নজরুল কবির দীপু : পুলিশ বাহিনী একটি রাষ্ট্রের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ও অপরিহার্য প্রতিষ্ঠান। প্রতিটি সভ্য ও গণতান্ত্রিক দেশে জননিরাপত্তা এবং আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার ক্ষেত্রে পুলিশ বাহিনীর ভূমিকাকে অত্যন্ত গুরুত্ব দেওয়া হয়। কিন্তু বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে পুলিশ বাহিনীর সদস্যরা প্রায়ই চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হন, যা অন্য কোনো চাকরিতে খুব কমই দেখা যায়। পুলিশকে প্রতিনিয়ত কেবল জনগণের সেবা নয়, বরং তাদের সঙ্গে লড়াইও করতে হয়, বিশেষ করে যখন তাদের ভূমিকা নিরপেক্ষভাবে পালন করা কঠিন হয়ে পড়ে।
বাংলাদেশে পুলিশের চাকরি, বিশেষত মাঠপর্যায়ে কর্মরত সদস্যদের জন্য, সবচেয়ে কঠিন এবং বিব্রতকর পেশাগুলোর একটি। এই কঠিন বাস্তবতা ব্রিটিশ আমল থেকেই চলে আসছে। ব্রিটিশ উপনিবেশিক শাসনামলে পুলিশ বাহিনীকে শাসকশ্রেণীর হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হতো, যা জনগণের সঙ্গে তাদের দূরত্ব বাড়িয়ে দিয়েছিল। এই ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় বর্তমানেও পুলিশকে প্রায়শই জনগণের মুখোমুখি হতে হয় এবং প্রভাবশালী মহলের নির্দেশে কাজ করতে হয়, যা তাদের মূল দায়িত্ব থেকে বিচ্যুত করে।
সাধারণ মানুষের মধ্যে পুলিশকে নিয়ে যে শত্রুভাবাপন্ন মনোভাব রয়েছে, তা নানা কারণে সৃষ্টি হয়েছে। অনেকেই পুলিশকে নির্যাতনকারী বা ক্ষমতাসীনদের হাতিয়ার হিসেবে দেখে, বিশেষত যখন তারা রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে অন্যায় কাজ করে বা কোনো বৈধ নির্দেশনা পালনে ব্যর্থ হয়। কিন্তু পুলিশের ভূমিকা সম্পর্কে আরও গভীরে গেলে দেখা যায়, তারা প্রায়ই এমন একটি অবস্থায় পড়ে যেখানে দু’পক্ষই তাদের শত্রু হিসেবে বিবেচনা করে।
যেমনটা দার্শনিক টমাস হবস বলেছিলেন, ‘মানুষের অবস্থা হচ্ছে প্রতিটি মানুষ প্রতিটি মানুষের বিরুদ্ধে প্রতিনিয়ত যুদ্ধে লিপ্ত’। বাংলাদেশে পুলিশের অবস্থা প্রায় এ রকমই। যখন তারা দু’পক্ষের বিরোধ থামাতে চেষ্টা করে, তখন উল্টো তারা নিজেই সেই বিরোধের শিকার হয়ে পড়ে। এ ধরনের পরিস্থিতি পুলিশ বাহিনীর জন্য এক ভয়াবহ চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি করে।
জনগণের এই নেতিবাচক মনোভাবের পেছনে অনেক কারণ থাকতে পারে। পুলিশের প্রধান কাজ ‘দুষ্টের দমন, শিষ্টের পালন’ হলেও, বাস্তব জীবনে অনেক ক্ষেত্রেই তারা এর ব্যত্যয় ঘটায়। এতে সাধারণ মানুষের মধ্যে পুলিশের প্রতি আস্থা হারায় এবং পুলিশকে শত্রুভাবাপন্ন হিসেবে দেখতে শুরু করে। পুলিশ যদি তাদের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন না করে এবং নিরপেক্ষ না থাকে, তবে জনগণের মধ্যে অসন্তোষ সৃষ্টি হওয়া স্বাভাবিক। কিন্তু এই ব্যত্যয়ের পেছনে কেবল পুলিশ নয়, সমগ্র সমাজ এবং বিশেষত রাজনৈতিক নেতাদের দায় রয়েছে।
বাংলাদেশে রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে পুলিশ প্রায়ই বিব্রতকর অবস্থায় পড়ে। পুলিশকে অনেক সময় ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের বৈধ বা অবৈধ নির্দেশ পালন করতে হয়, এবং এর ফলে তারা অনেক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়। একদিকে জনগণের সঙ্গে লড়াই, অন্যদিকে ঊর্ধ্বতনদের চাপ—এই দুইয়ের মধ্যে পুলিশ ভারসাম্য রক্ষা করতে গিয়ে তাদের মূল দায়িত্ব থেকে দূরে সরে যায়।
