নজরুল কবির দীপু : পার্বত্য চট্টগ্রামের খাগড়াছড়ি ও রাঙামাটি জেলায় একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনাকে কেন্দ্র করে পাহাড়ি-বাঙালি সম্প্রদায়ের মধ্যে সংঘর্ষের সূত্রপাত ঘটেছে। এই সংঘর্ষে এখন পর্যন্ত চারজন নিহত এবং অর্ধশতাধিক আহত হয়েছেন। এছাড়াও শতাধিক দোকানপাট, বাড়িঘর এবং গাড়িতে অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে খাগড়াছড়ি জেলা সদর ও রাঙামাটি শহরে ১৪৪ ধারা জারি করা হয়।
এই ঘটনার প্রতিবাদে বান্দরবানে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ করে। অগ্নিসংযোগের প্রতিবাদ এবং দোষী ব্যক্তিদের শাস্তির দাবিতে ‘বিক্ষুব্ধ জুম্ম ছাত্র-জনতা’ ৭২ ঘণ্টার অবরোধের ডাক দিয়েছে। রাঙামাটিতে মালিক সমিতি অনির্দিষ্টকালের পরিবহন ধর্মঘট শুরু করেছে। ফলে শনিবার সকাল ৬টা থেকে খাগড়াছড়ি, রাঙামাটি ও বান্দরবানে সড়ক ও নৌপথ অবরোধের কারণে সাধারণ মানুষ ভোগান্তিতে পড়েছেন।
উদ্ভূত সাংঘর্ষিক পরিস্থিতিতে পাহাড়ের বাসিন্দাদের শান্ত থাকার আহ্বান জানিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। শুক্রবার প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় থেকে পাঠানো বিবৃতিতে তিনি বলেছেন, খাগড়াছড়ি ও রাঙামাটিতে সৃষ্ট সংকট নিরসনে সরকার আন্তরিকভাবে কাজ করছে। গত ১৮ সেপ্টেম্বর গণপিটুনি ও পরবর্তী সময়ে হত্যার ঘটনাকে কেন্দ্র করে হামলা, অগ্নিসংযোগ ও প্রাণহানিতে সরকার গভীরভাবে দুঃখিত ও ব্যথিত।
সরকারের পক্ষ থেকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সব বাহিনীকে সর্বোচ্চ সংযম দেখাতে এবং পার্বত্য জেলাগুলোয় বসবাসকারী জনগণের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। সেখানে শান্তি, সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতি নিশ্চিত করতে সরকার বদ্ধপরিকর।
শনিবার স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার নেতৃত্বে সরকারের উচ্চপর্যায়ের একটি প্রতিনিধিদল দুই পার্বত্য জেলা খাগড়াছড়ি ও রাঙামাটি পরিদর্শনে যান। রাঙামাটিতে বিভিন্ন রাজনৈতিক ব্যক্তিদের সঙ্গে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার মতবিনিময় সভায় সন্তু লারমা নেতৃত্বাধীন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (জেএসএস) রাঙামাটি জেলা শাখার সভাপতি ডা. গঙ্গা মানিক চাকমা দাবি করেন, সংঘাত ও বৈষম্যবিরোধী পাহাড়ি ছাত্র আন্দোলনের নামে ইউপিডিএফ তাদের দেশি-বিদেশি ইন্ধনদাতাদের টাকায় সাধারণ পাহাড়ি ছাত্রদের দিয়ে এই অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি করছে।
সভায় ডা. গঙ্গা মানিক চাকমা বলেন, তাদের (ইউপিডিএফ) এমন কর্মকাণ্ডের জন্য পার্টির (জেএসএস) পক্ষ থেকে তীব্র নিন্দা জানাচ্ছি। তাদের (ইউপিডিএফ) বুঝতে হবে আমরা সবাই পাহাড়ে শান্তিতে থাকতে চাই। পাহাড়ে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠায় পার্বত্য চুক্তির পূর্ণ বাস্তবায়ন ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। স্থানীয় ভোটার তালিকা প্রণয়ন করে জেলা পরিষদসমূহের নির্বাচন, স্থানীয় পুলিশ বাহিনী গঠন করাসহ চুক্তির মৌলিক ধারাগুলো বাস্তবায়ন করা না গেলে পাহাড়ে শান্তি আসব না।
তবে ‘সংঘাত ও বৈষম্যবিরোধী পাহাড়ী ছাত্র আন্দোলন’র সঙ্গে ইউপিডিএফের সমর্থন ও সম্পৃক্ততা নিয়ে করা জনসংহতি সমিতির নেতা ডা. গঙ্গা মানিক চাকমার বক্তব্যকে ‘ডাবল স্ট্যান্ডার্ড বা দ্বিচারিতার রাজনীতি’ বলে মন্তব্য করেছেন ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্টের (ইউপিডিএফ) মুখপাত্র ও সংগঠক অংগ্য মারমা।
