নজরুল কবির দীপু : ডোনাল্ড ট্রাম্পের দ্বিতীয়বারের জন্য মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার ঘটনা শুধু মার্কিন অভ্যন্তরীণ রাজনীতির জন্য নয়, পুরো বিশ্ব রাজনীতির ক্ষেত্রেই এক গুরুত্বপূর্ণ পালাবদল ঘটিয়েছে। ২০১৬ সালে প্রথমবার নির্বাচিত হয়ে তিনি মার্কিন রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে এক ভিন্ন ধারা প্রবর্তন করেছিলেন, যা বিশ্বব্যাপী আলোচিত হয়েছিল। তাঁর এই প্রত্যাবর্তনের পর বিশ্ববাসী যেমন তাঁর অভ্যন্তরীণ নীতি এবং পররাষ্ট্রনীতিতে পরিবর্তনের সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনা করছে, তেমনই ট্রাম্পের নেতৃত্বে বিশ্বশান্তি এবং স্থিতিশীলতার প্রত্যাশাও উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়ে গেছে। চলুন বিস্তারিতভাবে ট্রাম্পের দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় আসার প্রভাব এবং তা নিয়ে বৈশ্বিক আলোচনা ও সম্ভাবনা বিশ্লেষণ করা যাক।
মার্কিন জনগণের পরিবর্তনের আহ্বান এবং ট্রাম্পের জয়
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এইবারের নির্বাচনী ফলাফল ছিল বিশেষভাবে প্রতীক্ষিত। গত চার বছরে ডেমোক্র্যাট প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের অধীনে মার্কিনিরা কিছু পরিবর্তনের আশা করেছিলেন, কিন্তু অনেকেই মনে করছেন যে তাঁরা চেয়েছিলেন আরও স্পষ্টভাবে দৃশ্যমান ফলাফল। ট্রাম্প তাঁর নির্বাচনী প্রচারণায় আমেরিকার অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা, স্বাস্থ্যসেবার উন্নয়ন, অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা এবং শিক্ষাখাতের পরিবর্তনসহ বেশ কিছু বিষয়কে গুরুত্ব দেন, যা জনসাধারণের সমর্থন অর্জনে সহায়ক হয়েছে। মার্কিন জনগণ ট্রাম্পের এই শক্তিশালী নেতৃত্বের প্রতি তাদের সমর্থন প্রকাশ করে ভোট দিয়েছে। তাঁর জয়কে একটি পরিবর্তনের ইচ্ছার প্রতিফলন হিসেবে দেখা হচ্ছে, যা মার্কিনিদের মধ্যকার পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষাকে তুলে ধরে।
অভিবাসন নীতির কঠোরতা এবং যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসীদের জন্য আশঙ্কা
ডোনাল্ড ট্রাম্প তাঁর প্রথম মেয়াদে অভিবাসন নীতিতে কঠোর পরিবর্তন আনেন, যা বিতর্কিত ছিল এবং নানা সমালোচনার জন্ম দিয়েছিল। মুসলিম, কৃষ্ণাঙ্গ, লাতিনো এবং অন্যান্য অভিবাসী জনগোষ্ঠীর প্রতি তাঁর কঠোর অবস্থান, বিশেষত অবৈধ অভিবাসীদের প্রতি, তাঁকে অভিবাসন-বিরোধী বলে পরিচিত করেছে। যুক্তরাষ্ট্রে অন্তত ৩০ লাখ বাংলাদেশি বসবাস করছেন, যাঁদের মধ্যে অনেকে অবৈধ অভিবাসী। ট্রাম্পের কঠোর অভিবাসন নীতির কারণে তাঁদের মধ্যে নিরাপত্তা এবং ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বেগ বেড়েছে।
এখন প্রশ্ন আসে, ট্রাম্প তাঁর দ্বিতীয় মেয়াদে এই নীতিতে কী ধরনের পরিবর্তন আনবেন। যুক্তরাষ্ট্রের শক্তিশালী অভিবাসন ইতিহাস এবং বৈচিত্র্যময় জনগোষ্ঠীর অবদানের কথা বিবেচনায় রেখে ট্রাম্প যদি সহনশীল নীতি গ্রহণ করেন, তবে তা শুধুমাত্র অভিবাসীদের জন্য নয়, বরং মার্কিন অর্থনীতির জন্যও সহায়ক হবে। ট্রাম্প প্রশাসন অভিবাসী সম্প্রদায়ের নিরাপত্তা এবং সুরক্ষা নিশ্চিত করার উদ্যোগ গ্রহণ করবে বলে আশা করা হচ্ছে, যা এই উদ্বেগ কমাতে সহায়ক হবে।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ এবং ট্রাম্পের সম্ভাব্য অবস্থান
