সোমবার, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ৯ পৌষ ১৪৩১

মধ্যস্বত্বভোগীদের সিন্ডিকেটে কৃষক ঠকে, ভোক্তা পুড়ে: মুক্তির উপায় কী?

প্রকাশিতঃ ১৭ অক্টোবর ২০২৪ | ৮:০০ পূর্বাহ্ন

নজরুল কবির দীপু
নজরুল কবির দীপু : বর্তমানে বাংলাদেশে নিত্যপণ্যের দাম অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যাওয়ায় সমাজের সর্বস্তরের মানুষ চরম সংকটে পড়েছে। পরিস্থিতির উন্নতির আশায় জনগণ নিত্যপণ্যের দাম কমবে বলে আশা করেছিল, কিন্তু সেই আশা পূরণ হয়নি। বরং চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন শহরে পণ্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি অব্যাহত রয়েছে। এই মূল্যবৃদ্ধির মূল কারণ হলো বাজার সিন্ডিকেটের অবাধ কর্মকাণ্ড, যারা ইচ্ছেমতো পণ্যের দাম বাড়িয়ে সাধারণ মানুষের জীবন দুর্বিষহ করে তুলছে।

চট্টগ্রামের বাজারে সবজির দাম আকাশছোঁয়া। প্রায় সব ধরনের সবজিই এখন কেজিপ্রতি ১০০ টাকা ছাড়িয়ে গেছে, যা মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত পরিবারের জন্য অসহনীয় হয়ে উঠেছে। বিশ্লেষণে দেখা যায় যে, কৃষকের কাছ থেকে যে দামে সবজি কেনা হয়, তার চেয়ে প্রায় পাঁচগুণ বেশি দামে তা ভোক্তাদের কিনতে হচ্ছে। উৎপাদনস্থল থেকে ভোক্তার কাছে পৌঁছানোর প্রতিটি ধাপেই দাম বৃদ্ধি পাচ্ছে। মধ্যস্বত্বভোগী এবং ফড়িয়া ব্যবসায়ীরা মিলে সিন্ডিকেট করে প্রতিটি ধাপে দাম বাড়িয়ে চলেছে। ফলে কৃষক যে দামে পণ্য বিক্রি করেন, নগরবাসীকে সেই পণ্য কিনতে হচ্ছে অনেক বেশি দামে।

বরবটির দামের ঊর্ধ্বগতি এই সমস্যার একটি স্পষ্ট উদাহরণ। কৃষকের কাছ থেকে ব্যবসায়ীরা ৩০-৩৫ টাকা কেজিতে বরবটি কিনলেও, একাধিক বার হাত বদলের পর খুচরা বাজারে তা ১২০ টাকা কেজিতে বিক্রি হচ্ছে। পণ্যের এই চক্রাকার হাতবদলই মূল্যবৃদ্ধির প্রধান কারণ। শুধু সবজি নয়, ডিম, মাছ, মাংস, চাল সহ অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দামও একইভাবে বেড়ে চলেছে।

মূল্যবৃদ্ধির অন্যতম কারণ হলো পাইকারি ব্যবসায়ী ও মধ্যস্বত্বভোগীদের সিন্ডিকেট। চট্টগ্রামের পাহাড়তলীসহ দেশের বিভিন্ন পাইকারি বাজারে এই সিন্ডিকেট সক্রিয়ভাবে পণ্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ করছে। সম্প্রতি পাহাড়তলীর আড়তে ডিম বিক্রি বন্ধ করে দেওয়ার ঘটনা এর একটি উদাহরণ। সরকারি তদারকি শুরু হলে পাইকারি ব্যবসায়ীরা পণ্য সরবরাহ বন্ধ করে দেয়, ফলে খুচরা বাজারে দাম বেড়ে যায়। যেমন, ফার্মের মুরগির ডিমের দাম এখন প্রতি ডজন ১৮০-১৯০ টাকা, যা আগে অনেক কম ছিল।

এখানে প্রশ্ন উঠছে, কেন অভিযান পরিচালিত হওয়ার পরও পণ্যের দাম বাড়ছে? এর উত্তর স্পষ্ট—সিন্ডিকেটের কারসাজি। যখন বাজার তদারকির উদ্যোগ নেওয়া হয়, তখন সিন্ডিকেট সদস্যরা একসঙ্গে মিলিত হয়ে পণ্য সরবরাহ কমিয়ে দেয়, যার ফলে কৃত্রিম সংকট তৈরি হয় এবং পণ্যের দাম আরও বেড়ে যায়। ফলে তদারকি কার্যক্রমের পরিপূর্ণ সুফলও পাচ্ছেন না সাধারণ মানুষ।

