বিদেশগামী রোগীর সংখ্যা কীভাবে কমানো যাবে?


নজরুল কবির দীপু : সঠিক চিকিৎসা পাওয়া প্রত্যেক মানুষের মৌলিক অধিকার। এটি কেবল একটি মানবিক প্রত্যাশা নয়, বরং একটি রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব। দেশের প্রতিটি নাগরিককে নির্ভুল চিকিৎসাসেবা দেওয়ার দায়িত্ব সরকারের। কিন্তু বর্তমানে বাংলাদেশের চিকিৎসাব্যবস্থা নানা সংকটে জর্জরিত। বিশেষত, ভারতের সঙ্গে সাম্প্রতিক বৈরী সম্পর্ক এবং ভিসা বন্ধ থাকায় অনেক রোগী মারাত্মক সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন। তারা সঠিক চিকিৎসা না পেয়ে জীবনহানির ঝুঁকিতে রয়েছেন। এই পরিস্থিতি উত্তরণে দেশের চিকিৎসাব্যবস্থার মানোন্নয়ন অত্যন্ত জরুরি। এখানে গড়িমসি করার কোনো সুযোগ নেই। কারণ, চিকিৎসাক্ষেত্রে অব্যবস্থাপনা মানুষের জীবনকেই হুমকির মুখে ফেলতে পারে।

দেশে চিকিৎসাব্যবস্থার প্রতি মানুষের আস্থা দিন দিন হ্রাস পাচ্ছে। ফলে জীবন বাঁচানোর তাগিদে অনেকেই বিদেশে চিকিৎসা নিতে বাধ্য হচ্ছেন। এটি শুধু সাধারণ মানুষের ক্ষেত্রেই নয়; ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, সরকারি আমলা এবং জনপ্রতিনিধিদের ক্ষেত্রেও একই চিত্র দেখা যায়। অধিকাংশ রোগী ভারত, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, সৌদি আরব, এবং আমেরিকার মতো দেশে উন্নত চিকিৎসার জন্য যাচ্ছেন।

এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, প্রতিদিন বাংলাদেশ থেকে প্রায় ৮ থেকে ১০ হাজার রোগী ভারতে যায়। এর মধ্যে প্রায় ৭০ শতাংশ রোগী চিকিৎসার জন্য যান। চিকিৎসার জন্য ভারতে যাওয়া রোগীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, দেশে সঠিক রোগ নির্ণয় না হওয়া, ভুল চিকিৎসা এবং চিকিৎসকদের দুর্ব্যবহারের কারণে রোগীরা দেশের চিকিৎসাব্যবস্থার ওপর আস্থা হারিয়েছেন। ফলে তারা জীবন বাঁচানোর জন্য বিদেশে যাচ্ছেন।

বিদেশে চিকিৎসা নিতে গিয়ে রোগীদের বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় করতে হয়। প্রতিবছর বাংলাদেশের রোগীরা চিকিৎসার জন্য ভারতে প্রায় ২০ থেকে ২৫ হাজার কোটি টাকা নিয়ে যাচ্ছেন। এটি দেশের অর্থনীতির জন্য একটি বিরাট ক্ষতি। শুধু অর্থনৈতিক ক্ষতিই নয়, এতে দেশের মর্যাদাও ক্ষুণ্ণ হয়। চিকিৎসার জন্য বিদেশমুখী হওয়ার প্রধান কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে সঠিক রোগ নির্ণয়ের অভাব, চিকিৎসকদের অমনোযোগীতা, এবং হাসপাতালের অব্যবস্থাপনা।

দেশে চিকিৎসাব্যবস্থার ওপর আস্থার অভাবের প্রধান কারণ হলো চিকিৎসাখাতের অব্যবস্থাপনা। প্রতিটি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ডাক্তার সংকট দেখা যায়। অধিকাংশ স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে যেখানে ২০ জন ডাক্তারের পদ থাকা উচিত, সেখানে মাত্র ৫-৬ জন ডাক্তার কাজ করছেন। ফলে এই স্বল্পসংখ্যক ডাক্তারদের পক্ষে ছুটি কাটানো বা জরুরি রোগী সামলানোর পর বহির্বিভাগে রোগী দেখা কার্যত অসম্ভব হয়ে পড়ে। এতে প্রতি উপজেলায় ৩-৪ লাখ মানুষের চিকিৎসা সংকট তৈরি হয়।

২০১৮ সালের একটি পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, দেশে প্রতি ৬,৫৭৯ জন মানুষের জন্য একজন সরকারি ডাক্তার রয়েছেন। এটি উন্নত দেশগুলোর তুলনায় অত্যন্ত কম। উদাহরণস্বরূপ, গ্রিসে প্রতি ২২৮ জনে একজন, স্পেনে ২০০ জনে একজন, এবং আমেরিকায় প্রতি ২৭৮ জনে একজন ডাক্তার সেবা দিয়ে থাকেন।

উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলোতে চিকিৎসকদের বসার এবং থাকার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেই। এছাড়া, রোগ নির্ণয়ের জন্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতির অভাব, টেকনিশিয়ানের স্বল্পতা, এবং আধুনিক প্রযুক্তির অভাবও দেশের চিকিৎসাব্যবস্থাকে পিছিয়ে রেখেছে। সরকারি হাসপাতালগুলোতে প্রয়োজনীয় পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রমের অভাব রয়েছে। অনেক হাসপাতাল অপরিষ্কার এবং দুর্গন্ধযুক্ত পরিবেশে পরিচালিত হচ্ছে। কিছু কিছু হাসপাতাল যেন নিজেরাই রোগীতে পরিণত হয়েছে।

