ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলপথ উন্নয়নের নামে লুটপাট?


একুশে প্রতিবেদক : ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম যাত্রীদের চট্টগ্রাম পৌঁছাতে বৃত্তাকার রেলপথে প্রায় ৬ ঘণ্টা সময় লাগে। এই সময় কমানোর লক্ষ্যে গত ১৫ বছরে প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকার প্রকল্প নেওয়া হয়েছে এবং ১২০ থেকে ১৩০ কিলোমিটার গতিসম্পন্ন ট্রেনও কেনা হয়েছে।

কিন্তু প্রকল্প বাস্তবায়নে কোনো অগ্রগতি হয়নি, বরং দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। এই দুর্নীতির সাথে মন্ত্রী, ডিপিসহ অনেকে জড়িত বলে অভিযোগ রয়েছে। এমনকি একজন রেলপথমন্ত্রী গ্রেফতার হয়েছেন এবং আরও তিন মন্ত্রী পলাতক রয়েছেন। একজন সচিবের নিয়োগ বাতিল করা হয়েছে এবং অন্যান্য সচিবদের দুর্নীতির তদন্ত চলছে।

বিদায়ী সরকারের আমলে টঙ্গী থেকে ভৈরববাজার পর্যন্ত প্রায় সাত হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে ৮২ কিলোমিটার রেলপথ নির্মিত হয়েছিল। মিটারগেজ লাইন হওয়া সত্ত্বেও এটি অন্তত অর্ধশত বছর সচল থাকার কথা ছিল। কিন্তু সাত বছর যেতে না যেতেই লাইনটি ভেঙে ফেলতে হচ্ছে।

বিদায়ী আওয়ামী লীগ সরকারের শেষ সময়ে ওই রুটেই আবার ৩০ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে নতুন প্রকল্পের পরিকল্পনা নেওয়া হয়। লুটপাটের উদ্দেশ্যে এই প্রকল্প নেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। যাত্রীর নিরাপত্তা, পরিবহণ সাশ্রয় এবং ২ ঘণ্টায় ঢাকা-চট্টগ্রাম পৌঁছার ‘কর্ডলাইন’ প্রকল্পটি গত তিন যুগেও গ্রহণ করা হয়নি। রেল বিভাগ থেকে বিভিন্ন সময়ে কর্ডলাইনের প্রস্তাব দেওয়া হলেও মন্ত্রণালয় ও দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী-সচিবরা তা আমলে নেননি।

ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলপথের দৈর্ঘ্য ৩২০ কিলোমিটার। গত ১৬ বছরে আওয়ামী লীগ সরকার এই পথে নতুন রেলপথ নির্মাণ ও দ্রুতগতির ট্রেন চালু করেছে। তবে হিসাব বলছে, সাধারণ কোচ-ইঞ্জিনের তুলনায় প্রায় তিনগুণ বেশি দামে ১২০-১৩০ কিলোমিটার গতির কোচ-ইঞ্জিন ক্রয় করা হয়েছে ২০২৬ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত।

কিন্তু বাস্তবে এই রুটে ট্রেন চলছে গড়ে মাত্র ৫৭ কিলোমিটার গতি নিয়ে। এই ইঞ্জিন-কোচ ক্রয় নিয়ে বড় ধরনের দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে এবং দুদক এ বিষয়ে অনুসন্ধান করছে। এছাড়াও, গত ১৬ বছরে রেলের ছয় মন্ত্রী-সচিব, রেলওয়ের কিছু ডিজি ও প্রকল্প পরিচালকরা সম্পদের পাহাড় গড়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।

রেলওয়ে পরিকল্পনা দপ্তরের সূত্র মতে, বর্তমানে ঢাকা-চট্টগ্রাম রেল যোগাযোগ টঙ্গী-ভৈরব-আখাউড়া হয়ে বৃত্তাকার পথে চলে। এই পথে সিঙ্গেল-ডাবল লাইন নির্মাণ প্রকল্প নিয়ে গত ১৬ বছরে শত শত কোটি টাকা লুটপাটের অভিযোগ রয়েছে। পরিকল্পনা দপ্তর ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, কুমিল্লা, লাকসাম হয়ে কর্ডলাইন নির্মাণের প্রস্তাব বহুবার দিয়েছে।

কর্মকর্তাদের মতে, রেলকে লাভজনক করতে এবং ঢাকা-চট্টগ্রামের মধ্যে মাত্র ২ থেকে সোয়া ২ ঘণ্টায় ট্রেন চলাচল সম্ভব করতে ‘কর্ডলাইন’ নির্মাণ অত্যন্ত জরুরি। এটি বর্তমান ও বিগত যেকোনো প্রকল্পের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। উল্লেখ্য, ১৯৬৮ সাল থেকেই এই রেলপথ নির্মাণের চেষ্টা চলছে।

পরিকল্পনা দপ্তরের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, কর্ডলাইন নির্মিত হলে ঢাকা-চট্টগ্রাম রুটে ২৪ ঘণ্টায় অন্তত ৩৪টি ট্রেন চলাচল সম্ভব হতো। বর্তমানে এই রুটে মাত্র ছয় জোড়া আন্তঃনগর ট্রেন চলাচল করে। কর্ডলাইন নির্মাণ হলে ঢাকা-চট্টগ্রামের দূরত্ব কমে সোয়া ২০০ কিলোমিটার হয়ে যাবে এবং যাতায়াতে সময় লাগবে মাত্র ২ থেকে সোয়া ২ ঘণ্টা।

