ঢাকা : জুলাই-আগস্টের রাজনৈতিক অভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট ক্ষমতাচ্যুত হয় আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার। সরকার পতনের পর থেকে গতকাল পর্যন্ত এমপি-মন্ত্রী, আমলা, ব্যবসায়ী, ব্যাংকারসহ শতাধিক ব্যক্তির দেশত্যাগে আদালতের নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে।
তবে খোঁজা নিয়ে জানা গেছে, এই তালিকায় অনেকেই ইতিমধ্যে নিষেধাজ্ঞা জারি হওয়ার আগেই দেশের বাইরে চলে গেছেন, যার ফলে নিষেধাজ্ঞাগুলো ‘অকার্যকর’ হয়ে পড়েছে।
বর্তমানে ভারতে অবস্থান করছেন ক্ষমতাচ্যুত সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল। সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী যুক্তরাজ্যে অবস্থান করছেন। এস আলম গ্রুপের প্রধান সাইফুল আলম এবং তার পরিবার সিঙ্গাপুরে চলে গেছেন। মূলত সরকার পতনের সঙ্গে সঙ্গেই তারা দেশ ত্যাগ করেছেন।
গতকাল এস আলম গ্রুপের প্রধান সাইফুল আলম, তার স্ত্রী ফারজানা পারভীনসহ পরিবারের ১৩ সদস্যের বিরুদ্ধে ঢাকার একটি আদালত দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা জারি করে। একই দিনে সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী ও তার স্ত্রী রুকমীলা জামানের উপরও নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে।
দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে পদ্মা ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান চৌধুরী নাফিজ সরাফাতের দেশত্যাগেও নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। এছাড়াও, ১ সেপ্টেম্বর সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান ও তার স্ত্রীসহ ১০ জনের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে।
নাফিজ সরাফাতের বিরুদ্ধে দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা জারি হলেও তিনি দেশে আছেন কিনা নিশ্চিত নয়, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। দুদকের দুজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, একটি জাতীয় পত্রিকায় নাফিজ সরাফাতের বিজ্ঞাপন দেখেই নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে, যদিও তিনি দেশে উপস্থিত কিনা নিশ্চিত নয়।
মানবাধিকার বিষয়ক সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মনজিল মোরসেদ বলেন, “সরকার যাদের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা জারি করছে তাদের নথি সরকারের কাছে নেই। এইভাবে তালিকা তৈরি করে নিষেধাজ্ঞা জারি করা অকার্যকর এবং তামাশার মতো।” তিনি আরও বলেন, “সরকারের কাছে সুনির্দিষ্ট তথ্য না থাকলে এ ধরনের নিষেধাজ্ঞা অকার্যকর।”
অবৈধ দেশত্যাগ ও সীমান্ত অতিক্রম
আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তথ্যে, ৫ আগস্ট সরকারের পতনের পর অনেকেই অবৈধভাবে সীমান্ত অতিক্রম করার চেষ্টা করেছেন। সিলেটের কানাইঘাট, সনাতনপুঞ্জি ও ডোনা, কুমিল্লা, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া, হবিগঞ্জ, ময়মনসিংহের হালুয়াঘাট, নেত্রকোনা, দিনাজপুরের হিলি, যশোরের বেনাপোল ও পুটখালী ঘাট, পঞ্চগড়ের বাংলাবান্ধা ও লালমনিরহাটের দহগ্রাম সীমান্ত ব্যবহার করে বিদেশে পাড়ি জমিয়েছেন অনেকেই। সীমান্ত পার হওয়ার পর কলকাতা, আগরতলা, ত্রিপুরা, দিল্লি, আসাম ও মেঘালয় রাজ্যে অবস্থান করছেন বেশিরভাগ ক্ষমতাচ্যুত ব্যক্তিরা।
ভারতে আশ্রয় নেয়া ব্যক্তিদের মধ্যে বেশিরভাগেই কলকাতার নিউটাউন ও সল্টলেক উপশহরে অবস্থান করছেন। এছাড়াও, সাবেক শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান নওফেল ও আওয়ামী লীগের দপ্তর সম্পাদক ব্যারিস্টার বিপ্লব বড়ুয়াও নিউটাউন ও সল্টলেক এলাকায় রয়েছেন। এদের মধ্যে বাগেরহাট-১ আসনের সাবেক সদস্য শেখ হেলাল উদ্দিন ও বাগেরহাট-২ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য শেখ সারহান নাসের তন্ময়ও আছেন।
দুদক কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, দেশ ছাড়ার পর কেউ গেলে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হলেও, কেউ একাধিক পাসপোর্ট ব্যবহার করেন বা ইমিগ্রেশন ব্যবহার না করে সীমান্ত পার হয়ে চলে যান, যা বন্ধ করা কঠিন। তাদের লক্ষ্য হলো কেউই যেন অবৈধভাবে দেশত্যাগ করতে না পারে।
দুদকের মতে, কমিশন অনুমোদন দিলেই আরও নামের তালিকা আদালতে পাঠানো হবে এবং আদালতের আদেশ দেশের সব স্থল ও বিমানবন্দরে পাঠানো হবে।
একটি গোয়েন্দা সংস্থার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, “দালাল চক্রের মাধ্যমে কেউ দেশের বাইরে গেলে সেই তথ্য ইমিগ্রেশনের কাছে থাকে না। এভাবে পালাতে গিয়ে একজন বিচারকও তো ধরা পড়েছিলেন।”