বর্তমান পরিস্থিতিতে সিন্ডিকেটের প্রভাব মোকাবিলা করা অত্যন্ত জরুরি। যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সম্প্রতি ঘোষণা দিয়েছেন, সিন্ডিকেটকারীদের বিশেষ ক্ষমতা আইনের আওতায় গ্রেফতার করা হবে। এই ঘোষণাটি জনগণের জন্য কিছুটা আশার আলো দেখিয়েছে, তবে এর বাস্তবায়ন কতটা কার্যকর হবে, তা নিয়ে সন্দেহ থেকেই যায়। কারণ অতীতে সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে বিভিন্ন আইনানুগ পদক্ষেপ নেওয়ার কথা বলা হলেও কার্যত তেমন কোনো দীর্ঘমেয়াদি ফলাফল দেখা যায়নি।

সিন্ডিকেট নির্মূল করতে হলে সরকারের আরও কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন। প্রথমত, পণ্যের উৎপাদক থেকে ভোক্তা পর্যায়ে সরবরাহের প্রতিটি ধাপ পর্যবেক্ষণ করতে হবে। কোথায় কোথায় পণ্যের দাম অস্বাভাবিকভাবে বাড়ছে, তা সঠিকভাবে শনাক্ত করতে হবে। মধ্যস্বত্বভোগী ও ফড়িয়া ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেট ভেঙে দেওয়া জরুরি। পাশাপাশি, সরকারের বিভিন্ন তদারকি সংস্থার মধ্যে সমন্বয় বৃদ্ধি করতে হবে, যাতে তারা বাজার পর্যবেক্ষণ এবং অভিযান পরিচালনার ক্ষেত্রে আরও সক্রিয়ভাবে কাজ করতে পারে।

বাংলাদেশের বাজারে পণ্যমূল্য বৃদ্ধির আরেকটি কারণ হলো আমদানির ওপর অতিরিক্ত নির্ভরতা। অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায়, দেশের অভ্যন্তরে উৎপাদিত পণ্য বাজারে পর্যাপ্ত পরিমাণে সরবরাহ না হওয়ার কারণে বিদেশ থেকে পণ্য আমদানি করতে হয়। কিন্তু আমদানি ব্যয় এবং আন্তর্জাতিক বাজারের মূল্যবৃদ্ধির কারণে এসব পণ্যের দাম দেশেও বেড়ে যায়। উদাহরণস্বরূপ, চাল, পেঁয়াজ, ও ভোজ্য তেলের মতো নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য আমদানি করতে গিয়ে সরকারের ওপর প্রচুর চাপ সৃষ্টি হয় এবং এর প্রভাব সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন জীবনে পড়ে।

এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য সরকারকে পণ্য উৎপাদনের ক্ষেত্রে স্বনির্ভর হওয়ার দিকে মনোযোগ দিতে হবে। কৃষকদের জন্য সঠিক সহায়তা প্রদান, আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার এবং উৎপাদন খরচ কমানোর ব্যবস্থা নিতে হবে। এছাড়াও, দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার মাধ্যমে নিত্যপণ্যের উৎপাদন বৃদ্ধি এবং আমদানির ওপর নির্ভরশীলতা কমাতে হবে। এতে করে স্থানীয় বাজারে পণ্যের সরবরাহ নিশ্চিত হবে এবং পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব হবে।

বর্তমান বাজার পরিস্থিতিতে কৃষক এবং ভোক্তাসাধারণ উভয়ই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। কৃষকরা তাদের উৎপাদিত পণ্য সঠিক মূল্য না পাওয়ায় আর্থিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ছেন, অন্যদিকে ভোক্তারা চড়া দামে পণ্য কিনতে বাধ্য হচ্ছেন। এর ফলে দেশের অর্থনৈতিক ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে এবং মানুষের জীবনযাত্রার মানের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। এই সমস্যা সমাধানে সরকারকে একদিকে যেমন সিন্ডিকেট ভেঙে দিতে হবে, তেমনি কৃষকদের জন্য সঠিক মূল্য নির্ধারণে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। এর মাধ্যমে কৃষকরা তাদের ন্যায্য মূল্য পাবে এবং ভোক্তাদেরও স্বস্তি আসবে।

সিন্ডিকেটের কারসাজিতে নিত্যপণ্যের বাজারে যে অস্থিতিশীলতা তৈরি হয়েছে, তা দেশের সাধারণ মানুষের জীবনে গভীর প্রভাব ফেলেছে। এই সংকট মোকাবিলায় সরকারের দায়িত্বশীল পদক্ষেপ গ্রহণ করা অত্যন্ত জরুরি। সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া, পণ্যের উৎপাদন বৃদ্ধি এবং আমদানিনির্ভরতা কমানোই হতে পারে এই সংকটের দীর্ঘমেয়াদি সমাধান। একমাত্র তখনই বাজারে পণ্যমূল্য স্থিতিশীল হবে এবং কৃষক ও ভোক্তাসাধারণ উভয়েই স্বস্তি পাবে।

লেখক : ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক, একুশে পত্রিকা।