বিদেশে কর্মী পাঠানো কমেছে ২৪%, নতুন শ্রমবাজার খোলেনি


একুশে ডেস্ক: চলতি বছর বিদেশে কর্মী পাঠানো কমেছে ২৪ শতাংশ। গত বছর যেখানে ১৩ লাখ ৭ হাজার ৮৯০ জন চাকরি নিয়ে বিদেশ গিয়েছিলেন, সেখানে চলতি বছরের ১৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত এ সংখ্যা ৯ লাখ ৫২ হাজার ৬৫৮ জন। এর মধ্যে সৌদি আরবে গেছেন ৫ লাখ ৭৯ হাজার ৪২৩ জন, যা মোট জনশক্তি রপ্তানির ৬০ শতাংশ।

জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছর বাংলাদেশিদের জন্য নতুন কোনো শ্রমবাজার খোলেনি। বরং মালয়েশিয়া, মালদ্বীপের মতো পুরোনো শ্রমবাজার বন্ধ হয়ে গেছে। আগস্ট থেকে অঘোষিতভাবে বন্ধ রয়েছে সংযুক্ত আরব আমিরাতের শ্রমবাজার। যুক্তরাজ্য, ইতালি, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়ার মতো উন্নত দেশগুলোতেও বাংলাদেশিদের কর্মসংস্থানের সুযোগ সংকুচিত হয়েছে। জনশক্তি রপ্তানি অর্ধেকে নেমে এসেছে ব্রুনাইয়ে। ঘোষণা ছাড়াই বন্ধ রয়েছে মরিশাসের শ্রমবাজার।

বিএমইটির তথ্যমতে, গত বছর যুক্তরাজ্যে ১০ হাজার ৩৪৭ জন কর্মী গেলেও এ বছর তা কমে ৩ হাজার ৫০৮ জনে দাঁড়িয়েছে। ইতালিতে গত বছর ১৬ হাজার ৯২৬ জন কর্মীর কর্মসংস্থান হলেও এ বছর মাত্র ১ হাজার ১১২ জন, যা ৯৪ শতাংশ কম। বৈধ পথে ইতালিতে অভিবাসনের সুযোগ কমে যাওয়ায় ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে মানব পাচার বেড়েছে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।

গত বছরের অক্টোবরে বাংলাদেশ থেকে কর্মী নিয়োগ বন্ধ করে দেয় ওমান। সরকারি পর্যায়ে দেনদরবারে মধ্যপ্রাচ্যের দেশটি উচ্চ আয়ের পর্যটক, পেশাজীবীসহ কয়েকটি খাতে ভিসা নিষেধাজ্ঞা শিথিল করলেও কর্মী নিতে রাজি হয়নি। গত মে মাসে বন্ধ হয়ে যায় বহুল আলোচিত মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার। ২০১৭ সাল থেকে বন্ধ রয়েছে বাহরাইনের শ্রমবাজার। চলতি বছর একজন কর্মীও নেয়নি দেশটি।

সৌদি আরবে কর্মসংস্থানের কারণে জনশক্তি রপ্তানি বেশি মনে হলেও দেশটিতে যাওয়া কর্মীদের অনেকেই কাজ পাচ্ছেন না বলে অভিযোগ রয়েছে। আইনে নিষিদ্ধ হলেও কর্মীপ্রতি ২ থেকে আড়াই লাখ টাকায় ‘ভিসা কেনা’ হচ্ছে। নিয়োগকারীরা এ বাণিজ্যের জন্যই চাকরির নিশ্চয়তা ছাড়াই কর্মী নিয়ে টাকা কামাচ্ছেন। ‘ভিসা কিনতে’ দেশ থেকে টাকা পাচার হচ্ছে; আবার সৌদি আরব থেকেও আসছে না প্রত্যাশিত রেমিট্যান্স।

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পতনে ক্ষমতায় আসে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার। জনশক্তি ব্যবসায়ীরা আশায় ছিলেন, এ নোবেলজয়ীর ভাবমূর্তি কাজে লাগিয়ে বৈদেশিক কর্মসংস্থান বাড়ানো যাবে। প্রধান উপদেষ্টা এবং উপদেষ্টারা বক্তৃতায় প্রবাসীদের গুরুত্ব দেওয়ার কথা বললেও, কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে উদ্যোগ দেখা যায়নি।

মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিম ঢাকায় এসে ড. ইউনূসকে পাশে নিয়ে ঘোষণা দিয়েছিলেন, নির্ধারিত সময়ে তাঁর দেশে যেতে না পারা ১৭ হাজার বাংলাদেশি নিয়োগ পাবেন। কিন্তু তিন মাসে একজনও যেতে পারেননি। আগস্ট-সেপ্টেম্বরের ধসের পর অক্টোবর ও নভেম্বরে লাখের বেশি কর্মী বিদেশ গেছেন। তবে তাদের ৮০ শতাংশের বেশি সৌদি আরব গেছেন।

