এম. বেলাল উদ্দিন, বাঁশখালী (চট্টগ্রাম) : চট্টগ্রামের বাঁশখালীতে ২০০ একর সরকারি খাসজমি অবৈধভাবে দখলে রয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। জাল খতিয়ান তৈরি করে এবং প্রভাব খাটিয়ে প্রভাবশালীরা দীর্ঘদিন ধরে এই জমি দখলে রেখেছেন। সেখানে বনভূমি ধ্বংস করে গড়ে তোলা হয়েছে লবণ মাঠ, চিংড়ি ঘের, এমনকি মাছ চাষের জন্য পুকুরও খনন করা হয়েছে। বহু বছর ধরে আইনি লড়াইয়ের পর দেশের সর্বোচ্চ আদালত জমি উদ্ধারের নির্দেশ দিলেও জেলা প্রশাসন কোনো পদক্ষেপ নেয়নি।
উপকূলীয় বন বিভাগের ছনুয়া রেঞ্জের অধীনে খুদুকখালী মৌজায় ২০০৭ থেকে ২০০৯ সালের মধ্যে কয়েক ধাপে ম্যানগ্রোভ বন সৃজন করা হয়। স্থানীয়দের অভিযোগ, এই ম্যানগ্রোভ বনের অন্তর্গত প্রায় ২০০ একর জমি স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান এম. হারুনুর রশীদের নেতৃত্বে জবরদখল করা হয়েছে।
অভিযোগ রয়েছে, ২০০৯ সালের ১ ডিসেম্বর চেয়ারম্যানের নেতৃত্বে প্রায় ৮০-৯০ জন লোক বন বিভাগের প্রায় ১ লাখ ৮০ হাজার বাইন ও কেওড়া গাছ কেটে ফেলে এবং ওই জমিতে চিংড়ি ঘের ও লবণ মাঠ তৈরি করে। এই ঘটনায় বাঁশখালী থানায় মামলা দায়ের করা হলেও পরিস্থিতির কোনো সমাধান হয়নি। পরবর্তীতে আসামিদের বিরুদ্ধে হাইকোর্ট নিষেধাজ্ঞা জারি করলেও তা অমান্য করে সেখানে চিংড়ি ও লবণ চাষ চলতে থাকে।
বন বিভাগের তথ্যমতে, খুদুকখালী মৌজার ৯০ একর জমি সরকারি বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী ১৯৮৪ সালে বন বিভাগের অধীনে হস্তান্তর করা হয় এবং ১৬ একর জমি রিজার্ভ ফরেস্ট হিসেবে ঘোষণা করা হয়। কিন্তু ২০১৬ সালের ১৬ নভেম্বর ইউপি চেয়ারম্যান হারুনুর রশীদ ও তার সহযোগীরা জাল বিএস খতিয়ান তৈরি করে ওই এলাকার ৯৯ একর খাসজমি বিতর্কিত ব্যবসায়ী সালমান এফ রহমানের ছেলে আহমেদ সায়ান ফজলুর রহমানের কাছে বিক্রি করে দেন।
আহমেদ সায়ান ফজলুর রহমান ‘এস্কর্প হোল্ডিংস লিমিটেড’ নামে একটি প্রতিষ্ঠানের পক্ষে ৯ কোটি ২৫ লাখ টাকায় জমিটি কেনেন। দীর্ঘ আইনি প্রক্রিয়ার পর উপকূলীয় বন বিভাগ ও জেলা প্রশাসন জমির মালিকানা ফিরে পেলেও, এখনো তা প্রভাবশালীদের দখলমুক্ত করা সম্ভব হয়নি। জমি বিক্রি করে চেয়ারম্যান হারুনুর রশীদ ও তার পরিবার অর্থনৈতিকভাবে ব্যাপক লাভবান হয়েছেন।
বর্তমানে হারুনুর রশীদ ১৫০ শতক জমির ওপর ৫ কোটি টাকা ব্যয়ে একটি বহুতল ভবন নির্মাণ করেছেন। তার চাচা ও সাবেক চেয়ারম্যান বশির আহমদের ছেলেরাও জমি দখল করে বিভিন্ন ভবন গড়ে তুলেছেন।