ডোনাল্ড ট্রাম্পের দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় ফিরে আসা বিশেষত রাশিয়া-ইউক্রেন সংকটের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ মোড় হতে পারে। ট্রাম্প তাঁর প্রথম মেয়াদে বিভিন্ন সময়ে রাশিয়ার প্রতি সহানুভূতি প্রকাশ করেছেন, যা মার্কিন রাজনীতিতে বিতর্কের সৃষ্টি করেছে। ট্রাম্পের বর্তমান অবস্থান নিয়ে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন যে তিনি হয়তো রাশিয়া-ইউক্রেন সংকটের সমাধানের জন্য শান্তিপূর্ণ সমঝোতার উদ্যোগ গ্রহণ করতে পারেন। যদি ট্রাম্প এই সংকটের নিষ্পত্তিতে সফল হন, তবে তা বিশ্বশান্তির পক্ষে এক গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হিসেবে গণ্য হবে।
রাশিয়া-ইউক্রেন সংঘাতের কারণে বৈশ্বিক অর্থনীতি ও জ্বালানি সরবরাহে ব্যাপক প্রভাব পড়েছে, যা স্থায়ী সমাধানের প্রয়োজনীয়তা আরও বাড়িয়ে তুলেছে। যদি ট্রাম্প প্রশাসন এই সংকট নিরসনে কাজ করে এবং রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে একটি স্থিতিশীল সমঝোতা গড়ে তোলে, তবে তা শুধু যুক্তরাষ্ট্রের জন্য নয়, পুরো বিশ্বের অর্থনৈতিক পরিস্থিতির উন্নয়নে সহায়ক হবে। ট্রাম্পের এই শান্তি প্রতিষ্ঠার প্রয়াস বৈশ্বিক রাজনীতির এক ইতিবাচক দিক হতে পারে।
মধ্যপ্রাচ্য নীতি এবং ফিলিস্তিন-ইসরায়েল সমস্যা
মার্কিন পররাষ্ট্রনীতির আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র হলো মধ্যপ্রাচ্য। ট্রাম্প তাঁর প্রথম মেয়াদে ইসরায়েলের প্রতি বিশেষ সমর্থন দেখিয়েছিলেন, যা অনেক বিতর্কের জন্ম দেয়। এবারও মধ্যপ্রাচ্যের স্থিতিশীলতার লক্ষ্যে ট্রাম্প প্রশাসনের মনোযোগ প্রয়োজনীয়। বিশেষত ফিলিস্তিন-ইসরায়েল সমস্যায় যদি ট্রাম্প দুই রাষ্ট্র সমাধানের পথে অগ্রসর হন, তবে তা শুধু মধ্যপ্রাচ্যের স্থায়ী শান্তির জন্য নয়, গোটা বিশ্বশান্তির জন্য একটি ইতিবাচক পদক্ষেপ হবে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এই ইস্যুতে মার্কিন নেতৃত্বের উপর অনেকাংশেই নির্ভরশীল। ট্রাম্প যদি ফিলিস্তিন-ইসরায়েল সম্পর্কের ক্ষেত্রে সমতা এবং ন্যায়বিচারের প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হন, তবে তা অনেক দেশকেই উদ্বুদ্ধ করবে।
দক্ষিণ এশিয়ার ক্ষেত্রে মার্কিন নীতি
ট্রাম্পের প্রত্যাবর্তন এশিয়ার বিভিন্ন দেশ বিশেষত দক্ষিণ এশিয়ার ক্ষেত্রে মার্কিন নীতিতে পরিবর্তনের সম্ভাবনা নিয়ে এসেছে। দক্ষিণ এশিয়ার রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ, ভারত এবং পাকিস্তানের ক্ষেত্রে মার্কিন অবস্থান একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে উঠেছে। সম্প্রতি শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান হিসেবে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের আবির্ভাব দক্ষিণ এশিয়ায় একটি নতুন রাজনৈতিক বাস্তবতা তৈরি করেছে। ড. ইউনূস এবং ডেমোক্র্যাটদের মধ্যে দীর্ঘদিনের সম্পর্ক এবং বাইডেন প্রশাসনের সমর্থন এই পরিবর্তনশীল প্রেক্ষাপটকে আরও স্পষ্ট করেছে।