নজরুল কবির দীপু : বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতির পথে অর্থ পাচার একটি দীর্ঘস্থায়ী এবং ক্রমবর্ধমান সমস্যা, যা দেশের সামগ্রিক উন্নয়ন এবং অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রতিবেদন অনুসারে, বিগত দশকগুলোতে বাংলাদেশের প্রভাবশালী ব্যক্তিরা দেশের রাষ্ট্রীয় কাঠামো ব্যবহার করে ব্যাংক খাত এবং বাণিজ্যের আড়ালে বিপুল পরিমাণ অর্থ বিদেশে পাচার করেছেন।
এই অর্থ পাচারের পরিমাণ যে কত বেশি তা টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান উল্লেখ করেছেন, যেখানে তিনি বলেছেন যে বিগত সরকারের আমলে প্রতিবছর গড়ে ১২ থেকে ১৫ বিলিয়ন ডলার বিদেশে পাচার হয়েছে। এই বিপুল পরিমাণ অর্থ দেশের অর্থনীতিতে ব্যবহৃত হতে পারলে হয়তো দেশের আর্থিক অবস্থার চিত্র ভিন্ন হতো।
বিদেশে পাচার হওয়া এই অর্থ ফেরত আনা বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের জন্য অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। পাচারকৃত অর্থ ফেরত আনার মাধ্যমে অর্থনৈতিক কাঠামোকে শক্তিশালী করার পাশাপাশি দেশের জনগণের জন্য একটি আর্থিক নিরাপত্তা তৈরি করা সম্ভব। তবে অর্থ ফেরত আনা সহজ কোন প্রক্রিয়া নয়। বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন ধরনের আইনকানুন এবং আন্তর্জাতিক নিয়মনীতি মেনে চলতে হয়, যা অর্থ ফেরত আনার প্রক্রিয়াকে দীর্ঘ ও জটিল করে তোলে। এই জটিল প্রক্রিয়াকে সহজ করতে বিশ্বব্যাংক তাদের সহায়তা প্রদানের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। বিশ্বব্যাংকের এই প্রতিশ্রুতি একটি ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির জন্ম দিয়েছে, কারণ তাদের ফরেনসিক সক্ষমতা এবং তদন্ত সহায়তা এই প্রক্রিয়াকে অনেকাংশে সহজ করতে পারে।
বিশ্বব্যাংকের সহায়তা প্রাপ্তির মাধ্যমে পাচারকৃত অর্থ ফেরত আনা যেমন সহজ হতে পারে, তেমনই তা সরকারের ওপর অর্থনৈতিক দায়বদ্ধতার একটি ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে। বিভিন্ন দেশের আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিট এবং আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলির সঙ্গে সমন্বয় করে অর্থ ফেরত আনার উদ্যোগটি কার্যকর করার জন্য বিশ্বব্যাংক এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।
এছাড়াও, বিশ্বব্যাংক দেশের বাণিজ্য খাতে এবং অন্যান্য আর্থিক খাতে সংস্কারের প্রয়োজনীয়তার বিষয়টিও উল্লেখ করেছে। বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য বাণিজ্য খাতটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং এই খাতের সংস্কার দেশকে অর্থনৈতিকভাবে আরো শক্তিশালী করতে পারে।
বিশ্বব্যাংকের কান্ট্রি ডিরেক্টরও বলেছেন, দেশের বাণিজ্য খাতে সংস্কার কার্যকর করলে এটি অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য সহায়ক হবে। একই সঙ্গে তিনি জানিয়েছেন, মিয়ানমার থেকে আসা রোহিঙ্গা শরণার্থীদের সমস্যার টেকসই সমাধানের জন্যও বিশ্বব্যাংক কাজ করছে, যা বাংলাদেশের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ সহায়তা হতে পারে।
অন্তর্বর্তী সরকার অর্থ ফেরত আনার লক্ষ্যে বেশ কিছু ইতিবাচক পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। ইতিমধ্যেই প্রধান উপদেষ্টা এবং অর্থ উপদেষ্টা বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা ও বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূতদের সঙ্গে বৈঠক করে পাচারকৃত অর্থ ফেরানোর প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরেছেন। এছাড়া, বাংলাদেশ আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিট (বিএফআইইউ) বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের নামে অর্জিত সম্পদ সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহের জন্য বিভিন্ন দেশের কাছে চিঠি প্রেরণ শুরু করেছে।
