে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে কূটনৈতিক তৎপরতা আরও জোরদার করা অত্যন্ত প্রয়োজন।

প্রথমত, সীমান্ত এলাকায় অনুপ্রবেশ বন্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। সীমান্তে টহল এবং নজরদারি বাড়াতে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করা যেতে পারে।

দ্বিতীয়ত, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের বিষয়টি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের এজেন্ডায় ফিরিয়ে আনতে হবে। জাতিসংঘসহ অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থার সঙ্গে নিবিড় যোগাযোগ রক্ষা করে মিয়ানমারের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে হবে।

তৃতীয়ত, রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় শক্তিশালী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। ক্যাম্পগুলোর ভেতরে এবং আশপাশের এলাকায় অপরাধপ্রবণতা রোধে বিশেষ বাহিনী মোতায়েন করা যেতে পারে।

চতুর্থত, রোহিঙ্গাদের জন্য পুনর্বাসন এবং প্রশিক্ষণ কার্যক্রম পরিচালনা করা উচিত, যাতে তারা কোনো অপরাধমূলক বা উগ্রবাদী কার্যক্রমে যুক্ত না হয়।

রোহিঙ্গা সংকটের দ্রুত সমাধান না হলে বাংলাদেশের জন্য দীর্ঘমেয়াদি নানা সমস্যা সৃষ্টি হতে পারে। একদিকে, রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে অপরাধপ্রবণতা বাড়বে, অন্যদিকে সীমান্ত এলাকার নিরাপত্তা আরও ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠবে। এ ছাড়া, রোহিঙ্গাদের উগ্রবাদে জড়িয়ে পড়ার ঝুঁকি পুরো অঞ্চলের স্থিতিশীলতাকে নষ্ট করতে পারে।

এই সংকটের সমাধান না হলে বিভিন্ন গোষ্ঠী এই পরিস্থিতিকে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করতে পারে। ফলে, শুধু বাংলাদেশ নয়, পুরো দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলেই অস্থিরতা বাড়তে পারে।

শেষ কথা- রোহিঙ্গা সংকট একটি জটিল ও বহুমাত্রিক সমস্যা। এটি সমাধানে কেবল বাংলাদেশ নয়, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়েরও কার্যকর ভূমিকা প্রয়োজন। মিয়ানমারের ওপর চাপ সৃষ্টি করে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিশ্চিত করা ছাড়া এই সংকটের দীর্ঘমেয়াদি সমাধান সম্ভব নয়।

বাংলাদেশের উচিত কূটনৈতিক তৎপরতা আরও জোরদার করা এবং রোহিঙ্গা ইস্যুতে আন্তর্জাতিক সমর্থন অর্জনে মনোযোগ দেওয়া। পাশাপাশি, সীমান্ত পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ এবং রোহিঙ্গাদের পুনর্বাসন কার্যক্রমে গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন। রোহিঙ্গা সংকটের সমাধান কেবল বাংলাদেশ নয়, পুরো অঞ্চলের নিরাপত্তা এবং স্থিতিশীলতার জন্যই অপরিহার্য।

লেখক : ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক, একুশে পত্রিকা।