সোমবার, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ৯ পৌষ ১৪৩১

সিন্ডিকেটের কবল থেকে কবে মুক্তি পাবে চালের বাজার?

প্রকাশিতঃ ২১ নভেম্বর ২০২৪ | ১:৪৮ অপরাহ্ন


নজরুল কবির দীপু : আমনের নতুন ধান বাজারে আসার সঙ্গে সঙ্গে ধানের দাম কমতে শুরু করেছে। কৃষকদের ঘরে নতুন ধান উঠেছে, উৎপাদনও হয়েছে আশানুরূপ। ১০ দিনের ব্যবধানে ধানের দাম মনপ্রতি ৫০ থেকে ৮০ টাকা পর্যন্ত কমেছে। কিন্তু দুঃখজনক হলো, চালের বাজারে এই দামের প্রভাব পড়ছে না। বরং চালের দাম বিপরীতভাবে বেড়েই চলেছে। এমন পরিস্থিতি সাধারণ মানুষের জন্য এক গভীর সংকট তৈরি করেছে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, চালের বাজার অস্থিরতার জন্য মূলত দায়ী মিল মালিকদের সিন্ডিকেট। বিশেষ করে আওয়ামীপন্থি মিল মালিকরা নানা অজুহাতে চালের দাম বাড়াচ্ছেন। এমনকি, অনেকে মনে করেন, তারা সরকারের বিরুদ্ধে অসন্তোষ তৈরি করতে ইচ্ছাকৃতভাবে বাজারকে অস্থিতিশীল করছেন। একাধিক সূত্র বলছে, এ পরিস্থিতি সৃষ্টির জন্য পরিকল্পিতভাবে সিন্ডিকেট কাজ করছে।

বর্তমানে চালের দাম বাড়ায় নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত মানুষের জীবনযাত্রায় চরম প্রভাব পড়েছে। চালসহ নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি ভোক্তাদের নাভিশ্বাস তুলেছে। আমনের ভরা মৌসুমেও চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন এলাকায় চালের দাম বেড়েছে। মাত্র ১৫ দিনের ব্যবধানে প্রতি বস্তা চালের দাম ২৫০ থেকে ৩০০ টাকা পর্যন্ত বেড়ে গেছে। এই মূল্যবৃদ্ধি এমন এক সময় ঘটছে, যখন বাজার স্থিতিশীল রাখতে শুল্ক প্রত্যাহার করে বিপুল পরিমাণ চাল আমদানি করা হয়েছে।

মূল্যবৃদ্ধির কারণে নিম্ন আয়ের মানুষ তাদের দৈনন্দিন খরচ মেটাতে হিমশিম খাচ্ছেন। অনেকেরই ঋণ করে খাবার কিনতে হচ্ছে। একদিকে আয় কমে গেছে, অন্যদিকে পণ্যের দাম বেড়ে গেছে। বহুদিন ধরেই এমন সংকটময় পরিস্থিতি বিরাজ করছে। যারা ঋণ করার সুযোগ পাচ্ছেন না, তাদের অবস্থা আরও করুণ। পুষ্টিকর খাবার কেনার সামর্থ্য এখন অনেকের নেই। ফলে এই সংকট শুধু আর্থিক নয়, স্বাস্থ্যঝুঁকিও বাড়াচ্ছে।

দেশের চালের বাজারে সিন্ডিকেটের ভূমিকা দীর্ঘদিন ধরেই আলোচনা-সমালোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে। মিল মালিক ও ব্যবসায়ীদের একটি গোষ্ঠী বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে। তারা ইচ্ছেমতো চালের দাম বাড়িয়ে ভোক্তাদের জিম্মি করছে। সরকারের পক্ষ থেকে শুল্ক প্রত্যাহার ও চাল আমদানির মতো উদ্যোগ নেওয়া সত্ত্বেও বাজার স্থিতিশীল হচ্ছে না।

বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এই সিন্ডিকেটের পেছনে রয়েছে রাজনৈতিক যোগসূত্র। ক্ষমতার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কিছু অসাধু ব্যক্তি সিন্ডিকেটের কার্যক্রমকে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সহযোগিতা করছে। এসব অসাধু ব্যবসায়ীদের মানবিকতা নেই। তারা শুধু নিজেদের মুনাফার জন্য ভোক্তাদের দুর্দশায় ফেলে দিচ্ছে।

চালের দাম বৃদ্ধির ফলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে দেশের নিম্নবিত্ত ও দরিদ্র জনগোষ্ঠী। দেশের একটি বড় অংশ নিম্ন আয়ের মানুষ। তারা প্রতিদিনের খাবার কিনতে যে সংকটে পড়ছেন, তা অত্যন্ত উদ্বেগজনক।

