নজরুল কবির দীপু : দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি বর্তমানে একটি গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি দাঁড়িয়েছে। সম্প্রতি ঘটে যাওয়া রাজনৈতিক পরিবর্তন এবং বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের কারণে পুলিশের কার্যক্রমে একটি বিশৃঙ্খলা দেখা দিয়েছে, যা জনসাধারণের নিরাপত্তায় ব্যাপক প্রভাব ফেলেছে। পুলিশের শক্তিশালী চেইন অব কমান্ড ভেঙে যাওয়ার পর থেকে সারা দেশে ছিনতাই, ডাকাতি, এবং অন্যান্য অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড বাড়ছে।
এই অবস্থায় পুলিশ বাহিনীর পুনর্গঠন ও পুনরায় সক্রিয় করার জন্য কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ হাতে নেওয়া হয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায়, এই পদক্ষেপগুলি কি যথেষ্ট? পুলিশের সামগ্রিক দক্ষতা এবং তাদের শক্তি পুনরুদ্ধার করতে কী কী পদক্ষেপ আরও প্রয়োজন, সে বিষয়ে গভীর পর্যালোচনা প্রয়োজন।
চেইন অব কমান্ডের ভাঙন এবং উদ্ভূত চ্যালেঞ্জগুলো
সরকার পরিবর্তনের পর পুলিশের মধ্যে চেইন অব কমান্ড ভেঙে পড়েছে, এবং এই পরিস্থিতি পুলিশের কাজে অসামঞ্জস্য তৈরি করেছে। পুলিশ বাহিনীর অনেক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা এবং মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তারা আত্মগোপনে গেছেন, যার ফলে বাহিনীটি তার পূর্ণ শক্তি এবং কার্যকারিতা হারিয়েছে। ফলস্বরূপ, দেশের বিভিন্ন স্থানে ছিনতাই, চাঁদাবাজি এবং সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড বৃদ্ধি পেয়েছে। জনমনে একটি নিরাপত্তাহীনতার অনুভূতি তৈরি হয়েছে, বিশেষ করে রাতের বেলা অনেকেই আতঙ্কের মধ্যে বাস করছেন। এমনকি দিনের বেলাতেও বেশ কিছু এলাকায় ছিনতাইকারীদের দৌরাত্ম্য লক্ষ্য করা যাচ্ছে।
গত ২৮ অক্টোবর দিন-দুপুরে চট্টগ্রাম নগরের নুর আহমদ সড়কে একুশে পত্রিকার সাংবাদিক মোহাম্মদ আলাউদ্দিন ছিনতাইকারীদের কবলে পড়েছিলেন। তার কাছ থেকে ছিনিয়ে নেওয়া হয় আইফোন। থানায় মামলা করতে গিয়ে আলাউদ্দিন দেখতে পান, ছিনতাইয়ের শিকার আরও বেশ কয়েকজন মানুষ তার মতো অভিযোগ করতে গিয়েছেন।
এসব ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে এটি স্পষ্ট যে, অপরাধীরা বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। একটি সুসংহত ও স্থিতিশীল চেইন অব কমান্ড না থাকায় পুলিশের প্রতিক্রিয়া ব্যবস্থাও দুর্বল হয়ে পড়েছে। সামগ্রিক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য যে সমন্বিত কার্যক্রম প্রয়োজন, তা করতে পুলিশের সময় লাগছে এবং এই বিলম্বিত সাড়া দেওয়া অপরাধীদের আরো উগ্র করে তুলছে।
পুলিশ বাহিনীর পুনর্গঠনে চলমান উদ্যোগ এবং তাদের কার্যকারিতা
বর্তমান অবস্থায় পুলিশের পুনর্গঠনের লক্ষ্যে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করা হচ্ছে। সারা দেশে যৌথ বাহিনীর অভিযান পরিচালিত হচ্ছে, এবং পুলিশের লুণ্ঠিত অস্ত্র উদ্ধারের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। সন্ত্রাসীদের উপর বিশেষ নজরদারি বাড়ানো হয়েছে এবং একটি সিভিলিয়ান প্ল্যাটফরম গঠন করা হয়েছে। একই সাথে, ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি যানজট নিরসনের জন্য বিভিন্ন কার্যক্রম হাতে নেওয়া হয়েছে। পুলিশের সংস্কারের জন্য সরকার কর্তৃক গঠিত কমিশন কাজ শুরু করেছে, এবং পুলিশের সদর দপ্তর থেকেও একটি পৃথক সংস্কার কমিটি গঠন করা হয়েছে।
এইসব পদক্ষেপ পুলিশের কার্যক্রমকে পুনরায় সচল করার লক্ষ্যে নেওয়া হয়েছে এবং বিভিন্ন সমস্যার মোকাবিলা করতে সক্ষমতা বাড়ানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। পুলিশের অস্থিরতা কমাতে এবং মনোবল পুনরুদ্ধারে এই পদক্ষেপগুলি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। তবে এগুলোর কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়। পুলিশের প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা এবং বাহিনীর ভেতরের অস্থিরতা অনেক ক্ষেত্রেই অপারেশনাল কার্যকারিতা কমিয়ে দিতে পারে। ফলে, মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের যথাযথ দিকনির্দেশনা প্রদান করা এবং সর্বোচ্চ পেশাদারিত্ব নিশ্চিত করাই এখন সময়ের দাবি।
