সোমবার, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ৯ পৌষ ১৪৩১

ঔষধ প্রশাসনের গাফিলতিতে ঝুঁকিতে জনস্বাস্থ্য

প্রকাশিতঃ ৩০ অক্টোবর ২০২৪ | ১:১৯ অপরাহ্ন

নজরুল কবির দীপু
নজরুল কবির দীপু : ‘নিষিদ্ধ ওষুধের হাঁড়ির খবর’ শীর্ষক তিন পর্বের অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে একুশে পত্রিকা। গত ২৭ অক্টোবর থেকে ২৯ অক্টোবর পর্যন্ত প্রকাশিত অনুসন্ধানী প্রতিবেদনগুলো তৈরি করেছেন আমাদের প্রধান প্রতিবেদক শরীফুল রুকন। এই অনুসন্ধানী প্রতিবেদনগুলো একুশে পত্রিকার জন্য শুধু গৌরবের কারণই নয়; বরং জনস্বার্থে প্রকাশিত এক ঐতিহাসিক উদ্যোগ। আমাদের দেশের ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের অদক্ষতা, প্রশাসনিক গাফিলতি এবং মুনাফালোভী ওষুধ কোম্পানির প্রভাব যে কতটা ভয়ংকর বিপদ ডেকে আনছে, তার স্বচ্ছ প্রতিফলন এ প্রতিবেদনে এসেছে। এটি শুধুমাত্র তথ্যের সংকলন নয়; বরং আমাদের সমাজ ও জনস্বাস্থ্য নিয়ে গভীর এক চিন্তার খোরাক।

প্রথম পর্বে ‘রহস্যঘেরা নিষিদ্ধ ওষুধ’ শিরোনামে শরীফুল রুকন যে কঠিন বাস্তবতা তুলে ধরেছেন, তা আমাদের স্বাস্থ্য খাতের অমানবিক পরিস্থিতির এক নির্মম চিত্র। প্রতিবেশী ভারত যেখানে জনস্বাস্থ্যের কথা মাথায় রেখে ৬১৪টি ওষুধ নিষিদ্ধ করেছে, সেখানে বাংলাদেশে নিষিদ্ধ ওষুধের কোনো সুসংহত তালিকাই নেই। ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর নিষিদ্ধ ওষুধের তথ্য প্রকাশে বারবার গাফিলতি দেখিয়েছে এবং গোপনীয়তা রক্ষা করেছে।

এই গাফিলতির কারণেই আমাদের দেশে এখনো রোফেকক্সিব, ভালডেকক্সিব এবং থ্যালিডোমাইডের মতো ক্ষতিকর ওষুধ ব্যবহৃত হচ্ছে, যা পৃথিবীর বহু দেশে নিষিদ্ধ। থ্যালিডোমাইডের মতো ভয়ংকর ওষুধ ষাটের দশক থেকেই নিষিদ্ধ, যা তখন গর্ভস্থ শিশুর জন্মগত ত্রুটির জন্য দায়ী ছিল। অথচ এই ওষুধ এখনো ক্যান্সার চিকিৎসার নামে বাংলাদেশে অনুমোদিত। একুশে পত্রিকার অনুসন্ধানী এই প্রতিবেদন আমাদের চোখ খুলে দিয়েছে, জানিয়ে দিয়েছে, আমাদের ঔষধ প্রশাসনের এই ঔদাসীন্য জনস্বাস্থ্যের জন্য ভয়ংকর পরিণতির কারণ হতে পারে।

তথ্য নেই, নাকি গায়েবের ধান্দা?’ শিরোনামের দ্বিতীয় পর্বটি যেন দেশের স্বাস্থ্য খাতে গড়ে ওঠা প্রশাসনিক অসচ্ছতার বিরুদ্ধে এক সাহসী আওয়াজ। তথ্য অধিকার আইনের আওতায় ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরে আবেদন করা হলেও প্রয়োজনীয় তথ্য প্রাপ্তি নিয়ে নানা অজুহাত দেখানো হয়। যখন অনুসন্ধানী সাংবাদিক তথ্য চাইতে গিয়ে একের পর এক বাধার সম্মুখীন হন, তখন প্রশ্ন ওঠে- কেন জনস্বার্থে এত গুরুত্বপূর্ণ তথ্য এভাবে গোপন করা হচ্ছে? আমাদের স্বাস্থ্যখাতের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের এই ধরনের আচরণ যেন এক অন্ধকারের ইঙ্গিত দেয়। যা খুবই উদ্বেগের বিষয়।

