নজরুল কবির দীপু : বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের ধারাবাহিকতা রক্ষা ও জনগণের জীবনমান উন্নয়নের জন্য দুর্নীতি দমন একটি অপরিহার্য শর্ত। বিগত ১৫ বছরে দেশের বিভিন্ন সেক্টরে দুর্নীতি যে ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে, তা সাম্প্রতিক বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদনের মাধ্যমে স্পষ্ট হয়েছে। বিশেষ করে সড়ক ও জনপথ (সওজ) অধিদপ্তরের আওতাধীন প্রকল্প বাস্তবায়নে বিশাল অঙ্কের অর্থ লোপাটের ঘটনা আমাদেরকে গভীরভাবে উদ্বিগ্ন করে তুলেছে।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) প্রকাশিত এক গবেষণা প্রতিবেদনে উঠে এসেছে যে, সওজের প্রকল্প বাস্তবায়নে সর্বোচ্চ ৪০ শতাংশ অর্থ লোপাট হয়েছে, যার মোট পরিমাণ প্রায় ৫১ হাজার কোটি টাকা। এই অর্থ লোপাটের পেছনে তিন শ্রেণির সমন্বিত একটি চক্রের ভূমিকা রয়েছে—রাজনৈতিক প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব, আমলা এবং ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান উল্লেখ করেছেন যে, ত্রিমুখী যোগসাজশের মাধ্যমে সড়ক ও মহাসড়কে দুর্নীতি সংঘটিত হয়েছে, যা দেশের অবকাঠামোগত উন্নয়নের পথে বড় বাধা সৃষ্টি করেছে।
বিশ্বব্যাংকের তথ্যানুসারে, বাংলাদেশে চার লেনের সড়ক নির্মাণে প্রতি বর্গকিলোমিটারে নির্মাণ খরচ প্রতিবেশী দেশগুলোর তুলনায় ২ থেকে ৯ গুণ এবং ইউরোপের তুলনায় ২ গুণ বেশি। এ তথ্য আমাদেরকে বাধ্য করে ভাবতে যে, কেন আমাদের দেশে নির্মাণ খরচ এত বেশি? এর পেছনে প্রধান কারণ হিসেবে দুর্নীতি ও অনিয়মকে দায়ী করা হয়। দরপত্র প্রক্রিয়া ম্যানুয়াল থেকে অটোমেশনে স্থানান্তরিত হলেও পরিস্থিতির কোনো উন্নতি হয়নি। এর মানে হলো, প্রযুক্তিগত পরিবর্তনের পাশাপাশি আমাদের মানসিকতারও পরিবর্তন জরুরি।
দুর্নীতি শুধু সড়ক বা অবকাঠামো খাতে সীমাবদ্ধ নয়। বিগত ১৫ বছরে দেশের প্রায় সব খাতেই দুর্নীতি ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। ব্যাংকিং খাতে লুটপাট, অর্থপাচার, সরকারি ক্রয়ে অনিয়ম—এসবই আমাদের অর্থনীতিকে দুর্বল করে তুলেছে। প্রতিবছর বিপুল অঙ্কের অর্থ দেশের বাইরে পাচার হচ্ছে, যা দেশের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য হুমকি।
একটি প্রকল্পে বৃক্ষরোপণের জন্য ৭৪ লাখ টাকা বরাদ্দ থাকার পরও একটি গাছও না লাগানো দুর্নীতির মাত্রাকে স্পষ্ট করে। এসব ঘটনা শুধু অর্থনৈতিক ক্ষতিই নয়, পরিবেশের ওপরও নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। নিম্নমানের উপকরণ ব্যবহার করে অবকাঠামো নির্মাণের ফলে জনগণের জীবনও ঝুঁকির মুখে পড়ছে।
দুর্নীতি দমন করতে হলে আমাদের প্রথমেই স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে। প্রকল্প বাস্তবায়নে সংশ্লিষ্ট সকলের কার্যক্রমের ওপর কঠোর নজরদারি প্রয়োজন। অভিযোগ উঠলে নিরপেক্ষ অনুসন্ধান এবং অপরাধীর দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। এখানে রাজনৈতিক প্রভাব মুক্ত একটি সিস্টেম গড়ে তোলা জরুরি, যেখানে কেউই আইনের ঊর্ধ্বে নয়।
নতুন আইন প্রণয়ন করে দুর্নীতি দমন সম্ভব, তবে তা কার্যকর করতে হলে আইনের সঠিক প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। আইন থাকলেও যদি তা প্রয়োগ না হয়, তাহলে দুর্নীতি কমবে না। দুর্নীতি দমনে শক্তিশালী ও স্বাধীন প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা প্রয়োজন, যারা নিরপেক্ষভাবে কাজ করতে পারবে।
জনগণের সচেতনতা বাড়ানোও দুর্নীতি দমনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। গণমাধ্যম, সিভিল সোসাইটি এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর মাধ্যমে দুর্নীতির বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তুলতে হবে। তরুণ প্রজন্মকে সৎ ও নৈতিক মূল্যবোধসম্পন্ন করে গড়ে তোলার মাধ্যমে ভবিষ্যতে দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশ গড়া সম্ভব।
