প্রতারিত হাছিনা : স্বামীর জালে সর্বস্ব হারিয়ে ন্যায়বিচারের জয়!


শরীফুল রুকন : জীবনের প্রতিটি অধ্যায়ে হাছিনা বেগম স্বপ্ন দেখেছিলেন সুখের, ভালোবাসার, এবং পরিবারের। বাবা-মা হারানো এই নারী চট্টগ্রামের হাটহাজারী উপজেলার দক্ষিণ পাহাড়তলীর পশ্চিম ছড়ারকুল গ্রামের সাধারণ মেয়ে, যার জীবনের মূল সম্পদ ছিল পৈতৃক সূত্রে পাওয়া সামান্য জমি আর দুই কন্যা সন্তান—জান্নাতুল নাঈম (১১) ও জান্নাতুল ফাহিম (১০)।

২০০৯ সালে ভালোবাসা আর বিশ্বাসের বন্ধনে আবদ্ধ হন মো. হানিফের সঙ্গে। স্বপ্ন দেখেছিলেন একটি সুখী পরিবারের, যেখানে ভালোবাসা আর সম্মানের সাথে কাটবে দিনগুলো। কিন্তু সেই স্বপ্ন ভেঙে চুরমার হতে শুরু করে বিয়ের পর থেকেই। স্বামীর নির্যাতন, অবহেলা আর নিরন্তর যৌতুকের দাবিতে হাছিনার জীবন এক অবর্ণনীয় দুঃস্বপ্নে পরিণত হয়।

প্রথমে তিনি ভেবেছিলেন, সময়ের সাথে সব ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু হানিফের অত্যাচার ক্রমেই বাড়তে থাকে। হাছিনা যেহেতু লেখাপড়া জানতেন না, তাই স্বামীর উপরই ছিল তার অগাধ বিশ্বাস। এই বিশ্বাসকে পুঁজি করে হানিফ তার উপর চালায় একের পর এক প্রতারণা। যৌতুকের দাবিতে নির্যাতন এমন পর্যায়ে পৌঁছায় যে, বাধ্য হয়ে তিনি পৈতৃক সম্পত্তির এক গন্ডা জমি হানিফকে হেবা করতে রাজি হন।

২০১৩ সালের ৬ মে, স্বামীর কথামতো ফতেয়াবাদ সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে গিয়ে দলিলে স্বাক্ষর করেন হাছিনা। তিনি ভেবেছিলেন মাত্র এক গন্ডা জমি দিচ্ছেন স্বামীকে, যাতে তার সংসারটা টিকে থাকে, স্বামীর ভালোবাসা ফিরে পান। কিন্তু অজান্তেই স্বাক্ষর করেন সেই দলিলে, যেখানে হানিফ প্রতারণা করে পাঁচ গন্ডা জমি লিখে নেয়। নিজের জীবনের শেষ সম্বলটুকুও হারিয়ে ফেলেন হাছিনা, অথচ তিনি তা জানতেও পারেননি।

এরপরও অত্যাচারের শেষ হয়নি। ২০২২ সালের ৬ আগস্ট, হানিফ আবারও যৌতুকের দাবিতে নির্যাতন শুরু করে। এবার সিএনজি অটোরিকশা কেনার জন্য পাঁচ লক্ষ টাকা চাইলেন তিনি। হাছিনা কোথা থেকে এত টাকা আনবেন? পৈতৃক সম্পত্তির আর কিছু অবশিষ্ট আছে মনে করে, সেখান থেকে দিতে চাইলে স্বামী হানিফ জানান যে, আর কোনো জমি নেই হাছিনার কাছে, তখন হানিফ তাকে ঘর থেকে বের করে দেয়। একা, অসহায় হাছিনা তখনও জানতেন না যে তার স্বামী তার সাথে এত বড় প্রতারণা করেছে।

কিছুদিন পর হানিফ উল্টো হাছিনার বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা করে। আদালতে মামলার কাগজপত্র দেখে হাছিনা জানতে পারেন যে, তার স্বামী প্রতারণার মাধ্যমে তার পাঁচ গন্ডা জমি আত্মসাৎ করেছে। নিজের বিশ্বাস, ভালোবাসা আর সর্বস্ব হারিয়ে তিনি ভেঙে পড়েন। কিন্তু হাল ছাড়েননি।

হাছিনা সিদ্ধান্ত নেন ন্যায়বিচারের জন্য লড়াই করবেন। বোন পারভীন আক্তার ও বোনের স্বামী মো. হারুন পাশে দাঁড়ান। তারা সাহস দেন হাছিনাকে, প্রেরণা দেন সত্যের পথে এগিয়ে যাওয়ার।

চট্টগ্রামের সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট ফারদিন মুস্তাকিম তাসিনের আদালতে শুরু হয় এই মামলার শুনানি। মামলার নম্বর সিআর মামলা নং ৬৬৯/২০২২ (হাটহাজারী)। সাক্ষ্যপ্রমাণ, দলিলপত্র এবং স্বাক্ষীদের জবানবন্দি উপস্থাপিত হয় আদালতে। হাছিনার কষ্ট, তার জীবনের প্রতিটি অধ্যায় যেন প্রতিধ্বনিত হতে থাকে আদালতের চারপাশে।