এই উদ্যোগগুলো ইতিবাচক হলেও এই প্রক্রিয়ার মূল চ্যালেঞ্জ হচ্ছে যারা অর্থ পাচার করেছেন, তাদের অধিকাংশই নিজেদের পরিচয় গোপন রাখতে বেনামে এবং নামসর্বস্ব প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে এই কার্যক্রম সম্পন্ন করেছেন। তাদের চিহ্নিত করা এবং তাদের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা অত্যন্ত জরুরি।
অর্থ পাচার প্রতিরোধ এবং বিদেশে পাচারকৃত অর্থ দেশে ফেরানোর ক্ষেত্রে সরকারকে আরও শক্তিশালী পদক্ষেপ নিতে হবে। শুধুমাত্র সরকারই নয়, এই কাজে জনগণের সহায়তাও গুরুত্বপূর্ণ। জনসচেতনতার মাধ্যমে অর্থ পাচারের বিপক্ষে জনমত গঠন করা সম্ভব, যা প্রভাবশালী অর্থ পাচারকারীদের ওপর এক ধরনের চাপ সৃষ্টি করতে পারে। দেশের ব্যাংক খাত, বাণিজ্য খাতসহ অন্যান্য আর্থিক খাতে সুশাসন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে অর্থ পাচারের এই প্রবণতা হ্রাস করা সম্ভব।
দেশের প্রভাবশালী ব্যক্তিরা অর্থ পাচারে যে ভূমিকা পালন করেছেন তা দেশের সার্বিক অর্থনীতির জন্য ক্ষতিকর। তাদের প্রভাব এবং ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে দেশের সম্পদ বিদেশে পাচার করে যে আর্থিক ক্ষতি হয়েছে, তা পূরণে সরকারকে দ্রুত এবং কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
দেশের আর্থিক খাত ও অর্থনীতিকে সুসংহত করতে অর্থ পাচারের এই চক্র ভাঙা অত্যন্ত জরুরি। বিশেষত যারা এখনো বিভিন্ন চক্রের মাধ্যমে পাচার কাজ পরিচালনা করছে তাদের চিহ্নিত করা এবং আইনের আওতায় নিয়ে আসা দরকার। এ প্রসঙ্গে একটি কঠোর আর্থিক নীতিমালা এবং আইন প্রণয়ন করে অর্থ পাচারকারীদের কার্যক্রম বন্ধ করা এবং পাচারকৃত অর্থ পুনরুদ্ধার করার ব্যাপারে আন্তরিক প্রচেষ্টা থাকা আবশ্যক। জনগণকে এই বিষয়ে সচেতন করা এবং তাদের মতামত নেয়াও গুরুত্বপূর্ণ।
বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে সরকারের এই যৌথ প্রচেষ্টা সফল হলে দেশের অর্থনীতিতে একটি স্থায়িত্ব এবং স্বচ্ছতা ফিরে আসতে পারে। তবে শুধুমাত্র অর্থ ফেরত আনা নয়, বরং দেশের বিভিন্ন খাতে যেমন ব্যাংকিং, বাণিজ্য এবং অন্যান্য আর্থিক খাতে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করার লক্ষ্যে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করা প্রয়োজন। সুশাসন নিশ্চিত করতে অর্থনৈতিক সংস্কার এবং স্বচ্ছতা আনতে হলে সরকারের উচিত অর্থনৈতিক নীতি এবং আইন প্রণয়ন প্রক্রিয়াকে আরও শক্তিশালী করা।
এদিকে, দেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি বৃদ্ধির লক্ষ্যে বিশ্বব্যাংকের মতামতও গুরুত্বপূর্ণ। চলতি অর্থবছরে দেশের মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) ৪ শতাংশ হতে পারে এবং সঠিকভাবে সংস্কার কার্যক্রম সম্পন্ন করা হলে ২০২৬ সালে এই প্রবৃদ্ধি ৫ শতাংশ ছাড়াতে পারে বলে ধারণা করা হয়েছে। এটি দেশের জন্য একটি ইতিবাচক ভবিষ্যৎ নির্দেশ করে এবং এতে বোঝা যায় যে সঠিক উদ্যোগ গ্রহণের মাধ্যমে দেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতি অর্জন করা সম্ভব।
যদিও সরকারের এই প্রচেষ্টা প্রশংসনীয়, কিন্তু এই উদ্যোগ বাস্তবায়নের পথে নানা বাধা ও চ্যালেঞ্জ রয়েছে। পাচারকৃত অর্থ ফেরত আনার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় বাধা হচ্ছে অর্থ পাচারকারীদের গোপনীয়তা এবং তাদের অপ্রকাশিত পরিচয়। বেশিরভাগ অর্থ পাচারকারী তাদের কার্যক্রম লুকিয়ে রাখার জন্য বেনামি প্রতিষ্ঠান এবং ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করেছেন, যা তাদের চিহ্নিত করার প্রক্রিয়াকে জটিল করে তুলেছে। এছাড়া যারা অর্থ পাচার করছেন তারা দেশের উচ্চপদস্থ প্রভাবশালী, যা প্রক্রিয়াকে আরও চ্যালেঞ্জিং করে তুলেছে। এই পরিস্থিতিতে সরকারকে যথাযথ কৌশল এবং উচ্চ পর্যায়ের দক্ষতা নিয়ে এগোতে হবে।
অর্থ পাচার রোধে সরকার ও বিশ্বব্যাংকের এই সম্মিলিত প্রচেষ্টা সফল হোক—এটাই দেশের জনগণের প্রত্যাশা। একটি স্বচ্ছ আর্থিক পরিবেশ গড়ে তোলার মাধ্যমে দেশের আর্থিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব। অর্থ পাচার থেকে দেশের অর্থনীতি মুক্ত হলে দেশে আর্থিক স্থিতিশীলতা ফিরে আসবে, যা দেশের সার্বিক উন্নয়নে সহায়ক হবে।
লেখক : ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক, একুশে পত্রিকা।