অন্তর্বর্তী সরকার দেশের সব সেক্টরে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি প্রতিষ্ঠায় কার্যকর পদক্ষেপ নেবে—এটাই দেশবাসীর প্রত্যাশা। দুর্নীতি দমনে রাজনৈতিক সদিচ্ছা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যদি শীর্ষ পর্যায় থেকে দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া হয়, তাহলে নিচের স্তরগুলোতেও তার প্রভাব পড়বে।
দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি ঘোষণাই যথেষ্ট নয়; তা কার্যকরভাবে বাস্তবায়ন করতেই হবে। শুধু ঘোষণায় সীমাবদ্ধ থাকলে দুর্নীতি কমবে না, বরং দুর্নীতিবাজরা আরও সাহসী হয়ে উঠবে। তাই বাস্তবায়নের জন্য সুস্পষ্ট কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন ও তার কার্যকরী বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে হবে।
দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করতে হলে দুর্নীতি দমন জরুরি। বিদেশি বিনিয়োগকারীরাও এমন দেশে বিনিয়োগ করতে আগ্রহী হন, যেখানে দুর্নীতি কম এবং আইনের শাসন নিশ্চিত। তাই দুর্নীতি দমনের মাধ্যমে আমরা বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণ করতে পারি, যা দেশের অর্থনীতিকে আরও শক্তিশালী করবে।
দুর্নীতি দমনে তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ানো যেতে পারে। ই-গভর্নেন্স, অনলাইন টেন্ডারিং, ডিজিটাল পেমেন্ট সিস্টেম—এসবের মাধ্যমে দুর্নীতির সুযোগ কমানো সম্ভব। তবে এর পাশাপাশি সাইবার নিরাপত্তা নিশ্চিত করাও জরুরি, যাতে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মগুলো নিরাপদ থাকে।
দুর্নীতি দমনে নাগরিকদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। অভিযোগ দায়েরের প্রক্রিয়াকে সহজ করতে হবে, যাতে যে কেউ দুর্নীতির তথ্য সহজে জানাতে পারেন। এছাড়া, অভিযোগকারীদের সুরক্ষা নিশ্চিত করাও গুরুত্বপূর্ণ, যাতে তারা কোনো ধরনের হুমকির মুখোমুখি না হন।
শিক্ষা ব্যবস্থায় নৈতিক শিক্ষা অন্তর্ভুক্ত করা উচিত, যাতে ছোটবেলা থেকেই সৎ ও নৈতিক মূল্যবোধসম্পন্ন নাগরিক গড়ে ওঠে। শিক্ষার্থীদের মধ্যে দেশপ্রেম ও সামাজিক দায়বদ্ধতা জাগ্রত করতে হবে।
দুর্নীতির কারণে আমাদের সামাজিক মূল্যবোধও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। সমাজে সৎ মানুষরা অবমূল্যায়িত হচ্ছেন, যা একটি সুস্থ সমাজের জন্য ক্ষতিকর। তাই সমাজে সৎ ও নৈতিক ব্যক্তিদের মূল্যায়ন বাড়াতে হবে।
সরকারি কর্মচারীদের বেতন-ভাতাও পর্যালোচনা করা যেতে পারে। অনেক সময় কম বেতনের কারণে কিছু কর্মচারী দুর্নীতির পথে পা বাড়ান। সঠিক বেতন-ভাতা নিশ্চিত করলে তারা সৎভাবে জীবনযাপন করতে পারবেন।
দুর্নীতি দমনে আন্তর্জাতিক সহযোগিতাও জরুরি। অর্থপাচার রোধে বিভিন্ন দেশের সঙ্গে তথ্য আদান-প্রদান ও সহযোগিতা বাড়াতে হবে। এতে করে দেশের বাইরে পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনা সহজ হবে।
শেষ পর্যন্ত, দুর্নীতি দমন একটি সমন্বিত প্রচেষ্টা। সরকার, সিভিল সোসাইটি, গণমাধ্যম, সাধারণ নাগরিক—সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায়ই আমরা দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশ গড়ে তুলতে পারি। এটি শুধু সরকারের দায়িত্ব নয়, বরং আমাদের সবার দায়িত্ব।
দুর্নীতির লাগাম টেনে ধরতে হলে এখনই সময়। যদি আমরা এখনই পদক্ষেপ না নিই, তাহলে ভবিষ্যতে এর পরিণতি আরও ভয়াবহ হতে পারে। তাই আসুন, আমরা সবাই মিলে দুর্নীতির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াই এবং একটি সৎ, নৈতিক ও উন্নত বাংলাদেশ গড়ে তুলি।
লেখক : ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক, একুশে পত্রিকা।