রাষ্ট্র সংস্কার প্রস্তাব নিয়ে আসছে বিএনপি, জনঅংশগ্রহণের ওপর জোর

বিএনপি লোগো
ঢাকা : বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) রাষ্ট্রের কাঠামো পুনর্গঠন এবং আধুনিকায়নের লক্ষ্যে নতুন করে সংস্কার প্রস্তাব ঘোষণা করতে যাচ্ছে। ২০২৩ সালের জুলাই মাসে বিএনপি ৩১ দফা রাষ্ট্র সংস্কারের প্রস্তাব দিয়েছিল, যার ওপর ভিত্তি করে এখন তৃণমূল ও নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে মতবিনিময় চলছে।

দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান এই প্রস্তাবগুলোর ওপর গুরুত্ব দিয়ে প্রতিদিনই মাঠপর্যায়ের নেতাকর্মী থেকে শুরু করে কেন্দ্রীয় নেতাদের সঙ্গে মতবিনিময় করছেন।

তিনি বিশ্বাস করেন, রাষ্ট্রের প্রকৃত মালিক জনগণ এবং তাই জনগণের মতামত ও অংশগ্রহণের ভিত্তিতেই সব কার্যক্রম পরিচালনা করতে হবে।

দলীয় মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর অস্ট্রেলিয়া থেকে দেশে ফিরে সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে এই নতুন রাষ্ট্র সংস্কার প্রস্তাব ঘোষণা করবেন।

এই প্রস্তাব সারাদেশে লিফলেট, বুকলেট ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচার করা হবে, যাতে দেশের সব শ্রেণি-পেশার মানুষের কাছে তা পৌঁছে দেওয়া যায়।

এর জন্য চলছে ব্যাপক প্রস্তুতি। সাধারণ মানুষের কাছে প্রস্তাবগুলো তুলে ধরতে মহিলা ও ডিপ্লোম্যাটদের জন্য আলাদা বুকলেটও তৈরি করা হচ্ছে।

তারেক রহমানের নেতৃত্বে বিএনপির হাইকমান্ড ইতোমধ্যে ছয়টি শক্তিশালী কমিটি গঠন করেছে, যারা বিভিন্ন খাতে সংস্কারের জন্য কাজ করছে।

কমিটিগুলো তাদের কার্যক্রম সম্পন্ন করার পর একত্রিত করে পূর্ণাঙ্গ সংস্কার প্রস্তাব তৈরি করা হবে, যা জনসমক্ষে প্রকাশের পাশাপাশি সরকারের অন্তর্বর্তীকালীন প্রধানসহ সংশ্লিষ্ট ছয়টি কমিশনের কাছে উপস্থাপন করা হবে।

নতুন এই প্রস্তাবের মূল লক্ষ্য হলো একটি যুগোপযোগী ও আধুনিক রাষ্ট্র ব্যবস্থা গড়ে তোলা, যেখানে জনগণের মৌলিক অধিকার, বাকস্বাধীনতা এবং শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নয়ন নিশ্চিত করা হবে।

এছাড়াও, দেশে আর কখনো যেন রাজনৈতিক সংঘাত, কর্তৃত্ববাদী শাসন এবং বিচার বিভাগের ওপর হস্তক্ষেপের মতো ঘটনা না ঘটে তা নিশ্চিত করার উদ্দেশ্যেও প্রস্তাবনা সাজানো হয়েছে।

এই সংস্কার প্রস্তাবে বিএনপির আগের ঘোষিত ৩১ দফার সঙ্গে নতুন কিছু প্রস্তাব যুক্ত করে এবং অপ্রয়োজনীয় কিছু অংশ বিয়োজন করে একটি সম্পূর্ণ প্রস্তাবনা আনা হচ্ছে, যা দেশের গণতান্ত্রিক ভবিষ্যতকে নিশ্চিত করার প্রতিশ্রুতি দেয়।

তারেক রহমান এবং বিএনপির হাইকমান্ড মনে করেন, জনগণের অংশগ্রহণের মাধ্যমেই রাষ্ট্রের প্রকৃত মেরামত সম্ভব।

এজন্য তিনি প্রতিনিয়ত মাঠপর্যায় থেকে শুরু করে জেলা, বিভাগ ও কেন্দ্রীয় নেতাদের সঙ্গে মতবিনিময় করছেন এবং দলীয় নেতাদের বিভিন্ন দিকনির্দেশনা প্রদান করছেন, যাতে জনগণকে এই প্রক্রিয়ায় আরও সক্রিয়ভাবে সম্পৃক্ত করা যায়।