প্রশ্ন হলো, একজন সাধারণ পুলিশ সদস্য কি সব সময় যাচাই করতে পারেন কোনটা বৈধ আর কোনটা অবৈধ নির্দেশ? বাস্তবে, এটা প্রায়ই অসম্ভব হয়ে পড়ে। যে কোনো রাষ্ট্রে পুলিশ বাহিনীর উপর রাজনৈতিক চাপ থাকে। রাজনৈতিক নেতারা তাদের ক্ষমতা প্রদর্শনের জন্য এবং নিজেদের অবস্থান ধরে রাখার জন্য পুলিশকে ব্যবহার করেন। এতে পুলিশের ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ হয়। এর ফলে, পুলিশ কেবল জনগণের শত্রু হিসেবে পরিচিত হয় না, বরং তাদের নিজেদের কাজের প্রতি আস্থাও কমে যায়।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে, রাজনৈতিক প্রভাব পুলিশের কার্যক্রমকে অনেক বেশি প্রভাবিত করে। বিশেষত যখন সরকার ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য পুলিশকে ব্যবহার করে। অতীতেও দেখা গেছে যে, বিভিন্ন সরকার তাদের ক্ষমতা ধরে রাখার জন্য পুলিশকে বিভিন্নভাবে ব্যবহার করেছে। তবে বিগত সাড়ে পনের বছরে আওয়ামী লীগ সরকার অতীতের সব রেকর্ড ভেঙে ফেলেছে।
পুলিশকে দলীয় বাহিনীতে রূপান্তরিত করার অভিযোগ নতুন নয়। সরকারের বিরোধীদের ওপর নিপীড়ন ও নির্যাতনের জন্য পুলিশকে ব্যবহার করা হয়েছে এবং যারা এতে সবচেয়ে বেশি সম্পৃক্ত ছিল, তাদের পদোন্নতি এবং অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হয়েছে।
পুলিশের হাতে অনেক ক্ষমতা রয়েছে। তারা জনগণের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত। কিন্তু সেই ক্ষমতা ব্যবহারে যদি বৈধতার অভাব থাকে, তবে তা সমাজের জন্য বিপজ্জনক হয়ে দাঁড়ায়। গণতান্ত্রিক দেশে পুলিশের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ তারা সরাসরি জনগণের সঙ্গে কাজ করে এবং জনগণের বেপরোয়া অংশের বিরুদ্ধে তাদের ক্ষমতা প্রয়োগ করার জন্য আইনগতভাবে দায়িত্বপ্রাপ্ত। এ কারণে পুলিশের ক্ষমতা সামরিক বাহিনীর চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
কিন্তু পুলিশের এই ক্ষমতা যদি দায়িত্বের সঙ্গে ব্যবহার না করা হয়, তবে তা বিপজ্জনক হয়ে ওঠে। অতীতে আমরা দেখেছি, পুলিশ তাদের ক্ষমতার অপব্যবহার করেছে এবং বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড সংঘটিত করেছে, যা কোনো গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের জন্য গ্রহণযোগ্য নয়। পুলিশের এই ক্ষমতার অপব্যবহারের ফলে জনসাধারণের মধ্যে তাদের প্রতি আস্থা কমে যায়।
বর্তমান পরিস্থিতিতে পুলিশের প্রতি জনসাধারণের আস্থা পুনরুদ্ধার করতে হলে পুলিশ বাহিনীর সংস্কার অত্যন্ত জরুরি। সরকার ইতোমধ্যে একজন সাবেক সচিবকে প্রধান করে একটি কমিশন গঠন করেছে, যার লক্ষ্য পুলিশের সংস্কার প্রস্তাব তৈরি করা।
তবে এই সংস্কার কতদিনে বাস্তবায়িত হবে এবং তা কতটা কার্যকর হবে, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। তবুও, পুলিশের মনোবল ফিরিয়ে আনতে এবং তাদের দায়িত্ব পালনে সঠিকভাবে উদ্বুদ্ধ করতে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন।
যেসব পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ রয়েছে, তাদের বিরুদ্ধে দ্রুত তদন্তসাপেক্ষে ব্যবস্থা নিতে হবে। হতে পারে বাধ্যতামূলক অবসর বা চাকরি থেকে বরখাস্ত করা, যা ইতোমধ্যে কিছু কর্মকর্তার ক্ষেত্রে করা হয়েছে। অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িত কোনো পুলিশ সদস্যকে দায়িত্বে রাখা উচিত নয়। একইভাবে, জনপ্রশাসনের অন্যান্য ক্ষেত্রেও যেসব সদস্য দুর্নীতিতে জড়িত, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। যেমন বলা হয়, ‘দুষ্টু গরুর চেয়ে শূন্য গোয়াল ভালো’।
