বৃক্ষ…


মোঃ আবদুল মান্নান : গত এক দশক যাবৎ বর্ষাকাল আসলেই মনের ভেতরে বৃক্ষরোপণের একটি অদৃশ্য তাগিদ অনুভব করি। অজান্তেই গাছের চারা সংগ্রহের লক্ষ্যে খোঁজ নিতে থাকি। ঢাকায় থাকার কারণে এ বছর চারা দেখার উদ্দেশ্যে আগারগাঁও, ফার্মগেইট, মুহাম্মদপুর, আসাদ গেইট সংলগ্ন সরকারি দপ্তরেও হানা দিয়েছি। একদিন পছন্দমত কিছু চারা ক্রয় করে গাড়ির পেছনে তুলে নিয়ে গ্রামের বাড়ির খালি জায়গায় রোপণ করে দেই। রোপণের সময় বেশ আনন্দবোধ করি। মনে হয় অপরের জন্য কিছু একটা করেছি। গাছগুলো চোখের সামনেই শাখা-প্রশাখা মেলে ক্রমবিস্তার লাভ করছে। সবুজ পাতায় পাতায় অক্সিজেন-ভর্তি পাত্র হাতে জীবনের প্রয়োজনে দাঁড়িয়ে আছে রিরামহীন। দেখে আনন্দিত না হওয়ার কোনো কারণ নেই।

বলা বাহুল্য, বৃক্ষ মানুষের জীবন ও জীবিকার অবলম্বন। পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার্থে এবং মানুষের মৌলিক চাহিদা পূরণে বৃক্ষের অবদান অতুলনীয়। বৃক্ষ কারো জন্য জীবিকা, আবার কারো জন্য জীবন। মানে, দু’ভাবেই বলা যায়। যেমন, বড় লোকের জীবনের জন্য গাছ কাজ করছে, গরীব মানুষের ক্ষেত্রে জীবন এবং জীবিকা উভয়ই। জীব-বৈচিত্র্য, পরিবেশ, জলবায়ু, ভূ-প্রকৃতি, উদ্ভিদ, বন্যপ্রাণী, দুর্যোগ, খরা, বৃষ্টি ইত্যাদি নানা বিষয়ের সাথে বৃক্ষের সম্পর্ক সরাসরি। যেন একে অপরের ছায়াসঙ্গী।

আমাদের দেশের মোট আয়তনের প্রায় ১৭.৬২% বনভূমি। প্রয়োজনের তুলনায় নিশ্চয় খুব অপ্রতুল। তবে একথা স্বীকার করতেই হবে বিগত এক দশকে সরকারি এবং ব্যক্তি উদ্যোগে বৃক্ষরোপণ একটি সামাজিক বিপ্লবে পরিণত হয়েছে। মানুষ অবলীলায় গাছ কাটে যেমন সত্য, রোপণ করে তাও সত্য। বিভিন্ন দেশী-বিদেশী গণমাধ্যম, সরকারি বেসরকারি প্রচারাভিযান, প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক পুরস্কার ঘোষণা, বন ও কৃষি বিভাগের নিরন্তর প্রচেষ্টা ইত্যাদি কারণে দেশব্যাপী বনায়ন সম্প্রসারিত হয়েছে।

আমাদের সবই কী মন্দ বা সমালোচনার? নিশ্চয় না। সাধারণ মানুষের মধ্যে সচেতনতা জাগরিত হয়েছে। মানুষ এখন ভাল-মন্দের পার্থক্য করতে শিখেছে। তা কম কী? আমরা সাধারণ মানুষের মধ্যে নিত্য বিকশিত এ ইতিবাচক পরিবর্তনের প্রশংসা করতে পারি।
বলা হয়, পৃথিবীর ৭০০ কোটি মানুষের খাদ্য ওষুধ, বস্ত্র, ঘরবাড়ি তৈরিসহ যাবতীয় কাজে বৃক্ষ আবদান রেখে থাকে। পৃথিবীতে বনভূমির পরিমাণ ৩১ শতাংশ। প্রায় ১.৬ বিলিয়ন মানুষ জীবিকার জন্য বনের উপর নির্ভরশীল। ৩০০ মিলিয়নের বেশি মানুষ বনেই বসবাস করে। বনের গুরুত্ব বা বৃক্ষের প্রয়োজনীয়তা বিষয়ে পৃথিবীতে প্রতিদিন হাজারো গবেষণা, জরিপ, সভা, সেমিনার চালু আছে। যতদিন পৃথিবী থাকবে ততদিনই তা চলবে। কারণ বৃক্ষের গুরুত্ব কখনোই হ্রাস পাবে না, বরং জীবজগতের চির আশ্রয় হয়ে থাকবে।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর-এর কাছে ফিরে যাই। তিনি ১৯৩৯ সালে শান্তি নিকেতনে বৃক্ষরোপণ-উৎসব উদ্বোধনকালে যা বলেন, “তিনি প্রথম বৃক্ষ হয়েই জন্মেছিলেন। বৃক্ষরোপণ নবজীবনের প্রতীক। বৃক্ষদের জন্ম শ্রেষ্ঠ। সকল জীব এদের অবলম্বন করে জীবিত থাকে। যাচকেরা এর নিকট থেকে নিরাশ হয়ে ফিরে যায় না। পত্র, পুষ্প, ফল, ছায়া, ফুল, বল্কল, কাষ্ঠ, গন্ধ, রস, ক্ষার, সার, অঙ্কুর এই সকলের দ্বারা লোকের কাম্য বস্তু দান করে। সংসারে সকল সম্পদের হেতু ভূমিলক্ষীর কেতুস্বরূপ ও জীবগণের জীবনৌষধাস্বরূপ এই তরুগণ অক্ষত হয়ে বেঁচে থাকুক।”

বলুন, আর উপায় কী? কাজেই আসুন, বার্ধক্যে উপনীত হওয়ার পূর্বে বা একেবারে অক্ষমতার কাছাকাছি সময়ে এসেও বৃক্ষরোপণ করি। নিজের জায়গা জমি না থাকলেও সূর্যালোক বর্ষিত হয় এমন কোনো শূণ্য স্থানে একটি বৃক্ষরোপণ করি।