মামলার সাক্ষ্য দিতে গিয়ে হাছিনা বললেন, “আমি আমার স্বামীর উপর অগাধ বিশ্বাস করতাম। কখনও ভাবিনি সে আমার সাথে এমন প্রতারণা করবে। আমি শুধু চেয়েছিলাম আমাদের সংসারটা টিকে থাকুক। সন্তানদের মুখের দিকে তাকিয়ে সব সহ্য করেছি। কিন্তু সে আমার সর্বস্বই কেড়ে নিয়েছে।”

পারভীন আক্তার কাঁদতে কাঁদতে বলেন, “আমার বোনের জীবনের এই দুর্দশা দেখেও আমরা কিছু করতে পারিনি। সে আমাদের জানিয়েছিল যে এক গন্ডা জমি হেবা করেছে স্বামীকে। কিন্তু আমরা জানতাম না সে এত বড় প্রতারণার শিকার হয়েছে।”

পারভীনের স্বামী মো. হারুন বলেন, “হানিফ একজন প্রতারক। সে আমার স্ত্রীর বড় বোনকে শুধু নয়, আমাদের সবাইকে ধোঁকা দিয়েছে। আমরা চাই সে তার অপরাধের যথাযথ শাস্তি পাক।”

এদিকে, মামলার বাদীপক্ষের আইনজীবী মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান খান আবেগময় কণ্ঠে বলেন, “হানিফ আদালতে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন যে তিনি সম্পত্তি কারও কাছে হস্তান্তর করবেন না। কিন্তু সেই প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করে তিনি সম্পত্তি হস্তান্তর করেন এবং এলাকার প্রভাবশালী মহলের সঙ্গে যুক্ত হয়ে দুর্ধর্ষ হয়ে ওঠেন। এই অবস্থায় হাছিনার ন্যায়বিচার পাওয়া নিয়ে সংশয় তৈরি হয়েছিল। কিন্তু তবুও হাছিনা পুলিশ ও বিচার বিভাগের ওপর অগাধ আস্থা রেখে ন্যায়বিচারের লড়াই চালিয়ে গেছেন। প্রভাবশালীদের প্রভাব থাকা সত্ত্বেও ধৈর্য ধরে তিনি শেষ পর্যন্ত ন্যায়বিচার পেয়েছেন।”

“এই মামলায় বিচার শেষ হওয়ার আগে হানিফ ১০০ দিন জেলে ছিলেন। আমি ব্যক্তিগতভাবে এই মামলায় হাছিনার কাছ থেকে কোনো ফি নেইনি। লিগ্যাল এইডের মতো করে আমরা তাকে সহায়তা করেছি। আমার আসাদুজ্জামান এসোসিয়েটসের সকল সদস্য বিনা ফিসে তার জন্য পরিশ্রম করেছেন। আমাদের উদ্দেশ্য ছিল একটাই—অন্যায়ের বিরুদ্ধে সত্যের জয় নিশ্চিত করা।” বলেন আইনজীবী মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান খান।

এই মামলায় পুলিশ ও বিচার বিভাগও ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। তাদের নিরপেক্ষ তদন্ত এবং সঠিক বিচার কার্যক্রমের ফলে হাছিনা তার প্রাপ্য ন্যায়বিচার পেয়েছেন। তাদের এই নিষ্ঠা ও দায়িত্বশীলতা প্রশংসনীয়।

দীর্ঘ শুনানির পর, সাক্ষ্যপ্রমাণ বিশ্লেষণ করে আদালত সিদ্ধান্তে পৌঁছায় যে হানিফ সত্যিই প্রতারণা ও বিশ্বাসভঙ্গ করেছেন। দণ্ডবিধির ৪০৬ ও ৪২০ ধারায় তাকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়। ২০২৪ সালের ৮ জুলাই, আদালত মো. হানিফকে দুই বছরের সশ্রম কারাদণ্ড এবং অর্থদণ্ড প্রদান করেন। পাশাপাশি তার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানাও জারি করা হয়।

রায়ের পর হাছিনা বেগমের চোখে অশ্রু ঝরছিল। তবে সে অশ্রু ছিল স্বস্তির, ছিল ন্যায়বিচারের জয়ের অশ্রু। তিনি বলেন, “আজ আমি প্রমাণ করতে পেরেছি যে সত্যের জয় হয়। আমি চাই না আর কোনো নারী আমার মতো প্রতারণার শিকার হোক। আমি তাদের সকলকে বলব, ন্যায়বিচারের জন্য লড়াই করতে ভয় পেও না।”

হাছিনা বেগমের এই সংগ্রামের গল্প শুধু একটি নারীর নয়, এটি হাজারো নারীর গল্প যারা সমাজের অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াই করছেন। তাদের সাহস, তাদের অটুট মনোবল আমাদের সবাইকে অনুপ্রেরণা জোগায়। সমাজের প্রতিটি স্তরে এই ধরনের অন্যায় প্রতিরোধ করতে আমাদের সকলেরই এগিয়ে আসা প্রয়োজন।

বাদী পক্ষের আইনজীবী মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান খান বলেন, “হাছিনা বেগমের এই জয় আমাদের সকলের জন্যই একটি মাইলফলক। এটি প্রমাণ করে যে, আইন এবং ন্যায়বিচার এখনও জীবিত আছে। আমরা আশা করি এই রায় অন্যান্য নারীদেরও সাহস দেবে অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে।”

তিনি আরও বলেন, “এই ঘটনা আমাদের সমাজের এক করুণ বাস্তবতার চিত্র তুলে ধরেছে। নারীদের প্রতি সহিংসতা এবং প্রতারণা বন্ধ করতে আমাদের সকলেরই দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করা উচিত।”