ইলিশের কান্না: প্রথম আলোর অনুসন্ধানে উন্মোচিত হৃদয়বিদারক বাস্তবতা


শরীফুল রুকন : ইলিশ—এই এক শব্দের মধ্যে লুকিয়ে আছে বাঙালির আবেগ, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি এবং অস্তিত্বের মূল সুর। আমাদের জাতীয় মাছ ইলিশের সাথে বাঙালির সম্পর্ক শুধুই রসনা তৃপ্তির নয়; এটি আমাদের হৃদয়ের গভীরে লালিত এক স্বপ্ন, এক অহংকার। কিন্তু আজ, সেই ইলিশই কাঁদছে। দৈনিক প্রথম আলো সম্প্রতি ইলিশ মাছ নিয়ে যে তিন পর্বের হৃদয়স্পর্শী এবং গভীর অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে, তা পড়ে আমাদের হৃদয় ভারাক্রান্ত হয়ে উঠেছে। এই প্রতিবেদনে যে নির্মম বাস্তবতা তুলে ধরা হয়েছে, তা আমাদের সমাজের অবহেলা, শোষণ এবং অসচেতনতার চিত্র স্পষ্টভাবে ফুটিয়ে তুলেছে।

প্রথম পর্বে আমরা দেখতে পাই, জলবায়ু পরিবর্তনের করাল গ্রাসে ইলিশের প্রজনন কীভাবে বিপর্যস্ত হচ্ছে। ডুবোচরগুলো ইলিশের চলার পথকে রুদ্ধ করে দিচ্ছে, তাদের ডিম ছাড়ার স্বাভাবিক পরিবেশ নষ্ট করছে। মা ইলিশের পেটে ডিম এলেও, সেই ডিম ছাড়ার সুযোগ মিলছে না। আমাদের অবিবেচক কর্মকাণ্ড, নিষিদ্ধ জাল ব্যবহারের মাধ্যমে পোনা ও রেণু নিধন, সব মিলিয়ে ইলিশের অস্তিত্ব হুমকির মুখে। সাংবাদিকরা যখন জেলেদের সঙ্গে কথা বলেছেন, তাঁদের চোখে যে হতাশা ও বেদনা ফুটে উঠেছে, তা আমাদের হৃদয়কে নাড়া দিয়েছে। আমরা কি এই অপরাধের অংশীদার নই?

এই প্রতিবেদনে বিশেষজ্ঞদের মতামত উঠে এসেছে, যেখানে তাঁরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বৃষ্টির ব্যাকরণ বদলে যাচ্ছে। ইলিশের প্রজননের জন্য দরকার পর্যাপ্ত বৃষ্টি, নদীর স্রোত এবং গভীরতা। কিন্তু আমরা সেই পরিবেশ নষ্ট করে ফেলছি। ডুবোচরের কারণে ইলিশের চলাচলের পথ বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। জেলেরা জানান, নদীতে আগের মতো ইলিশ নেই। তাঁদের জীবিকা হুমকির মুখে।

প্রতিবেদনে নিষিদ্ধ জাল ব্যবহারের কথাও উল্লেখ করা হয়েছে। অবৈধ জাল ফেলে আমরা নির্বিচারে ধ্বংস করছি ইলিশের পোনা, অন্যান্য মাছের রেণু-পোনা। এটি শুধু ইলিশের নয়, আমাদের সমগ্র জলজ সম্পদের উপর এক বিরাট আঘাত। আমরা কি এভাবে নিজেরাই নিজেদের সর্বনাশ ডেকে আনছি না?

দ্বিতীয় পর্বে দাদন চক্রের চরম অমানবিকতা প্রকাশ পেয়েছে। পাঁচ স্তরের কারবারিরা মুনাফার লোভে জেলেদের জীবনকে নরকে পরিণত করেছেন। জেলেরা সাগরে জীবন বাজি রেখে ৯-১০ দিন ধরে মাছ ধরে আনছেন, অথচ বাড়ি ফিরছেন মাথাপিছু ঋণ নিয়ে! এই শোষণ, এই অন্যায় কি আমরা মেনে নিতে পারি? দাদনদারদের এই ফাঁদে পড়ে জেলেরা নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছেন, তাঁদের পরিবারের মুখে হাসি নেই। ইলিশের এই করুণ কাহিনী আমাদের কষ্ট দিচ্ছে।

প্রতিবেদনে আমরা দেখেছি, কীভাবে দাদন চক্রের মারপ্যাঁচে জেলেরা প্রতারিত হচ্ছেন। একদল জেলে যে মাছ ধরে আনলেন, তা বিক্রি হলো ছয় লাখ টাকায়। কিন্তু দাদন চক্রের পাঁচ ধাপের কারবারিরা কমবেশি কয়েক হাজার টাকা করে পকেটস্থ করলেন। আর জেলেরা মাথাপিছু ৫৭১.৪২ টাকার দেনা নিয়ে বাড়ি ফিরলেন। এটি কি কোনো সভ্য সমাজে সহ্য করা যায়? তাঁদের অক্লান্ত পরিশ্রমের ফল ভোগ করছে দাদনদাররা, আর জেলেদের কপালে জুটছে কেবল হতাশা আর বঞ্চনা।

শেষ পর্বে আমরা দেখেছি, আইন থাকা সত্ত্বেও কীভাবে দাদনদাররা তাঁদের অপকর্ম চালিয়ে যাচ্ছে। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নিষ্ক্রিয়তা, উদাসীনতা এবং অবহেলা ইলিশের বিপর্যয়কে আরও গভীর করছে। দাদন প্রথার কোনো আইনি ভিত্তি নেই, তবুও এটি বহাল তবিয়তে চলছে। জেলেরা মুক্তির পথ খুঁজে পাচ্ছেন না, আর আমরা যেন চোখ বুজে আছি। আমাদের ‘জাতীয় মাছ’ ইলিশ কি এভাবেই দাদনের জালে জড়িয়ে নিঃশেষ হয়ে যাবে?