প্রতিটি থানা ও জেলায় পুলিশকে নাগরিকদের সঙ্গে সম্পৃক্ত করতে হবে। প্রতিটি এলাকায় সমাজের সজ্জন ব্যক্তিদের নিয়ে নাগরিক কমিটি গঠন করা যেতে পারে। এসব কমিটির সদস্যরা ফৌজদারি অপরাধ থেকে মুক্ত থাকতে হবে এবং সমাজের বিভিন্ন পেশার সচেতন ব্যক্তিদের অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। এই কমিটির মাধ্যমে পুলিশকে উদ্বুদ্ধ করা যাবে এবং জনগণের সঙ্গে পুলিশ বাহিনীর সম্পর্ক উন্নত হবে।
ইতোমধ্যে যা হওয়ার হয়েছে। অতীতের ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে পুলিশ বাহিনীকে আরও বেশি করে জনসম্পৃক্ত হওয়ার জন্য এগিয়ে আসতে হবে। জনগণের বিশ্বাস অর্জন করতে হলে পুলিশকে আরও দায়িত্বশীল হতে হবে এবং তাদের কার্যক্রমে স্বচ্ছতা আনতে হবে। পুলিশের অতীত ভুলগুলো স্বীকার করতে হবে এবং ভবিষ্যতে এসব ভুল থেকে নিজেকে মুক্ত রাখতে হবে।
পুলিশ বাহিনীতে কনস্টেবল ও অন্যান্য নিম্নপদস্থ সদস্যদের অবস্থা অনেক খারাপ। তাদের থাকার পরিবেশ, খাবারের মান এবং পোশাকের মান অত্যন্ত নিম্নমানের। এই দুর্দশা দূর করার জন্য দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি। পাশাপাশি তাদের যেসব সমস্যা সমাধান করতে দীর্ঘ সময় লাগবে, সেগুলো নিয়ে তাদের সঙ্গে আলোচনা করে আস্থা তৈরি করতে হবে।
পুলিশ বাহিনীতে দ্রুত নিয়োগ দিতে হবে এবং তাদের আধুনিক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। আধুনিক প্রশিক্ষণ তাদের দক্ষতা উন্নত করবে এবং পুলিশ বাহিনীর সামগ্রিক কার্যকারিতা বাড়াবে। পুরনো সদস্যদেরও আধুনিক প্রশিক্ষণের আওতায় আনতে হবে। প্রশিক্ষণের মানোন্নয়ন নিশ্চিত করতে হবে এবং যদি কোনো প্রশিক্ষণার্থী প্রশিক্ষণে উত্তীর্ণ না হয়, তবে সেই ব্যর্থতার জন্য প্রশিক্ষণার্থীর পরিবর্তে প্রশিক্ষকবৃন্দকে দায়ী করতে হবে।
পুলিশকে অহেতুক বিরক্ত করা বা তাদের কাজে বাধা দেওয়া থেকে সবাইকে নিবৃত্ত করতে হবে। সকলকে আইন মানার প্রতি উদ্বুদ্ধ করতে হবে। এজন্য বিচার বিভাগের সহযোগিতায় মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করা যেতে পারে, যাতে জনবিরক্তিকর কর্মকাণ্ড যেমন ট্রাফিক আইন ভঙ্গ, ময়লা-আবর্জনা ফেলা ইত্যাদি থেকে জনগণ বিরত থাকে। আইনের সঠিক প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হলে জনগণকে আইন মানতে বাধ্য করতে হবে এবং এর জন্য ধৈর্য সহকারে কাজ করতে হবে।
পুলিশ একটি রাষ্ট্রের অপরিহার্য প্রতিষ্ঠান এবং তাদের কার্যক্রমের ওপর সমাজের স্থিতিশীলতা নির্ভর করে। কিন্তু বাংলাদেশে পুলিশের দায়িত্ব পালনে বিভিন্ন ধরনের চ্যালেঞ্জ রয়েছে। জনগণের আস্থা ফিরিয়ে আনার জন্য এবং পুলিশের কার্যক্রমকে জনমুখী করার জন্য দ্রুত সংস্কার এবং আধুনিকায়নের প্রয়োজন।
সরকার ইতোমধ্যে পুলিশের সংস্কারের জন্য উদ্যোগ নিয়েছে, তবে এর বাস্তবায়ন কতটা দ্রুত এবং কার্যকরভাবে করা হবে তা সময়ই বলবে। তবে যত দ্রুতই সংস্কার কার্যকর করা হোক না কেন, পুলিশের মনোবল ফিরিয়ে আনার জন্য দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে। পুলিশ বাহিনীর কার্যকর সংস্কার এবং জনসম্পৃক্ততার মাধ্যমে একটি জনবান্ধব পুলিশ বাহিনী গড়ে তোলা সম্ভব, যা একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের স্বপ্ন বাস্তবায়নের পথে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।
লেখক : ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক, একুশে পত্রিকা।