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে ট্রাম্পের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক এই পরিস্থিতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। ট্রাম্পের নেতৃত্বে যদি মার্কিন নীতি দক্ষিণ এশিয়ায় পরিবর্তন হয়, তবে বাংলাদেশে মার্কিন উপস্থিতি ও প্রভাব কেমন হবে, তা দেখার বিষয়। তবে অনেকেই মনে করছেন যে ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক দক্ষিণ এশিয়ায় মার্কিন অবস্থানের একটি মূল স্তম্ভ হিসেবে কাজ করবে।
ট্রাম্পের ব্যবসায়িক নীতি এবং বাংলাদেশের জন্য সুযোগ ও চ্যালেঞ্জ
ডোনাল্ড ট্রাম্প একজন সফল ব্যবসায়ী, এবং তাঁর ব্যবসা-কেন্দ্রিক নীতি মার্কিন অভ্যন্তরীণ ও বৈশ্বিক অর্থনীতিতে ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে পারে। বাংলাদেশের অর্থনীতি, বিশেষত গার্মেন্টস রপ্তানি এবং অন্যান্য খাতে মার্কিন বিনিয়োগের সম্ভাবনা বাড়ানোর জন্য ট্রাম্প প্রশাসনের নতুন বাণিজ্য নীতি গুরুত্বপূর্ণ। ট্রাম্প যদি ব্যবসায়িক সম্পর্ক উন্নয়নে আগ্রহী হন, তবে বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র বাণিজ্যিক সম্পর্ক নতুন মাত্রা পেতে পারে। তবে এখানে গুরুত্বপূর্ণ হলো, ড. ইউনূস সরকারের সংস্কার কার্যক্রমে ট্রাম্প প্রশাসনের কতটা সহানুভূতি থাকবে এবং তাঁরা এ ক্ষেত্রে কেমন প্রতিক্রিয়া দেখাবেন।
বাংলাদেশের কূটনৈতিক অবস্থান এবং নতুন কৌশলের প্রয়োজনীয়তা
বাংলাদেশের জন্য এই নতুন পরিস্থিতিতে একটি শক্তিশালী কূটনৈতিক অবস্থান গড়ে তোলা জরুরি। মার্কিন নেতৃত্বে ট্রাম্পের প্রত্যাবর্তন এবং তাঁর প্রশাসনের নীতি বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে প্রভাব ফেলতে পারে। সাবেক কূটনীতিকদের মতে, প্রচলিত কূটনীতির বাইরে এক নতুন কৌশল গ্রহণ করা প্রয়োজন, যা কেবল ট্রাম্প প্রশাসনের নীতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়, বরং বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অবস্থানকে শক্তিশালী করতে সহায়ক হবে। ভারতের প্রভাব ও রাশিয়ার সমর্থন বজায় রেখে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক উন্নয়ন করা বাংলাদেশের জন্য বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ।
ট্রাম্পের প্রত্যাবর্তন, বিশ্বশান্তির আশার আলো
ডোনাল্ড ট্রাম্পের দ্বিতীয়বার মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসেবে ফিরে আসা আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে এক নতুন অধ্যায় রচনা করেছে। অভিবাসন নীতি, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক, রাশিয়া-ইউক্রেন সংকট, মধ্যপ্রাচ্য পরিস্থিতি এবং দক্ষিণ এশিয়ার প্রতি মার্কিন নীতি—এই প্রতিটি ক্ষেত্রেই ট্রাম্পের প্রশাসনের নীতির গুরুত্ব অপরিসীম। যদি তাঁর নেতৃত্বে মার্কিন পররাষ্ট্রনীতি বিশ্বশান্তির প্রতি সদর্থক ভূমিকা পালন করে, তবে তা বৈশ্বিক স্থিতিশীলতার জন্য আশার আলো হয়ে থাকবে। বিশ্বশান্তির পক্ষে কাজ করার প্রত্যাশায় ট্রাম্পের প্রত্যাবর্তন আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে স্থিতিশীলতা ও সমৃদ্ধি নিয়ে আসতে পারে, যা গোটা বিশ্বের জন্য এক নতুন সম্ভাবনার সূচনা করবে।
লেখক : ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক, একুশে পত্রিকা।