ইউরোপ, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়ায় শ্রমবাজার খোঁজার কথা প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয় বহু বছর ধরে বললেও, পরিসংখ্যান অনুযায়ী এসব দেশে যাওয়া কর্মীর সংখ্যা নগণ্য। গত বছর ৯ হাজার ৯৫৬ কর্মী রোমানিয়া যাওয়ার ছাড়পত্র নেন। এ বছর তা কমে ৩ হাজার ৫২৮ জনে দাঁড়িয়েছে।

বাংলাদেশ থেকে রোমানিয়া কার্যক্রম গুটিয়ে নেওয়ায় দেশটির ভিসা নিতে হয় দিল্লি থেকে। ৮-৯ লাখ টাকায় পূর্ব ইউরোপের এ দেশটিতে কর্মী পাঠায় রিক্রুটিং এজেন্সি। অধিকাংশ ক্ষেত্রে এজেন্সি সরাসরি নয়, দালালের মাধ্যমে কর্মী সংগ্রহ করে। রোমানিয়া হয়ে ইউরোপে পাঠানোর প্রলোভন দেখিয়ে কর্মী সংগ্রহ করে দালালরা।

ধারণা করা হয়, গত তিন বছরে রোমানিয়া থেকে ইউরোপের অন্যান্য দেশে পালিয়ে যাওয়া বাংলাদেশি কর্মীর সংখ্যা ২০ হাজারের বেশি। তাই নতুন ভিসা দিচ্ছে না দেশটি। আগস্টের পর ভারত ভিসা বন্ধ করায়, রোমানিয়ার ভিসার জন্য দিল্লি যেতে পারছেন না কর্মীরা। একই অবস্থা ইউরোপের দেশ পোল্যান্ড ও ক্রোয়েশিয়ার। গত বছর পোল্যান্ড যেতে ছাড়পত্র নেন ২ হাজার ৬৬ কর্মী; এ বছর ২০২ জন।

চলতি বছরে ১২ হাজার ৫২১ কর্মী কিরগিজস্তান যেতে ছাড়পত্র নিয়েছেন। গত বছর নিয়েছিলেন ১ হাজার ৭২০ জন। জনশক্তি ব্যবসায়ীদের সূত্রের খবর, মধ্য এশিয়ার দেশটিতে হাজার হাজার কর্মী যাচ্ছেন মূলত ইউরোপে ঢোকার প্রলোভনে।

বিএমইটির তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছর মালয়েশিয়া গেছেন ৯৩ হাজার ৩৫৬ জন। তবে তাদের ৯৯ শতাংশ গেছেন গত মে মাসে শ্রমবাজার বন্ধের আগে। আরেক পুরোনো শ্রমবাজার আরব আমিরাতে ৪৭ হাজার ১৪৩ কর্মী গেছেন চলতি বছর।

শুধু মে মাসেই লাখের বেশি কর্মী ছাড়পত্র নিয়েছেন। মে মাসে ১ লাখ ৩১ হাজার ৬৯৬ কর্মী ছাড়পত্র নেন। তাদের মধ্যে ৪৭ হাজার ৮০৯ জন মালয়েশিয়া যেতে ছাড়পত্র নিয়েছিলেন। কারণ ৩১ মে মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার বন্ধ হয়ে যায়। মে বাদে বছরের বাকি পাঁচ মাসেই ছাড়পত্র নেওয়া কর্মীর সংখ্যা লাখের কম। জুনে মাত্র ৫৫ হাজার ৪৫ কর্মীর ছাড়পত্র দেওয়া হয়েছে, যা করোনাকালের পর তিন বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন।

প্রতিশ্রুত চাকরি এবং বেতন নিশ্চয়তার জন্য বাংলাদেশি কর্মীদের জন্য অন্যতম সেরা শ্রমবাজার দক্ষিণ কোরিয়া ও জাপান। ভাষাগত ও কাজের দক্ষতার পরীক্ষা নিয়ে দেশ দুটি কর্মী নিয়োগ করে। গত বছর ১০ হাজার কর্মী নিয়োগের কোটা দিয়েছিল দক্ষিণ কোরিয়া, গিয়েছিল ৪ হাজার ৪৯৬ জন। চলতি বছর গেছেন ২ হাজার ৯১৮ জন।

বেসরকারি সংস্থা অভিবাসী উন্নয়ন কর্মসূচির (ওকাপ) নির্বাহী পরিচালক শাকিরুল ইসলাম বলেছেন, দক্ষ কর্মী না থাকায় বাংলাদেশিদের কর্মসংস্থান সৌদি আরব এবং মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর উপর নির্ভরশীল। এসব দেশে ভিসা কেনাবেচা, প্রতারণা, নির্ধারিত অভিবাসন ব্যয়ের কয়েক গুণ টাকা আদায়সহ নানা অনিয়ম হয়। দক্ষ কর্মী তৈরি ছাড়া কর্মসংস্থান বাড়বে না। নতুন শ্রমবাজার তৈরিতে সরকারকে উদ্যোগ নিতে হবে।

জনশক্তি ব্যবসায়ীদের সংগঠন বায়রার নেতা ফখরুল ইসলাম বলেন, আর্থিক সংকটে সব দেশেই কর্মসংস্থান কমছে। ব্যবসায়ীরা ঝুঁকি নিয়ে নতুন শ্রমবাজার খুঁজছেন না।

সূত্র: সমকাল