এছাড়া বাংলাদেশে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের সংখ্যা খুবই কম। বিশেষজ্ঞ ডিগ্রি অর্জনের জন্য পর্যাপ্ত আসন নেই, এবং অনেক মেধাবী চিকিৎসক দেশের বাইরে চলে যাচ্ছেন। এর ফলে দেশের চিকিৎসাব্যবস্থায় বিশেষজ্ঞদের সংকট দিন দিন বাড়ছে। এছাড়া, প্রশ্নফাঁসের মাধ্যমে অযোগ্য শিক্ষার্থীরা চিকিৎসক হওয়ার সুযোগ পাচ্ছে, যা দেশের চিকিৎসাব্যবস্থাকে আরও দুর্বল করছে।

উপজেলা এবং জেলা পর্যায়ে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের অভাব একটি বড় সমস্যা। অধিকাংশ হাসপাতালে রোগ নির্ণয়ের জন্য আধুনিক যন্ত্রপাতি নেই। যেসব যন্ত্রপাতি রয়েছে, তার অনেকগুলো অকেজো অবস্থায় পড়ে আছে। টেকনিশিয়ানের অভাবে অনেক আধুনিক যন্ত্রপাতি ব্যবহার করা সম্ভব হচ্ছে না। ডাক্তারদের পরামর্শ অনুযায়ী রোগ নির্ণয়ের ক্ষেত্রে ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোতে কমিশন বাণিজ্যের অভিযোগও রয়েছে।

অন্যদিকে দেশের চিকিৎসকরা প্রায়ই নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে কাজ করেন। গ্রামের অশিক্ষিত এবং স্বল্পশিক্ষিত মানুষ সামান্য কারণেও চিকিৎসকদের ওপর হামলা চালায়। চিকিৎসকদের দুর্ব্যবহার এবং রোগীদের কম সময় দেওয়া দেশের চিকিৎসাব্যবস্থার প্রতি আস্থা নষ্ট করছে। সরকারি হাসপাতালে ডাক্তারদের মনোনীত ডায়াগনস্টিক সেন্টারে রোগীদের পাঠানোর প্রবণতাও একটি বড় সমস্যা।

এছাড়া দেশের চিকিৎসাব্যবস্থার আরেকটি বড় সমস্যা হলো চিকিৎসা ব্যয়ের অসামঞ্জস্য। নিম্নমানের এবং মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ বাজারে পাওয়া যাচ্ছে, যা রোগীদের জীবনের জন্য হুমকি। ভুল রোগ নির্ণয় এবং ভুল অপারেশন অনেক রোগীর জীবনহানির কারণ হচ্ছে। এছাড়া, ওষুধের দাম বৃদ্ধি এবং অপ্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য রোগীরা আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।

দেশে কিছু উন্নতমানের হাসপাতাল যেমন নিউরোসায়েন্স হাসপাতাল, জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউট, জাতীয় হার্ট ফাউন্ডেশন, এবং বার্ন ইনস্টিটিউট রয়েছে, যেখানে উন্নত চিকিৎসা সেবা প্রদান করা হয়। এই ধরনের আরও হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করা জরুরি। চিকিৎসকদের সঠিক মূল্যায়ন এবং উন্নত যন্ত্রপাতি সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে।

দেশের চিকিৎসাব্যবস্থার মানোন্নয়নে কিছু গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ গ্রহণ জরুরি। প্রথমত, মেধাবী এবং দক্ষ চিকিৎসকদের সঠিকভাবে মূল্যায়ন করতে হবে। তাদের জন্য পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা এবং নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। দ্বিতীয়ত, ঢাকাকেন্দ্রিক চিকিৎসাসেবা ব্যবস্থা পরিবর্তন করে জেলা এবং উপজেলা পর্যায়ে আধুনিক হাসপাতাল স্থাপন করতে হবে। এছাড়াও, হাসপাতালগুলোতে আধুনিক যন্ত্রপাতি এবং প্রয়োজনীয় টেকনিশিয়ানের ব্যবস্থা করতে হবে। চিকিৎসা ক্ষেত্রে রাজনৈতিক প্রভাব সম্পূর্ণরূপে বন্ধ করতে হবে। ডাক্তারদের পোস্টিং এ বিষয়ে কোন রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ গ্রহণযোগ্য নয়।

চিকিৎসা ব্যয় কমানোর জন্য কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে এবং ওষুধের মান নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের সংখ্যা বৃদ্ধির জন্য বিশেষজ্ঞ ডিগ্রি প্রাপ্তির আসন সংখ্যা বাড়াতে হবে। ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোর কার্যক্রমের উপর নজরদারি বাড়াতে হবে এবং সঠিক রিপোর্ট নিশ্চিত করার জন্য কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে। চিকিৎসকদের সেবামূলক মনোভাব এবং দক্ষতা উন্নত করার জন্য নিয়মিত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে।

পরিশেষে বলা যায়, সঠিক চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করতে হলে দেশের চিকিৎসাব্যবস্থার প্রতি জনগণের আস্থা ফিরিয়ে আনতে হবে। এটি কেবলমাত্র চিকিৎসকদের আন্তরিকতা এবং সরকারের কার্যকর উদ্যোগের মাধ্যমে সম্ভব। দেশে উন্নতমানের হাসপাতাল এবং দক্ষ চিকিৎসক তৈরির মাধ্যমে রোগীদের বিদেশমুখী হওয়ার প্রবণতা বন্ধ করা যাবে। এতে দেশের অর্থনৈতিক ক্ষতি হ্রাস পাবে এবং দেশের মর্যাদা বৃদ্ধি পাবে। জনগণের মৌলিক অধিকার রক্ষা করতে হলে চিকিৎসাব্যবস্থার সার্বিক উন্নয়ন এখন সময়ের দাবি।

লেখক : ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক, একুশে পত্রিকা।