এই প্রতিবেদনের মাধ্যমে সমাজের সর্বস্তরে প্রশ্ন জাগিয়েছে, দেশের ঔষধ প্রশাসনের স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহিতার অভাব কেন? রিপোর্টে উঠে এসেছে, কেবলমাত্র বেসরকারি ওষুধ কোম্পানির প্রভাবের কারণে অপ্রয়োজনীয় ও ক্ষতিকর ওষুধ অনুমোদন দেওয়া হচ্ছে। আর এই নিষিদ্ধ ওষুধ বাজারে যত্রতত্র পাওয়া যাচ্ছে। অথচ একে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য প্রশাসনের কোনো কার্যকরী পদক্ষেপ নেই। এসব ঘটনা জনস্বাস্থ্যের জন্য এক জ্বলন্ত উদাহরণ।

তৃতীয় পর্ব ‘ঝুঁকি বাড়াচ্ছে এডিআর রিপোর্টে অবহেলা’ আমাদের স্বাস্থ্য সুরক্ষার মূল ভিত্তিগুলোতে থাকা অব্যবস্থাপনার ভয়াবহ রূপ উন্মোচন করেছে। অ্যাডভার্স ড্রাগ রিঅ্যাকশন (এডিআর) রিপোর্টিং প্রক্রিয়া বাংলাদেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় কতটা দুর্বল, তা অত্যন্ত স্পষ্টভাবে এ প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। এডিআর রিপোর্টিংয়ে আমাদের দেশের চিকিৎসকদের অনীহা এবং সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের প্রশিক্ষণের অভাব- সবই মিলিয়ে এই বিষয়টিকে আরও জটিল করে তুলেছে। সংশ্লিষ্টরা এডিআর রিপোর্টিং ব্যবস্থা সম্পর্কে অজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন, আর অনেকেই বলেছেন, এটি বাস্তবায়নে তাদের পর্যাপ্ত জনবল ও বাজেট নেই।

অথচ প্রতিবেশী দেশ ভারত বা অন্যান্য দেশে এডিআর রিপোর্টিং প্রক্রিয়া বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। এখানেও আমাদের দেশের অবহেলা ও দায়িত্বজ্ঞানহীনতার দিকটি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এসব ঘটনার কারণেই আমাদের দেশের জনস্বাস্থ্যের ওপর মারাত্মক প্রভাব পড়ছে। প্রতিটি এডিআর রিপোর্ট আমাদের হাজারো জীবন বাঁচাতে সাহায্য করতে পারতো, অথচ এই বাস্তবতা আজ খুবই হতাশাজনক। প্রতিবেদনে দেখা গেছে, আমাদের দেশের ৬৫% চিকিৎসক এডিআর সম্পর্কে জানেন, কিন্তু মাত্র ৪% রিপোর্টিং ফর্ম পূরণে দক্ষ। এ ধরনের দায়িত্বহীনতা এক মহাবিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দিচ্ছে আমাদের।

আমাদের দেশের সাধারণ মানুষ প্রতিদিনই এই ঝুঁকিপূর্ণ ওষুধের শিকার হচ্ছে। তাদের চিকিৎসা সেবা বা সঠিক তথ্য প্রদানের জন্য কোনো পূর্ণাঙ্গ ব্যবস্থা নেই। দেশজুড়ে স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে এই সংকটের প্রধান কারণ হিসেবে উঠে এসেছে ঔষধ প্রশাসনের অদক্ষতা এবং ওষুধ কোম্পানির প্রভাব। দেশের জনগণকে নিরাপদ ওষুধ সরবরাহ করতে ব্যর্থ হওয়া এবং নিষিদ্ধ ওষুধের অনিয়ন্ত্রিত বিক্রি দেশের স্বাস্থ্যখাতের চরম ব্যর্থতার পরিচায়ক। অধ্যাপক আ ব ম ফারুক, একজন অভিজ্ঞ বিশেষজ্ঞ হিসেবে তাঁর সাক্ষাৎকারে স্পষ্টতই বলেছেন, ঔষধ প্রশাসনে বিশেষজ্ঞের অভাব, ওষুধ কোম্পানির প্রভাব এবং স্বচ্ছতা ও নীতি-নৈতিকতার অভাবের কারণেই আমাদের দেশে এই বিপজ্জনক অবস্থা বিরাজ করছে।