রাজনৈতিক প্রভাব মুক্ত আইনশৃঙ্খলা ব্যবস্থা: একটি জরুরি প্রয়োজন
একটি কার্যকর ও প্রভাবমুক্ত আইনশৃঙ্খলা ব্যবস্থার জন্য পুলিশ বাহিনীর অপারেশনাল অটোনমাস (স্বায়ত্তশাসন) থাকার প্রয়োজনীয়তা নিয়ে আলোচনা করা প্রয়োজন। পুলিশ বাহিনীর অভ্যন্তরীণ কর্মক্ষমতা এবং স্বাধীনতা অর্জন করতে হলে বাহিনীটিকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত রেখে তাদের নিজস্ব ক্ষমতার অধিকার দেওয়া উচিত। প্রয়োজন হলে পুলিশ বাহিনীর একটি পৃথক স্বাধীন অপারেশনাল ইউনিট গঠন করা যেতে পারে, যা শুধুমাত্র আইনশৃঙ্খলা রক্ষার উপর নজর দেবে এবং যে কোনো রাজনৈতিক চাপ বা প্রভাব থেকে মুক্ত থাকবে। এক্ষেত্রে বিভিন্ন বাহিনীর সহায়তায় এই ইউনিটটি দায়িত্ব পালন করতে পারে, কিন্তু সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে একটি স্বতন্ত্র অপারেশনাল স্বাধীনতা থাকা উচিত।
একটি প্রভাবমুক্ত এবং অপারেশনাল স্বায়ত্তশাসিত পুলিশ বাহিনী জননিরাপত্তার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অপরাধ দমনে পুলিশের কার্যকর ভূমিকা নিশ্চিত করার জন্য যে কোনও ধরনের অপব্যবহার এবং দুর্নীতি থেকে মুক্ত একটি শক্তিশালী এবং নিরপেক্ষ পুলিশ বাহিনী গড়ে তোলার জন্য সরকার এবং সংশ্লিষ্ট মহলকে কার্যকরী উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।
জনগণের নিরাপত্তা ও পুলিশের মনোবল পুনরুদ্ধার
পুলিশের মনোবল পুনরুদ্ধার ও তাদের জনমুখী কার্যক্রম পুনরায় শক্তিশালী করতে হলে বাহিনীর সকল স্তরে সঠিক নির্দেশনা এবং প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা উচিত। পুলিশের মনোবল বৃদ্ধির জন্য অভ্যন্তরীণ দাবিদাওয়া এবং পদোন্নতি-পদায়নের বিষয়গুলোতে সমাধান আনার জন্য একটি স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ ব্যবস্থাপনা চালু করা প্রয়োজন। বিশেষ করে যারা মাঠ পর্যায়ে ঝুঁকি নিয়ে কাজ করছেন, তাদের জন্য প্রয়োজনীয় সহায়তা ও মানসিক সুরক্ষা প্রদান করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
পুলিশের সক্ষমতা এবং কার্যক্ষমতা বাড়াতে সরকারকে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে। অপরাধী চক্রের দৌরাত্ম্য নিয়ন্ত্রণে রাখতে এবং আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পুলিশের ভেতরে আত্মবিশ্বাস ফিরিয়ে আনতে হবে। শুধু বাহিনীর অভ্যন্তরীণ পরিবর্তনই যথেষ্ট নয়; বরং একটি সুস্থ এবং প্রগতিশীল সমাজ গঠনে পুলিশ বাহিনীকে জনগণের সঙ্গে নিয়ে কাজ করতে হবে। জনগণের আস্থা অর্জনের জন্য পুলিশের প্রতি জনসাধারণের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনের জন্য সরকার এবং পুলিশের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের কৌশলগত প্রচেষ্টা প্রয়োজন।
ভবিষ্যৎ ভাবনা: পুলিশের দায়িত্ব এবং জননিরাপত্তা
বর্তমান পরিস্থিতিতে পুলিশের ওপর জনমনে যে হতাশা ও অবিশ্বাস তৈরি হয়েছে, তা দূর করার জন্য সময়োপযোগী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। এই পরিস্থিতিতে পুলিশ বাহিনীকে নতুন করে সংগঠিত করে অপরাধ দমনে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা গ্রহণ করার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। সরকার এবং পুলিশের উচ্চপর্যায়ের মধ্যে একটি সম্মিলিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে পুলিশ বাহিনীর স্বচ্ছতা, দক্ষতা এবং সেবামূলক কার্যক্রমকে আরও বেগবান করা সম্ভব।
উদ্বেগের বিষয় হলো, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি রোধে পুলিশের বর্তমান প্রচেষ্টা পর্যাপ্ত কি না। অপরাধীরা যেন আরো সাহসী হয়ে না ওঠে, সে জন্য পুলিশের ভূমিকা এবং জনসাধারণের সচেতনতা বাড়ানো প্রয়োজন। আশা করা যায়, পুলিশের সক্রিয়তা এবং কার্যকর পদক্ষেপে একসময় পরিস্থিতির উন্নতি হবে।
লেখক : ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক, একুশে পত্রিকা।