নিম্ন আয়ের মানুষদের অনেকেই এখন ঋণ করে খাবার কিনছেন। তবে যারা ঋণ করতে পারছেন না, তাদের অবস্থা আরও করুণ। তারা হয়ত দিনে একবেলা খাবার কমিয়ে দিচ্ছেন বা সস্তা, নিম্নমানের খাবারের দিকে ঝুঁকছেন। এই অবস্থা শুধু তাদের দৈনন্দিন জীবনকেই নয়, বরং দেশের সার্বিক স্বাস্থ্যব্যবস্থাকেও ক্ষতিগ্রস্ত করছে।

অন্যদিকে মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষও এই পরিস্থিতিতে চাপে রয়েছেন। তাদের আয়ের সঙ্গে ব্যয়ের ভারসাম্য বজায় রাখা কঠিন হয়ে পড়েছে। নিত্যপণ্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে তারা বাধ্য হচ্ছেন পুষ্টিকর খাবারের পরিমাণ কমাতে। এর ফলে দীর্ঘমেয়াদে দেশের সামগ্রিক জনস্বাস্থ্য হুমকির মুখে পড়ছে।

যদিও সরকার চালের বাজার স্থিতিশীল করতে নানা উদ্যোগ নিয়েছে। শুল্ক প্রত্যাহার, চাল আমদানি বৃদ্ধি, ওএমএস (ওপেন মার্কেট সেল)-এর মাধ্যমে ন্যায্যমূল্যে চাল সরবরাহ—সবকিছুই করা হয়েছে। কিন্তু দুঃখজনকভাবে এসব উদ্যোগের কাঙ্ক্ষিত প্রভাব পড়ছে না। এর পেছনে মূল কারণ বাজারে অসাধু সিন্ডিকেটের কার্যক্রম।

সরকারের উচিত এই সিন্ডিকেট ভাঙতে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া। যারা বাজার অস্থির করে তুলছে, তাদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনতে হবে। বাজার মনিটরিং ব্যবস্থা আরও জোরদার করতে হবে। প্রতিদিনের বাজারদরের ওপর সঠিক নজরদারি করতে হবে।

এছাড়া, বাজারে শৃঙ্খলা আনতে তদারকির পাশাপাশি গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ানো জরুরি। যারা অসাধু ব্যবসায়ীদের সহযোগিতা করছে, তাদেরও আইনের আওতায় আনতে হবে। শুধুমাত্র জরিমানা করে বা সাময়িক শাস্তি দিয়ে এই সমস্যার সমাধান হবে না। স্থায়ী সমাধানের জন্য দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা নিতে হবে।

নিত্যপণ্যের বাজার স্থিতিশীল করতে সরকারকে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। প্রথমত, বাজারে সিন্ডিকেট চক্রের বিরুদ্ধে কঠোর অভিযান চালানো অত্যাবশ্যক। যেসব ব্যবসায়ী ইচ্ছাকৃতভাবে বাজার অস্থিতিশীল করছে, তাদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় এনে শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। দ্বিতীয়ত, বাজার মনিটরিং ব্যবস্থা আরও জোরদার করতে হবে। প্রতিদিনের পণ্যমূল্য বিশ্লেষণ করে তদারকি বাড়াতে হবে এবং নিয়মিত গোয়েন্দা নজরদারি বজায় রাখতে হবে।

তৃতীয়ত, চাল ও অন্যান্য নিত্যপণ্যের সরবরাহ চেইন স্বচ্ছ করতে উদ্যোগ নিতে হবে। যেসব মধ্যস্বত্বভোগী অতিরিক্ত মুনাফা লুটে বাজারে অস্থিরতা তৈরি করছে, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। চতুর্থত, নিম্নবিত্ত মানুষের জন্য চালসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যে ভর্তুকি প্রদান করতে হবে এবং সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতা আরও বাড়াতে হবে, যাতে তারা ন্যায্যমূল্যে নিত্যপণ্য ক্রয় করতে পারে। পঞ্চমত, বাজারে শৃঙ্খলা আনতে সঠিকভাবে আইন প্রয়োগ করতে হবে। যারা সিন্ডিকেটের সঙ্গে যুক্ত, তাদের বিরুদ্ধে দ্রুত ও কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

শেষ কথা- চালের বাজারের অস্থিরতা শুধু অর্থনৈতিক সংকট নয়, এটি একটি মানবিক সংকটও। অসাধু ব্যবসায়ীদের মুনাফালোভী মনোভাব ও সিন্ডিকেট চক্রের কারণে দেশের দরিদ্র মানুষ আজ খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় পড়েছে। সরকারের উচিত এই সমস্যা সমাধানে দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া।

নিত্যপণ্যের বাজারে স্থিতিশীলতা ফেরানো সরকারের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ। তবে এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সঠিক পরিকল্পনা, কঠোর পদক্ষেপ ও বাজার তদারকির মাধ্যমে সমাধান সম্ভব। জনগণের মৌলিক অধিকার রক্ষায় এটি একান্তই জরুরি।

লেখক : ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক, একুশে পত্রিকা।