বিবিসি : রাজস্থানের আজমিরের বিখ্যাত খওয়াজা মৈনুদ্দিন চিশতির দরগাহ আসলে একটি শিব মন্দিরের ওপরে বানানো হয়েছিল বলে সেখানকার আদালতে মামলা দায়ের করেছেন এক হিন্দু নেতা। মামলাটি শুনানির জন্য গ্রহণ করে সব পক্ষকে নোটিশ জারি করেছে আদালত।
হিন্দু সেনা নামের একটি সংগঠনের সভাপতি বিষ্ণু গুপ্তা সম্প্রতি মামলাটি দায়ের করেছেন। অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি হরবিলাস সারদার লেখা একটি বইয়ের সহ দরগাহ-তে যে মন্দির ছিল, তার পক্ষে তিনটি যুক্তি আদালতের সামনে পেশ করেছেন। তিনি আদালতের কাছে আবেদন করেছেন যাতে তাকে ওই ‘মন্দির’এ পুজো করার অনুমতি দেওয়া হয়।
আজমির দরগাহ-র প্রধান উত্তরাধিকারী এবং খওয়াজা মৈনুদ্দিন চিশতির বংশধর সৈয়দ নাসিরুদ্দিন চিশতি এই মামলাটিকে “সস্তায় জনপ্রিয়তা পাওয়ার কৌশল” বলে বর্ণনা করেছেন।
তার কথায়, “এরা সমাজ এবং দেশটাকে ভুল দিশায় নিয়ে যাচ্ছে।”
কিসের ভিত্তিতে মামলা দায়ের?
দরগাহ-তে যে একটি মন্দির ছিল, তার সেই দাবির স্বপক্ষে মামলাকারী বিষ্ণু গুপ্তা তিনটি যুক্তি দেখিয়েছেন।
প্রথমত:, ”ব্রিটিশ শাসনামলে আজমির পৌরসভার কমিশনার ছিলেন যে হরবিলাস সারদা, তিনি ১৯১১ সালে এক বইতে লিখেছিলেন যে দরগাহ-তে একটি মন্দির ছিল। সেই বইটিই আমার দাবির ভিত্তি।”
তিনি বলছিলেন, ”এছাড়াও, বইটি থেকে পাওয়া তথ্য আমি নিজে সেখানে গিয়ে যাচাই করে দেখেছি। হিন্দু মন্দির ভেঙ্গেই দরগাহ নির্মাণ করা হয়েছিল। দরগাহ-র প্রাচীর ও দরজার ওপরে যেসব নকশা আছে, সেগুলো হিন্দু মন্দিরের।”
”আজমিরের প্রত্যেক বাসিন্দা তাদের পূর্বপুরুষদের কাছ থেকে শুনে এসেছেন যে ওখানে একটা শিবলিঙ্গ ছিল। বাসিন্দারা বলেন যে ওখানে একটি শিবমন্দির ছিল,” জানাচ্ছিলেন মি. গুপ্তা।
বিষ্ণু গুপ্তার কথায়, “দরগাহ-টিতে আসলে সঙ্কটমোচন মহাদেবের মন্দির ছিল এবং আমি দাবি করেছি যে দরগাহ-র যদি কোনও রেজিস্ট্রেশন থাকে সেটাও বাতিল করে সেটিকে সঙ্কটমোচন মহাদেবের মন্দির হিসাবে ঘোষণা করা হোক। আমাদের সেখানে পুজো অর্চনা করার অনুমতি দেওয়া হোক।”
“দরগাহ-র ভূগর্ভস্থ ঘরটি বন্ধ করে রাখা হয়েছে। যদি সার্ভে করা হয় তাহলে সত্যটা সামনে এসে যাবে,” দাবি মি. গুপ্তার।
বিষ্ণু গুপ্তা ২০১১ সালে হিন্দু সেনা নামে একটি সংগঠন শুরু করেন, যেটি হিন্দুদের ইস্যুগুলি তুলে ধরার জন্য মাঝে মাঝেই আলোচনায় উঠে আসে।
কিছুদিন আগে মি. গুপ্তা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহকে চিঠি লিখে দাবি করেছিলেন যাতে মুসলমানদের সংখ্যালঘু মর্যাদা তুলে দেওয়া হয়। এর আগে ২০২২ সালে তিনি পপুলার ফ্রন্ট অফ ইন্ডিয়া বা পিএফআই-কে নিষিদ্ধ করার দাবি তুলেছিলেন।
কী বলছে দরগাহ কমিটি?
গত কয়েক বছর ধরে দরগাহ কমিটি ‘দরগাহ নাজিম’ বা দরগাহ-র ব্যবস্থাপক নিয়োগ করে নি। তাই ‘দরগাহ নাজিম’এর অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করেন সংখ্যালঘু দফতরের উপ-সচিব মুহম্মদ নাদিম।
মি. নাদিম বিবিসিকে বলছিলেন, “আমরা এখনও কোর্টের নোটিশ পাই নি। আদালতের নোটিশ এলে, সেটা খতিয়ে দেখে আইনি পদক্ষেপ নেওয়া হবে।”
আজমির দরগাহ-র প্রধান উত্তরাধিকারী সৈয়দ নাসিরুদ্দিন চিশতি বিবিসিকে জানিয়েছেন, “আমাদের উকিলের সঙ্গে পরামর্শ করছি যে কী করণীয় আমাদের। আইন অনুযায়ী আমরা নিজেদের বক্তব্য পেশ করব।“
তবে তিনি এই মামলার বিষয়টিকে “সস্তায় জনপ্রিয়তা পাওয়ার কৌশল” বলে বর্ণনা করেছেন।
তার কথায়, “কোনও মসজিদ বা দরগাহ-তে মন্দির আছে, সেই দাবি করে রোজই কেউ না কেউ মামলা ঠুকে দিচ্ছে। এটা ঠিক হচ্ছে না।”
মি. চিশতি বলছিলেন, “১৯১১ সালে লেখা যে বইটির কথা বলা হচ্ছে, সেটার কোনও বিশ্বাসযোগ্যতাই নেই। একটা একশো বছরের পুরনো বইয়ের ভিত্তিতে সাড়ে আটশো সালের ইতিহাসকে মিথ্যা প্রমাণ করা যায় না কি!”