আমাদের দেশের জনগণ ওষুধের বিষয়ে সচেতন নয়, এবং অনেকে এসব বিষয় সম্পর্কে ধারণাও রাখেন না। জনস্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করার জন্য আমাদের দেশে ওষুধ কোম্পানির শক্তিশালী লবিং ও প্রভাব এতটাই প্রকট যে, নিষিদ্ধ ওষুধগুলো বিভিন্ন রূপে বাজারে সহজলভ্য হয়ে গেছে। অধ্যাপক ফারুকের মতে, কেবলমাত্র মুনাফালোভী কোম্পানির প্রভাবেই অনেক ক্ষতিকর ওষুধ বাজারে প্রবেশ করছে। আমরা জানি, অনেক সময় এই ওষুধগুলোর ভয়ংকর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া রয়েছে, যা জনস্বাস্থ্যের জন্য ভয়ানক পরিণতি ডেকে আনতে পারে।

শরীফুল রুকনের এই অনবদ্য অনুসন্ধানী কাজটি আমাদের স্বাস্থ্যখাতের একটি গুরুত্বপূর্ণ বাস্তবতা প্রকাশ করেছে। এই প্রতিবেদনের মাধ্যমেই সমাজে এমন কিছু প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে যা দীর্ঘদিনের উপেক্ষিত। জনস্বাস্থ্যের জন্য এ ধরনের মূল্যবান ও অনুসন্ধানী প্রতিবেদন সমাজে সচেতনতা সৃষ্টির পাশাপাশি প্রশাসনের দৃষ্টি আকর্ষণ করার এক শক্তিশালী হাতিয়ার। আমরা আশা করি, এই প্রতিবেদন ঔষধ প্রশাসনের মতো গুরুত্বপূর্ণ দপ্তরে জবাবদিহিতা, স্বচ্ছতা এবং জনস্বার্থে সঠিক পদক্ষেপ নিতে বাধ্য করবে।

এই অনুসন্ধানী প্রতিবেদন আমাদের সমাজের সকল স্তরের মানুষকে এই বাস্তবতা সম্পর্কে সচেতন করেছে এবং স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় যে গভীর অব্যবস্থাপনা রয়েছে, তা রোধে জরুরি পদক্ষেপ গ্রহণের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরেছে।

এই প্রতিবেদন শুধু একটি সতর্ক সংকেতই নয়, বরং দেশের সকল নাগরিকদের জন্য একটি নৈতিক ও সামাজিক দায়িত্বের আহ্বান। এদেশের স্বাস্থ্যখাতের উন্নয়ন, জনস্বাস্থ্যের সুরক্ষা, এবং দায়িত্বশীল ওষুধ প্রশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য আজ আমাদেরকে দৃঢ় পদক্ষেপ নিতে হবে। এই প্রতিবেদনের প্রতিটি শব্দে আমি গভীর আশাবাদ ব্যক্ত করছি, যাতে আমরা আমাদের দায়িত্ব পালনে কখনও ব্যর্থ না হই। একুশে পত্রিকার পক্ষ থেকে আমি আবারও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি, যারা এই সাহসী কাজটির সাথে ছিলেন, এবং দেশের সকল নাগরিকদের এই সচেতনতা ও দায়িত্ববোধে উৎসাহিত করছি।

জনস্বার্থে এ ধরনের অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশ করতে পেরে আমি অত্যন্ত গর্বিত, এবং আশা করি, আমাদের এই প্রতিবেদনটি দেশজুড়ে প্রভাব ফেলবে এবং স্বাস্থ্যব্যবস্থায় ইতিবাচক পরিবর্তন আনবে।

লেখক : ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক, একুশে পত্রিকা।