সয়াবিন তেলের সংকট: ব্যবসায়ীদের কারসাজি নাকি প্রকৃত সমস্যা?


ঢাকা : সয়াবিন তেল নিয়ে দেশের বাজারে যে নাটক চলছিল, তা অবশেষে একটি নতুন বাঁকে পৌঁছেছে। কয়েক দিন আগে বাজার থেকে হারিয়ে যাওয়া বোতলজাত সয়াবিন তেল আবার ফিরে এসেছে, তবে তার দাম বেড়েছে। গতকাল সোমবার, সরকারের পক্ষ থেকে তেলের দাম বাড়ানোর ঘোষণা দেওয়ার পর থেকেই দোকানে দোকানে দেখা যাচ্ছে সয়াবিন তেলের বোতল। বাজারে যেন তেলের ঢল নেমেছে, কিন্তু দাম আগের চেয়ে অনেক বেশি।

এই পরিস্থিতি নিয়ে ক্রেতারা ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। কিছু অসাধু ব্যবসায়ী তাদের কারসাজিতে প্রমাণ করেছেন যে, আসলে তেলের কোনো সংকট ছিল না। বাজারে সয়াবিন তেলের সংকট দেখিয়ে তারা একদিকে দাম বাড়িয়েছেন, অন্যদিকে ক্রেতার পকেট কাটতে শুরু করেছেন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এটি এক ধরনের ‘দিনদুপুরে ডাকাতি’, যেখানে কারসাজি করে কোটি কোটি টাকা লুটেছে কিছু অসাধু ব্যবসায়ী।

কিন্তু সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হল, এই কারসাজি নিয়ে সরকারের ভূমিকা কী? অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব গ্রহণের পরও এই ধরনের পরিস্থিতি সৃষ্টি হওয়ার কারণ নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠছে। ভোক্তাদের ধারণা, আজ তেল, কাল চিনি বা পরশু অন্য কোনো পণ্যের কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করা হতে পারে, যাতে সিন্ডিকেটের সদস্যরা অবাধে লাভবান হতে পারে। এমন পরিস্থিতি রোধ করতে বাজারে প্রতিযোগিতার সৃষ্টি এবং ছোট ব্যবসায়ীদের জন্য আমদানির সুযোগ তৈরি করা প্রয়োজন।

গতকাল বাণিজ্য উপদেষ্টা সেখ বশির উদ্দিন সয়াবিন তেলের দাম প্রতি লিটারে ৮ টাকা বাড়ানোর ঘোষণা দিয়েছেন। এর ফলে, বোতলজাত সয়াবিন তেলের দাম এখন হবে ১৭৫ টাকা, যা আগে ছিল ১৬৭ টাকা। আর খোলা সয়াবিন তেলের দাম বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৫৭ টাকায়। এমনকি, পাঁচ লিটারের বোতলজাত সয়াবিন তেলের দাম ৮৫২ টাকা হয়ে গেছে, যা আগে ছিল ৮১৮ টাকা। এই দাম বাড়ানোর ফলে ভোক্তার ওপর চাপ আরও বাড়বে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

বাজারে সয়াবিন তেলের সরবরাহ বেড়ে যাওয়ার পরও দাম বৃদ্ধি কেন? এ বিষয়ে সেখ বশির উদ্দিন জানিয়েছেন, আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় স্থানীয় মজুতদারি বেড়েছে। তবে তিনি বলেন, দেশে মজুতের কোনো ঘাটতি নেই, কিন্তু ব্যবসায়ীরা তেল মজুত করে দাম বাড়ানোর চেষ্টায় রয়েছে। এই প্রেক্ষাপটে, ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণে আরও কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার প্রয়োজনীয়তা মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

এদিকে, বাংলাদেশের খাদ্য মূল্যস্ফীতি এখন অস্বাভাবিক উচ্চতায় পৌঁছেছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ হিসাবে, নভেম্বর মাসে খাদ্য মূল্যস্ফীতি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৩ দশমিক ৮০ শতাংশে। এর মধ্যে সয়াবিন তেলের দাম বৃদ্ধির ঘোষণা ভোক্তার পকেট কাটবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন অনেকেই।

বাংলাদেশ এডিবল অয়েল অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মোস্তফা হায়দার জানিয়েছেন, আন্তর্জাতিক বাজারের পরিবর্তনের কারণে দেশে তেলের দাম বাড়ানো হয়েছে। তবে তিনি আরও বলেছেন, এই দাম নির্ধারণের পদ্ধতি দীর্ঘদিন ধরে চলে আসছে এবং এটির সঙ্গে প্রক্রিয়াজাত খরচও যোগ করা হয়।

অপরদিকে, কনজ্যুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সহসভাপতি এস এম নাজের হোসাইন অভিযোগ করেছেন, বাজারে সয়াবিন তেলের সংকট সৃষ্টির মাধ্যমে ব্যবসায়ীরা দাম বাড়ানোর সুযোগ নিয়েছেন। তিনি বলেন, “যতদিন এই ধরনের অপসংস্কৃতি চলবে, ততদিন সাধারণ মানুষের পকেট কাটার খেলা চলতেই থাকবে।”

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক সেলিম রায়হান জানিয়েছেন, বাংলাদেশের বাজারে কিছু বড় কোম্পানি ভোজ্যতেল আমদানি এবং বাজারজাত করে, এবং তারা পুরো বাজার নিয়ন্ত্রণ করে। তিনি বলেন, “তেলের সংকট আসলে ছিল না, বরং ব্যবসায়ীরা সংকট সৃষ্টি করে সরকারের সঙ্গে দর-কষাকষি করতে চেয়েছিল।”

এছাড়া, তিনি প্রতিযোগিতা সৃষ্টির জন্য ছোট ব্যবসায়ীদের বাল্কে ভোজ্যতেল আমদানির সুযোগ দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। এই ধরনের পদক্ষেপ বাজারে সঠিক প্রতিযোগিতা সৃষ্টি করতে সাহায্য করবে এবং ব্যবসায়ীদের কারসাজি বন্ধ করতে সহায়তা করবে।

তেলের দাম বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে বাজারে অন্যান্য পণ্যের মূল্যবৃদ্ধির আশঙ্কাও রয়েছে। ফলে, সরকার ও ব্যবসায়ী মহলকে আরও সতর্ক থাকতে হবে, যাতে ভোক্তার স্বার্থ সুরক্ষিত থাকে এবং বাজারে স্বাভাবিক মূল্য পরিস্থিতি ফিরে আসে।