বিশেষজ্ঞহীন ঔষধ প্রশাসন বিপজ্জনক


শরীফুল রুকন : জাতীয় ঔষধ নীতি-২০১৬ প্রণয়নের বিশেষজ্ঞ কমিটির আহ্বায়ক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসি অনুষদের সাবেক ডিন এবং বায়োমেডিকেল রিসার্চ সেন্টারের প্রাক্তন পরিচালক অধ্যাপক আ ব ম ফারুক সম্প্রতি একুশে পত্রিকাকে দীর্ঘ সাক্ষাৎকার দিয়েছেন। তাঁর বক্তব্যে উঠে এসেছে দেশে ওষুধখাতের অব্যবস্থাপনা, ঔষধ প্রশাসনের অযোগ্যতা ও অকার্যকারিতা এবং নিষিদ্ধ ওষুধের অবাধ ব্যবহার নিয়ে গভীর উদ্বেগ। জনস্বাস্থ্যের ওপর এসবের গুরুতর প্রভাবের দিকগুলো নিয়েও তিনি শঙ্কা প্রকাশ করেছেন।

নিষিদ্ধ ওষুধের বিপদ

অধ্যাপক আ ব ম ফারুক সরাসরি উল্লেখ করেন, বাতিল বা নিষিদ্ধ ওষুধ কম্বিনেশন ওষুধ হিসেবে উৎপাদন করা হচ্ছে এবং বাজারে অবাধে বিক্রি করা হচ্ছে, যা জনস্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত বিপজ্জনক। কোনো ওষুধ সাধারণত তার কোনো গুরুতর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া বা কার্যকারিতার অভাবেই নিষিদ্ধ করা হয়। তবে যখন এই নিষিদ্ধ ওষুধ অন্যান্য নিরাপদ ওষুধের সঙ্গে মিশ্রিত করা হয়, তখন এর ঝুঁকি আরও বেড়ে যায়। এমনকি অন্যান্য ওষুধ যদি নিরাপদও হয়, তবু নিষিদ্ধ ওষুধটির কারণে এর প্রভাব বিপজ্জনক হতে পারে।

তিনি উদাহরণ দিয়ে বলেন, যদি কোনো রোগীর শুধুমাত্র একটি নির্দিষ্ট ওষুধের প্রয়োজন হয়, তবে কম্বিনেশন ওষুধের মাধ্যমে সেই রোগী অপ্রয়োজনীয় ও ক্ষতিকর ওষুধের সংস্পর্শে আসে। এই কম্বিনেশন ওষুধের মিশ্রণে নিষিদ্ধ ওষুধ বাজারজাত করে উৎপাদনকারীরা সহজেই নিয়ন্ত্রক সংস্থার নজর এড়িয়ে যেতে পারে। তিনি স্পষ্টভাবে জানান, এ ধরনের পরিস্থিতি জনস্বাস্থ্যের জন্য বড় ধরনের বিপদ বয়ে আনতে পারে এবং এর বিরুদ্ধে ঔষধ প্রশাসনের কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন।

থ্যালিডোমাইড ওষুধ নিয়ে উদ্বেগ

বিশেষ করে থ্যালিডোমাইড নামে একটি বিষাক্ত ওষুধ নিয়ে অধ্যাপক ফারুক গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেন। এই ওষুধটি গর্ভস্থ শিশুর বিকলাঙ্গতার জন্য দায়ী। তিনি বলেন, উন্নত বিশ্বে ষাটের দশকেই এই ওষুধ নিষিদ্ধ করা হয়েছে এবং যুক্তরাষ্ট্রে এটি অনুমোদিত হয়নি। বাংলাদেশে এই ওষুধের উৎপাদনের অনুমোদন দেওয়া উচিত হয়নি বলে তিনি মনে করেন।

তিনি আরও জানান, থ্যালিডোমাইডের বিকল্প হিসেবে আরও নিরাপদ ও কার্যকরী ওষুধ রয়েছে, যা ব্যবহার করা উচিত। তবে বিশেষজ্ঞের অভাবে এই ধরনের ঝুঁকিপূর্ণ ওষুধ অনুমোদিত হচ্ছে, যা জনস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক হুমকি সৃষ্টি করছে। তিনি দাবি করেন, এই ধরনের ওষুধ ব্যবহারের ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে এবং সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে হবে।