দরগাহ-তে একটা মন্দির ছিল – এই দাবি ওঠার পরে মামলাটি নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে।
সম্প্রতি দেশের বিভিন্ন রাজ্যে মন্দির-মসজিদ বিতর্ক শুরু হওয়ায় সহিংসতার ঘটনাও ঘটেছে।
রাজস্থানেও এই মামলা দায়ের হওয়ার পরে উত্তেজনা দেখা যাচ্ছে। শান্তিপূর্ণ পরিবেশ যাতে কোনভাবে বিঘ্নিত না হয়, তার ওপর জোর দিচ্ছে প্রশাসন।
আজমিরের জেলা পুলিশ সুপার বন্দিতা রাণা বিবিসিকে জানিয়েছেন, “সব ধর্মীয় সমাজের সঙ্গে আমরা নিয়মিত যোগাযোগ রাখছি। মামলা আদালতে গেছে। কোর্ট নিজের মতো ফয়সালা করবে। কিন্তু শান্তিপূর্ণ পরিবেশ যাতে বিঘ্নিত না হয়, আমাদের নজর সেদিকে।”
সমাজকে একজোট হতে হবে
সৈয়দ নাসিরুদ্দিন চিশতির মনে করেছেন সমাজকে একজোট হয়ে থাকতে হবে। কিন্তু এ ধরনের মামলা আর দাবি তুলে কিছু ব্যক্তি সমাজে অস্থিরতা ছড়ানোর চেষ্টা করছেন।
তার কথায়, ‘এরা সস্তায় জনপ্রিয়তা পাওয়ার জন্য এসব করছেন, কিন্তু তারা এটা জানেন না যে এসব কর্মকাণ্ড দেশকে ভুল দিকে নিয়ে যাচ্ছে। সমাজের উচিত জোটবদ্ধ হয়ে থাকা। আর কতদিন মন্দির-মসজিদ বিবাদ তোলা হবে?
“খওয়াজা সাহেবের দরবারের ইতিহাস সাড়ে আটশো বছরের পুরনো। এই আটশো বছর ধরে জয়পুর, যোধপুর, কোটা, গোয়ালিয়র সহ সব রাজারা দরগাহ-র সঙ্গে জড়িত থেকেছেন। যদি এরকমই হয়ে থাকত, তাহলে তারাই তো প্রথমে আপত্তি তুলতেন,” বলছিলেন মি. চিশতি।
কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে তার আবেদন যে “১৯৯১ সালে পাশ হওয়া ধর্মীয়-স্থল আইনকে আরও জোরদার করা উচিত। ধর্মীয় উপাসনাস্থলগুলো নিয়ে ১৯৪৭ সালের আগে থেকে যেসব বিবাদ চলছে, সেগুলিকে পৃথক করা হোক। সেগুলির ব্যাপারে আদালতে ফয়সালাই সবাই মেনে নেবেন। কিন্তু এরা যেন নতুন করে কোনও বিবাদ শুরু না করে।”
যে বইয়ের ভিত্তিতে মামলা
মামলাকারী বিষ্ণু গুপ্তা বলছিলেন যে তার দাবির ভিত্তি হল হরবিলাস সারদার লেখা একটি বই।
হরবিলাস সারদা ১৯১১ সালে ‘আজমির: হিস্টোরিকাল অ্যান্ড ডেসক্রিপ্টিভ’ নামে ২০৬ পাতার একটি বই লেখেন।
বইটিতে খওয়াজা মৈনুদ্দিন চিশতির দরগাহ নিয়েও একটি অধ্যায় আছে। বইটির ৯৭ পাতায় লেখা হয়েছিল যে দরগাহ-তে মহাদেবের মন্দির ছিল।
ইংরেজিতে লেখা ওই বইটিতে হরবিলাস সারদা যা লিখেছিলেন, তার অনুবাদ এরকম:
“প্রচলিত কাহিনী এরকমই, যে ভূগর্ভস্থ ঘরে একটি মন্দিরে মহাদেবের ছবি আছে। এক ব্রাহ্মণ পরিবার সেখানে প্রতিদিন চন্দন রেখে আসেন। সেটিকে দরগাহতে ‘ঘড়িয়াল’ হিসাবে আজও রাখা হয়ে থাকে।”
এই কাহিনীর ওপরে ভিত্তি করেই মামলা দায়ের করা হয়েছে।
বইটি কতটা প্রামাণ্য, তা নিয়েই প্রশ্ন আছে সৈয়দ নাসিরুদ্দিনের। তিনি বলছেন, “যত ইতিহাস বই আছে, সেগুলির লেখক হিন্দু হোন বা মুসলমান, তারা আজমির শরিফ নিয়ে এধরনের কোনও কাহিনীর কথা উল্লেখ করেন নি। বিশ্বের হিন্দু এবং মুসলমান – সবার কাছেই আজমির শরিফ এক আস্থার, বিশ্বাসের স্থান।”