প্রতিবেদনে আইনি বিশ্লেষণ করে দেখানো হয়েছে, দাদন প্রথা অবৈধ। কিন্তু কর্তৃপক্ষের নিষ্ক্রিয়তার কারণে এটি রোধ করা যাচ্ছে না। আইনজীবীরা বলেছেন, প্রতিযোগিতা কমিশন, মাইক্রোক্রেডিট রেগুলেটরি অথরিটি এবং ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর এ বিষয়ে কার্যকর ভূমিকা নিতে পারে। কিন্তু তাঁদের নিষ্ক্রিয়তা আমাদের হতাশ করেছে। আমরা কি এভাবেই অবহেলার চাদরে নিজেদের মোড়াবো?

এই তিন পর্বের অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে প্রথম আলোর সাংবাদিকরা যে সাহস, নিষ্ঠা এবং মানবিকতা প্রদর্শন করেছেন, তা সত্যিই প্রশংসার যোগ্য। তাঁরা নিজেদের জীবনকে ঝুঁকিতে ফেলে, রাত-দিন পরিশ্রম করে আমাদের সামনে এই নির্মম সত্য তুলে ধরেছেন। তাঁদের মেন্টর তৌহিদুর রহমান, যিনি অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার আলোকবর্তিকা, তাঁর দিকনির্দেশনা এবং নেতৃত্ব এই প্রতিবেদনের মানকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছে। তাঁদের প্রতি আমাদের গভীর শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতা।

সাংবাদিকরা দেশের বিভিন্ন স্থানে ঘুরে ঘুরে তথ্য সংগ্রহ করেছেন। নদ-নদী, সাগর-মোহনা, ইলিশের অভয়াশ্রম, ইলিশ-ঘাট, বাণিজ্যকেন্দ্র এবং খুচরা বাজারগুলোতে গিয়ে তাঁরা যে তথ্য সংগ্রহ করেছেন, তা আমাদের চেতনাকে নাড়া দিয়েছে। তাঁদের সাহসী পদক্ষেপ ছাড়া আমরা এই নির্মম সত্যের মুখোমুখি হতে পারতাম না।

এই প্রতিবেদনের প্রতিটি শব্দ, প্রতিটি বাক্য আমাদের অন্তরে বেদনার সুর তোলে। আমরা কি এভাবেই নির্বিকার থাকব? ইলিশের এই আর্তনাদ কি আমাদের বিবেককে জাগ্রত করবে না? আসুন, আমরা সবাই মিলে দাদন চক্রের বিরুদ্ধে সোচ্চার হই। জেলেদের অধিকার ফিরিয়ে দিই, ইলিশের প্রজননক্ষেত্র রক্ষা করি। সরকার, প্রশাসন, সমাজের সচেতন নাগরিক—সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় আমরা ইলিশের এই বিপর্যয় রোধ করতে পারি।

আমাদের প্রয়োজন আইন প্রয়োগের সঠিক বাস্তবায়ন। দাদন প্রথা বন্ধ করতে হবে। জেলেদের স্বল্পসুদে ঋণ দিয়ে তাঁদের জীবিকা নির্বাহের সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে। নিষিদ্ধ জাল ব্যবহার বন্ধ করতে হবে। ইলিশের প্রজননক্ষেত্র সংরক্ষণে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি সুন্দর পৃথিবী রেখে যাওয়ার দায়িত্ব আমাদেরই।

ইলিশের সাথে আমাদের আত্মিক সম্পর্ক। এটি আমাদের সংস্কৃতি, আমাদের ইতিহাস, আমাদের গর্ব। আমাদের উচিত ইলিশের হারানো জৌলুস ফিরিয়ে আনা। ইলিশের জন্য আমাদের সংগ্রাম করা উচিত, কারণ এটি আমাদের নিজস্ব পরিচয়ের অংশ।

প্রথম আলোর এই অনুসন্ধানী প্রতিবেদন আমাদের চোখ খুলে দিয়েছে। এখন সময় এসেছে কাজ করার। দাদন প্রথা বন্ধ করতে হবে, জেলেদের জীবনমান উন্নত করতে হবে, ইলিশের প্রজননক্ষেত্র রক্ষা করতে হবে। আমাদের সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় আমরা ইলিশের হারানো জৌলুস ফিরিয়ে আনতে পারি।

অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের শিক্ষক তৌহিদুর রহমান এবং প্রথম আলোর সাহসী সাংবাদিকদের আবারও জানাই আন্তরিক ধন্যবাদ ও শুভেচ্ছা। তাঁদের এই নিরলস প্রচেষ্টা আমাদেরকে নতুন করে স্বপ্ন দেখিয়েছে, পরিবর্তনের আশা জাগিয়েছে। আমরা আশা করি, প্রথম আলোর এই অনুসন্ধান ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে এবং ইলিশের বিপর্যয় রোধে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হবে।

আসুন, আমরা ইলিশের কান্না শুনি, আমাদের বিবেককে জাগ্রত করি, এবং একটি সুন্দর ভবিষ্যৎ নির্মাণে সকলে মিলে কাজ করি।

লেখক : প্রধান প্রতিবেদক, একুশে পত্রিকা