শনিবার, ২১ ডিসেম্বর ২০২৪, ৭ পৌষ ১৪৩১

টেন্ডার ছাড়াই চট্টগ্রাম বন্দরের ৮ একর ভূমি ইনকনট্রেডকে দেওয়ার রহস্য কী?

টেন্ডার ছাড়াই গোপন সিদ্ধান্তে ইজারার অনিয়মের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা

প্রকাশিতঃ ৪ অক্টোবর ২০২৪ | ৯:০৮ পূর্বাহ্ন


চট্টগ্রাম : চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ টেন্ডার আহ্বান না করে বোর্ড মিটিংয়ের গোপন সিদ্ধান্তের মাধ্যমে ইনকনট্রেড লিমিটেডকে ৮ একর ভূমি ইজারা দিয়েছিল। এই ঘটনা নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা এবং তদন্তের পর অবশেষে ইজারা বাতিল করা হয়েছে।

৪০০ কোটি টাকা মূল্যের এই ইজারায় ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে, যা সরকারকে বড় অংকের রাজস্ব ক্ষতির মুখে ফেলে। এই ঘটনাটি নিয়ে তদন্ত শেষে চট্টগ্রাম বন্দরের নতুন চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল এসএম মনিরুজ্জামান ইজারা বাতিলের কঠোর সিদ্ধান্ত নেন।

তবে, ২০০৫ সালে ইনকনট্রেডকে দেওয়া ২২.৭৭৬ একর ভূমির ইজারা বহাল থাকবে।

চট্টগ্রাম বন্দরের আরও ৮ একর ভূমি যেভাবে ইনকনট্রেডকে ইজারা

২০০৫ সালের ১৩ জুলাই, চট্টগ্রাম বন্দরের মালিকানাধীন ১৩ ও ১৪ নম্বর খালের মধ্যবর্তী ২২.৭৭৬ একর ভূমি ইনকনট্রেড লিমিটেড নামে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে ৩০ বছরের জন্য ইজারা দেওয়া হয়।

চুক্তিতে ইজারার মেয়াদ আরো ২০ বছর বাড়ানোর সুযোগ রাখা হয়। এই ভূমিতে প্রতিষ্ঠানটি আইসিডি (ইনল্যান্ড কন্টেইনার ডিপো) নির্মাণ করে এবং ব্যবসা সম্প্রসারণের পরিকল্পনা নেয়।

২০২৩ সালের ২ জানুয়ারি, ইনকনট্রেড লিমিটেড বন্দর কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন করে তাদের ব্যবসা সম্প্রসারণের জন্য অতিরিক্ত ৮ একর ভূমি ইজারা প্রদানের।

অস্বাভাবিক দ্রুততার সঙ্গে, ৯ এপ্রিল অনুষ্ঠিত চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের বোর্ড মিটিংয়ে এই আবেদন অনুমোদিত হয়। এবং পূর্ব পতেঙ্গা এলাকার ৬ নম্বর খতিয়ানের অন্তর্ভুক্ত বিএস দাগ নম্বর ১১৫ এবং ১২৪ দাগের আওতাভুক্ত ৮ একর জমি প্রতিষ্ঠানটিকে ইজারা দেওয়া হয়।

প্রচলিত নিয়মের লঙ্ঘন ও দুর্নীতির অভিযোগ

বন্দর কর্তৃপক্ষের নিয়ম অনুযায়ী, চট্টগ্রাম বন্দরের ভূ-সম্পত্তি ইজারা দেওয়ার ক্ষেত্রে টেন্ডার আহ্বান করতে হবে। তবে এই ক্ষেত্রে কোনো টেন্ডার ছাড়াই শুধু বোর্ড মিটিংয়ের সিদ্ধান্তে বিশাল পরিমাণের জমি ইজারা দেওয়ার ঘটনা ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ উত্থাপন করে।

অভিযোগ রয়েছে যে, চুক্তি স্বাক্ষরের ক্ষেত্রে কঠোর গোপনীয়তা রক্ষা করা হয়েছে এবং এ নিয়ে সাধারণ জনগণ বা গণমাধ্যমে কোনো তথ্য প্রকাশ করা হয়নি।

এই ধরনের গোপন সিদ্ধান্তে ইজারা না দিয়ে যদি টেন্ডার আহ্বান করা হতো, তাহলে একাধিক প্রতিষ্ঠান অংশগ্রহণের সুযোগ পেতো এবং সরকার সর্বোচ্চ দরদাতা থেকে কয়েকগুণ বেশি অর্থ আয় করতে পারতো।

পাশাপাশি, নিয়ম মেনে ইজারা দিলে সরকারের রাজস্ব আয়ও উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেত। অথচ নিয়ম না মেনে ইজারা দেওয়ায় সরকার বড় অংকের রাজস্ব হারিয়েছে বলে অভিযোগপত্রে উল্লেখ করা হয়েছে।

ইজারা বাতিলের জন্য অভিযোগ ও তদন্ত

ইজারা প্রক্রিয়ায় বিশাল অংকের অর্থ লেনদেন এবং অবৈধ কর্মকাণ্ডের অভিযোগ তুলে এই ইজারা বাতিলের আবেদন জানানো হয় চট্টগ্রাম বন্দরের বর্তমান চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল এসএম মনিরুজ্জামানের কাছে।

অভিযোগপত্রে বলা হয়, বোর্ড মিটিংয়ে নেওয়া এই সিদ্ধান্তের ব্যাপারে সর্বোচ্চ গোপনীয়তা রক্ষা করা হয়েছে, যাতে তা জনসমক্ষে প্রকাশ না পায়।

এছাড়াও, নিয়ম অনুযায়ী চুক্তি স্বাক্ষরের পর ভূমির দখল দ্রুত হস্তান্তর করা হলেও, এই ক্ষেত্রে ৫ মাস পর ভূমির দখল বুঝিয়ে দেওয়া হয়।

এতে অভিযোগ ওঠে, তড়িঘড়ি করে সরকারের পরিবর্তনের পর কাজটি সম্পন্ন করা হয়েছে। এমনকি চুক্তির ৫ মাস পর এস্টেট বিভাগ থেকে ভূমি বুঝিয়ে দেওয়ার পর কাজ করার অনুমতি দেওয়া হয় ইনকনট্রেডকে।

নতুন চেয়ারম্যানের পদক্ষেপ ও ইজারা বাতিল

চট্টগ্রাম বন্দরের নতুন চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল এসএম মনিরুজ্জামান ইজারা সংক্রান্ত এই অভিযোগকে অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে নেন। তদন্ত শেষে তিনি বহুল আলোচিত ৮ একর ভূমির ইজারা বাতিলের সিদ্ধান্ত নেন। এর ফলে বন্দর কর্তৃপক্ষের বিপুল পরিমাণ জমির ইজারা নিয়ে যে অনিয়ম হয়েছিল, তার নিরসন হয়।

তবে, পূর্বে ২০০৫ সালে ইনকনট্রেডকে দেওয়া ২২.৭৭৬ একর জমির ইজারা বহাল থাকবে বলে জানিয়েছেন চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সচিব মোহাম্মদ ওমর ফারুক।

তিনি আরও জানান, এই ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণের ফলে ভবিষ্যতে চট্টগ্রাম বন্দরের ভূমি ইজারা ও ব্যবস্থাপনায় স্বচ্ছতা আসবে এবং সরকারের রাজস্ব ক্ষতির ঝুঁকি কমবে।