মামলার নথিপত্র বিশ্লেষণ করে জানা গেছে, ‘ফ্রেন্ডস ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশন’ নামের একটি প্রতিষ্ঠান খুদুকখালী মৌজার ৯০ একর জমি নারকেল বাগান করার জন্য ১৯৬৬ সালে ২৫ বছরের ইজারা নেয়। কিন্তু ইজারার শর্ত ভঙ্গ করে তারা সেখানে লবণ মাঠ ও চিংড়ি ঘের তৈরি করে।
ইজারার শর্ত ভঙ্গের কারণে ১৯৬৭ সালে জেলা প্রশাসন ইজারা বাতিল করে, তবে ইজারাগ্রহীতারা এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আপিল করেন। পরে ১৯৮৮ সালে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ জেলা প্রশাসনের পক্ষে রায় দিয়ে ইজারা বাতিল ঘোষণা করেন। এরপরও জমি দখলে রেখে সেখানে অবৈধ কার্যক্রম চালানো হয়েছে।
২০১৮ সালের ১১ মার্চ চট্টগ্রাম উপকূলীয় বন বিভাগ জেলা প্রশাসনকে জমি পুনরুদ্ধারের জন্য একটি চিঠি পাঠায়। এই চিঠিতে ৯৯ একর জমি উদ্ধার করে বন বিভাগের অধীনে ফিরিয়ে আনার অনুরোধ জানানো হয়। কিন্তু সাত বছর পরও এই চিঠির কোনো উত্তর মেলেনি। এছাড়াও ২৬ মার্চ জেলা প্রশাসন থেকে একটি চিঠি সহকারী কমিশনার (ভূমি), বাঁশখালীকে জমির বিষয়ে বিস্তারিত জানাতে পাঠানো হলেও কোনো অগ্রগতি হয়নি।
এর মধ্যে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট, আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর বন বিভাগ জমিগুলো দখলমুক্ত করার উদ্যোগ নেয়। ২৬ আগস্ট বন বিভাগের কর্মীরা দখলকৃত এলাকায় লাল পতাকা উত্তোলন করে জমি দখলমুক্ত ঘোষণা করেন। তবে ইউপি চেয়ারম্যান হারুনুর রশীদের অনুগতরা সেই লাল পতাকা ছিঁড়ে ফেলে জমি দখল অব্যাহত রাখেন।
স্থানীয়রা বলছেন, শুষ্ক মৌসুমে এই জমিতে লবণ চাষ এবং বর্ষা মৌসুমে চিংড়ি চাষ করা হয়। স্থানীয় সাবেক চেয়ারম্যান রেজাউল হক চৌধুরী দখলমুক্ত করতে ২ হাজার লোক দিয়ে সহযোগিতার প্রস্তাব দিলেও বন বিভাগের কর্মকর্তারা সেই প্রস্তাবে সাড়া দেননি।
অভিযোগের বিষয়ে ইউপি চেয়ারম্যান এম. হারুনুর রশীদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে তার মোবাইল ফোন বন্ধ পাওয়া যায়। স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, সরকার পতনের পর থেকে তিনি আত্মগোপনে আছেন।
বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মো. বেলায়েত হোসেন বলেন, “আমাদের হাতে হাইকোর্টের রায় রয়েছে, কিন্তু আমরা নিজেরা উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করতে পারবো না। এই কাজ জেলা প্রশাসনের। তাদের আমরা চিঠি দিয়েছি, কিন্তু এখনো কোনো সাড়া পাইনি।”
বাঁশখালী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) জেসমিন আক্তার বলেন, “আমরা এখনো পর্যন্ত জেলা প্রশাসনের কোনো নির্দেশনা পাইনি। নির্দেশনা পেলে অবশ্যই প্রয়োজনীয় আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”