এই নতুন রাষ্ট্র সংস্কার প্রস্তাব জনগণের কণ্ঠস্বরকে কেন্দ্র করে গড়ে তোলা হয়েছে, যেখানে প্রতিটি মানুষের মৌলিক অধিকার রক্ষার বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করা হয়েছে।

সংস্কারের প্রস্তাবের মূল বিষয়বস্তু

প্রস্তাবিত সংস্কারের উল্লেখযোগ্য বিষয়গুলো হলো: প্রতিটি মানুষের মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করা, বাকস্বাধীনতা ও ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠা করা, শিক্ষাব্যবস্থার উন্নয়ন করা এবং শিল্পকে শ্রমঘন করা।

রাজনৈতিক সংঘাত চিরতরে বন্ধ করে একটি স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে নতুন আইনী কাঠামো তৈরি করার কথাও প্রস্তাবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এছাড়া, রাষ্ট্র মেরামতের অন্যান্য বিষয় যেমন প্রশাসনিক কাঠামো, বিচার বিভাগ ও পুলিশ বিভাগের সংস্কারও এতে অন্তর্ভুক্ত থাকবে।

এই প্রস্তাবের প্রধান উদ্দেশ্য হলো রাষ্ট্রের ক্ষমতা কাঠামোর ভারসাম্য তৈরি করা এবং সংবিধানের মধ্যে কোনো ধরনের কর্তৃত্ববাদী নিয়ন্ত্রণ কিংবা হস্তক্ষেপ না থাকার বিষয়টি নিশ্চিত করা।

সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ সংশোধনের প্রস্তাব, নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনঃপ্রবর্তন এবং বিচার ব্যবস্থার জন্য সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল পুনঃপ্রবর্তনসহ আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ আইনী পরিবর্তন আনার পরিকল্পনাও এই সংস্কার প্রস্তাবে অন্তর্ভুক্ত।

রাষ্ট্র সংস্কার : ছয়টি কমিটি গঠন ও কার্যক্রম

বিএনপি এই সংস্কার প্রস্তাবকে বাস্তবায়নের লক্ষ্যে ছয়টি শক্তিশালী কমিটি গঠন করেছে, যারা বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ খাত নিয়ে কাজ করছে। সংবিধান পুনর্গঠন কমিটির আহ্বায়ক করা হয়েছে ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেনকে, যার অধীনে আরও কয়েকজন বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব সংবিধান সংশোধন নিয়ে কাজ করছেন।

বিচার বিভাগ সংস্কার কমিটির নেতৃত্বে রয়েছেন ব্যারিস্টার জমির উদ্দিন সরকার, যিনি বিচার ব্যবস্থায় পরিবর্তনের জন্য সুস্পষ্ট পরিকল্পনা তৈরি করছেন।

পুলিশের কাঠামো সংস্কারের জন্য গঠন করা হয়েছে আলাদা কমিটি, যার নেতৃত্বে রয়েছেন মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহমেদ বীরবিক্রম।

এছাড়া প্রশাসন, দুর্নীতি দমন কমিশন এবং নির্বাচন কমিশন নিয়েও আলাদা কমিটি কাজ করছে, যারা সংশ্লিষ্ট খাতে প্রয়োজনীয় সংস্কারের পরিকল্পনা তৈরি করছে।

এই ছয়টি কমিটি তাদের কার্যক্রম শেষ করার পর বিএনপি একটি পূর্ণাঙ্গ সংস্কার প্রস্তাব তৈরি করবে, যা জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে এবং অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে উপস্থাপন করা হবে।

৩১ দফা প্রস্তাবনা: রাষ্ট্র মেরামতের রূপরেখা

বিএনপির আগে ঘোষিত ৩১ দফা প্রস্তাবের মধ্যে উল্লেখযোগ্য বিষয়গুলো হলো: সংবিধান সংস্কার কমিশন গঠন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনঃপ্রবর্তন, বিচার বিভাগ ও প্রশাসনের ক্ষমতার ভারসাম্য তৈরি, প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালনের সময়সীমা নির্ধারণ, উচ্চকক্ষের প্রবর্তন এবং নির্বাচন ব্যবস্থার স্বচ্ছতা ও নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করা।

এছাড়াও, দুর্নীতির বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ, গণমুখী প্রশাসন গঠন, কৃষি ও শিল্প খাতে আধুনিকায়ন এবং শিক্ষাব্যবস্থা উন্নয়নের মতো বিষয়গুলো এই প্রস্তাবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।

বিএনপি আশা করে যে, এই প্রস্তাবনার মাধ্যমে একটি সুষ্ঠু ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হবে, যেখানে জনগণের অধিকার সুরক্ষিত থাকবে এবং রাজনৈতিক সংঘাতের পথ চিরতরে বন্ধ হবে।