তিনি বলেছেন, ইউপিডিএফের রাজনৈতিক অবস্থান সবসময়ই স্পষ্ট। সারা দেশের শিক্ষার্থীদের শেখ হাসিনার ফ্যাসিবাদী সরকারের বিরুদ্ধে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনেও আমাদের প্রকাশ্য সমর্থন ও অবস্থান ছিল। সেই সময়ও জনসংহতি সমিতি নীরব ভূমিকা পালন করেছে, বরং হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদের নেতা হিসেবে আরও অনেকের সঙ্গে জেএসএসের ঊষাতন তালুকদার সরকারের দালালি করে বিবৃতি দিয়েছিলেন, সেটি জনগণ ভুলে যায়নি। তাদের ভুল রাজনীতি, ক্রমশ তাদের মুসলিম লীগের মতো পরিণতির দিকে নিয়ে যাচ্ছে। এটা হয়ত এখনো তারা বুঝতে পারছেন না।
অংগ্য মারমা বলেন, সারা দেশের আন্দোলনের চেতনা ও প্রভাব পাহাড়ি ছাত্র-ছাত্রীদের ওপরও পড়েছে স্বাভাবিকভাবে। তাই তারা ‘সংঘাত ও বৈষম্যবিরোধী পাহাড়ি ছাত্র আন্দোলন’ গড়ে তুলে আমাদের সব দলকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার জন্য ‘এগত্তর’ স্লোগান তুলেছে। তাদের এই স্পিরিটকে আমরা সাধুবাদ জানাই, সমর্থন জানাই। কিন্তু জেএসএস বরাবরের মতই নতুন প্রজন্মের আবেগ-অনুভূতি বুঝতে অক্ষম। তাই তারা এই নির্দলীয় শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে মিথ্যা ট্যাগ দিচ্ছে, এটা দুঃখজনক। এই শিক্ষার্থীরা আমাদের এক হতে বলছে, চুক্তি বাস্তবায়নের দাবি জানাচ্ছে, কই তারা তো ইউপিডিএফের ‘পূর্ণ স্বায়ত্তশাসনের দাবির প্রতি সমর্থন জানাচ্ছে না। তবুও কেন জনসংহতির এত দুশ্চিন্তা, এত ভয়?
তিনি বলেন, ১৯৭১ সালে তৎকালীন নেতৃত্বের অদূরদর্শীতার কারণে পাহাড়িরা ব্যাপকভাবে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে পারেনি। এখনো জাতির এই ক্রান্তিলগ্নে জনসংহতির মতো নির্বাক হয়ে থাকলে ইতিহাস আমাদের ক্ষমা করত না। তাই আমরা বর্তমান সরকারকে সমর্থন জানিয়েছি। সক্রিয়ভাবেই ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনে ছিল ইউপিডিএফ।
অংগ্য মারমা বলেন, খাগড়াছড়িতে মোটরসাইকেল চুরির ঘটনাকে কেন্দ্র করে একজনের মৃত্যু এবং তারপরের ঘটনাপ্রবাহই প্রমাণ করে কারা নেপথ্যে থেকে কী করছেন। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যদি ঠিক সময়ে ঠিক পদক্ষেপ নিতো, তবে ঘটনা এতদূর গড়াতো না।
আমরা জানি, পার্বত্য অঞ্চলে বাঙালি ও পাহাড়িদের মধ্যকার দ্বন্দ্ব নতুন নয়, বরং অতীতে বহু হতাহতের ঘটনা ঘটেছে। একটি স্বাধীন দেশে এ ধরনের সংঘাত অত্যন্ত উদ্বেগজনক। স্থানীয় সংগঠনগুলোর ক্ষমতা দখলের প্রবণতা এবং সীমান্ত সংলগ্ন বিচ্ছিন্নতাবাদীদের তৎপরতা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর জন্য চ্যালেঞ্জের সৃষ্টি করে।
এমন অবস্থায় সেখানে বসবাসরত সাধারণ নাগরিকদের জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পুলিশ ও সেনাবাহিনীর কার্যকর ভূমিকা পালনের বিকল্প নেই। পাশাপাশি নিরাপত্তা ঝুঁকিতে থাকা জায়গাগুলোতে সেনা ক্যাম্প বাড়ানোর প্রয়োজনীয়তাও রয়েছে।
মনে রাখা জরুরি, পূর্ববর্তী সরকারের পতনের পর দেশ পুনরুদ্ধারের পথে এগোচ্ছে, যা নানা ষড়যন্ত্রের মোকাবিলা করেই অর্জন করতে হচ্ছে। সুতরাং যেকোনো সহিংস ঘটনার পেছনে কোনো অপশক্তির প্ররোচনা আছে কিনা তা জাতীয় স্বার্থে খতিয়ে দেখা প্রয়োজন।
আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় সবার অংশগ্রহণ অপরিহার্য। যেকোনো পরিস্থিতিতে আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া এবং বিচার বিভাগের ওপর আস্থা রেখে আইন নিজের হাতে তুলে না নেওয়াই একজন দায়িত্বশীল নাগরিকের কর্তব্য।
পার্বত্য অঞ্চলের সাম্প্রতিক অস্থিরতার জন্য যারাই দায়ী হোক, তাদের সঠিক তদন্তের মাধ্যমে চিহ্নিত করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে অন্তর্বর্তী সরকার কঠোর ব্যবস্থা নেবে, এটাই প্রত্যাশা।
লেখক : ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক, একুশে পত্রিকা।