ওষুধ কোম্পানির অপশক্তি

অধ্যাপক ফারুক ওষুধ কোম্পানির শক্তিশালী লবি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, ওষুধ কোম্পানিগুলোর প্রভাব এতটাই বেশি যে, তারা ওষুধের যথাযথ পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়াই অনুমোদন পেয়ে যায়। তাঁর মতে, বাংলাদেশে ওষুধের ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল ঠিকমতো হয় না, যার ফলে বিপজ্জনক ওষুধের যথাযথ মূল্যায়ন সম্ভব হয় না।

তিনি আরও বলেন, ওষুধ কোম্পানিগুলোর প্রধান লক্ষ্য লাভ করা, ফলে তারা জনস্বাস্থ্যের দিকটি উপেক্ষা করে। নিষিদ্ধ ও বিপজ্জনক ওষুধ বাজার থেকে সরিয়ে নিলে তাদের আয় কমে যাবে, যা তারা কখনোই চায় না। এছাড়াও নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর দুর্বলতা, রাজনৈতিক প্রভাব, এবং জনসচেতনতার অভাব এই সমস্যাকে আরও বাড়িয়ে তুলেছে।

ঔষধ প্রশাসনে বিশেষজ্ঞের অভাব

অধ্যাপক ফারুকের মতে, বাংলাদেশ ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরে বিশেষজ্ঞের অভাব জনস্বাস্থ্যের জন্য একটি বড় বিপর্যয়ের কারণ হতে পারে। তিনি বলেন, ঔষধ প্রশাসনের মতো গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানে বিশেষজ্ঞ ছাড়া কার্যক্রম পরিচালনা করা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। যেকোনো সময় বড় ধরনের বিপদ ঘটে যেতে পারে।

তবে এডিআর (Adverse Drug Reaction) রিপোর্টিং ব্যবস্থা দুর্বল হওয়ায় বিপজ্জনক ওষুধের কারণে জনস্বাস্থ্যের ক্ষতির সঠিক তথ্য পাওয়া কঠিন। তিনি বলেন, “বাংলাদেশের মানুষ খুব সরল এবং অসহায়। অনেক সময় তারা ওষুধ নিয়ে সমস্যায় পড়লে চুপ করে থাকে, মনে করে আর কি করা যাবে! কিন্তু এমনটি হওয়া উচিত নয়।” তিনি জনস্বাস্থ্যের বিষয়টি সরকারের সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার হিসেবে বিবেচনা করা উচিত বলে মনে করেন।

ভোক্তা প্রতিনিধির গুরুত্ব

অধ্যাপক ফারুক আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আলোকপাত করেন। ঔষধ নিয়ন্ত্রণ কমিটিতে বর্তমানে ডাক্তার, ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধি এবং সরকারের কর্মকর্তারা থাকলেও ভোক্তাদের কোনো প্রতিনিধি নেই। তিনি মনে করেন, ভোক্তাদের প্রতিনিধি থাকলে ঔষধ ব্যবস্থাপনা আরও কার্যকর এবং স্বচ্ছ হতে পারে। এই কমিটিতে বিশেষজ্ঞ ভোক্তা প্রতিনিধি থাকার প্রয়োজনীয়তার উপর জোর দেন অধ্যাপক ফারুক।

সমাধানের উপায়

সর্বোপরি অধ্যাপক আ ব ম ফারুক ঔষধ প্রশাসনের দুর্বলতা এবং এর ফলে সৃষ্ট জনস্বাস্থ্যের হুমকি নিয়ে তার গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, এই ব্যবস্থা পুনর্গঠন করা দরকার এবং বিশেষজ্ঞদের দ্রুত নিয়োগ দেওয়ার মাধ্যমে এই সমস্যার সমাধান করা সম্ভব। এছাড়াও ঔষধ প্রশাসনে জনসচেতনতা বৃদ্ধির পাশাপাশি কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়ার তাগিদ দেন তিনি।

অধ্যাপক ফারুকের মতে, সরকারের উচিত ঔষধের মান নিয়ন্ত্রণে বিশেষজ্ঞদের অন্তর্ভুক্ত করা এবং ওষুধের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে কড়া পদক্ষেপ নেওয়া।

মূল প্রতিবেদন : ঝুঁকি বাড়াচ্ছে এডিআর রিপোর্টে অবহেলা