কিন্তু, বর্তমান ঢাকা-চট্টগ্রাম রুটে পরিকল্পনাহীন এবং সুদূরপ্রসারী চিন্তা-ভাবনাবিহীন প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, টঙ্গী-ভৈরব রুটে প্রায় সাত হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে ৮০ কিলোমিটার সিঙ্গেল মিটারগেজ রেলপথ নির্মাণ করা হয়, যা সাত বছর যেতে না যেতেই ভেঙে ডুয়েলগেজ ডাবল লাইন তৈরির পরিকল্পনা নেওয়া হয়।

মন্ত্রণালয়ের সূত্র জানায়, কর্ডলাইন নির্মাণে সংশ্লিষ্ট রেলের মন্ত্রী-সচিবরা আগ্রহ দেখাননি। কিন্তু তারা ওই পথে দ্রুতগতির বৈদ্যুতিক হাইস্পিড লাইন তৈরিতে উঠেপড়ে লেগেছিলেন। ওই রুটে হাইস্পিড লাইন তৈরির প্রাথমিক সমীক্ষায় ১১০ কোটি টাকা ব্যয় করা হয়। কিন্তু, সম্প্রতি এই প্রকল্পটি বন্ধ রাখার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। ফলে ১১০ কোটি টাকা ব্যয়ে করা সমীক্ষার অর্থ জলে গেছে এবং বরাদ্দ অর্থের বেশির ভাগ টাকা লুটপাট হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে।

কর্ডলাইন নির্মাণের পক্ষে থাকা রেল ও মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা মনে করেন, ১১০ কোটি টাকাসহ, টঙ্গী-ভৈরব, আখাউড়া-লাকসাম প্রকল্প ঘিরে দুর্নীতির যে অভিযোগ রয়েছে তা তদন্তের মাধ্যমে লুটতরাজদের চিহ্নিত করা উচিত।

রেলওয়ে অপারেশন ও পরিবহণ দপ্তর সূত্র জানায়, বর্তমানে ঢাকা-চট্টগ্রাম রুটে ব্রডগেজ ট্রেন চলাচল করে না, শুধুমাত্র পশ্চিমাঞ্চল রেলেই ব্রডগেজ ট্রেন চলে। কর্ডলাইন প্রকল্পের প্রস্তাবনায় ডুয়েলগেজ লাইন নির্মাণের কথা বলা হয়েছিল, যা সম্পন্ন হলে পশ্চিমাঞ্চল থেকে সরাসরি ঢাকা হয়ে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার পর্যন্ত ট্রেন চলাচল সম্ভব হতো।

বর্তমানে ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলপথে ডুয়েলগেজ ডাবল লাইন নির্মাণ করা হচ্ছে, তবে এই লাইনে কবে নাগাদ ব্রডগেজ ট্রেন চলবে সে বিষয়ে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ নিশ্চিত করে কিছু বলতে পারছে না।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, কর্ডলাইন নির্মাণ হলে সর্বোচ্চ যাত্রী পরিবহনের পাশাপাশি আয়ও সর্বাধিক হতো, যা বর্তমান ট্রেন ব্যবস্থায় দুই যুগেও সম্ভব নয়। বর্তমানে চলমান রুটে মাত্র ৩ শতাংশ মালামাল ট্রেনে পরিবহন করা হয়, বাকি ৯৭ শতাংশ সড়কপথে। কর্ডলাইন নির্মিত হলে রেলপথে মালামাল পরিবহন প্রায় ৩৭ শতাংশ বৃদ্ধি পেত এবং চট্টগ্রাম থেকে পশ্চিমাঞ্চলে সরাসরি মালামাল পরিবহন সম্ভব হতো। এর ফলে যাত্রী আয়ের চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ আয় বাড়ত শুধু মালামাল পরিবহণ থেকেই।

রেলওয়ে অপারেশন দপ্তর সূত্র জানায়, বর্তমান ঢাকা-চট্টগ্রাম রুটে একটি ট্রেন একবার থেকে দুবার ট্রিপ দিতে পারে এবং এর জন্য ইঞ্জিন ও কোচ ৬ থেকে ১৩ ঘণ্টা পর্যন্ত অলস অবস্থায় থাকে। কর্ডলাইন নির্মিত হলে প্রতিটি ট্রেন অন্তত ৬ জোড়া বা ১২টি ট্রিপ দিতে সক্ষম হবে, যা বর্তমানের তুলনায় প্রায় ৫ গুণ বেশি। এর ফলে যাত্রী পরিবহন ও আয় বর্তমানের তুলনায় প্রায় ১০ গুণ বৃদ্ধি পাবে এবং সব রোলিং স্টক সবসময় চলমান থাকবে।

গত ১৬ বছরে সমাপ্ত নতুন রেলপথ ও প্রকল্প নিয়ে রেল ভবনে এখনও আলোচনা-সমালোচনা চলছে। প্রায় সোয়া এক লাখ কোটি টাকার প্রকল্পের মধ্যে ৭২ হাজার কোটি টাকা ব্যয় করা হয়েছে নতুন রেলপথ নির্মাণে। তবে নতুন রেলপথ এবং নতুন ইঞ্জিন-কোচে প্রত্যাশিত গতি পাওয়া যাচ্ছে না।

পাবনা-ঢালারচর, কুমিল্লার-লাকসাম-চিনকি আস্তানা, দোহাজারী-কক্সবাজার, আখাউড়া-লাকসাম, খুলনা-মোংলা, আখাউড়া-আগরতলা, পদ্মা রেলসংযোগসহ আরও বেশ কিছু নতুন রেলপথ নির্মাণ করা হয়েছে এবং বেশ কয়েকটি প্রকল্প চলমান রয়েছে। তবে নতুন লাইনেও অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ উঠছে এবং অধিকাংশ প্রকল্পে রাজনৈতিক ও লুটপাটের উদ্দেশ্য থাকায় ট্রেন চলছে নামেমাত্র। ফলে কোটি কোটি টাকার প্রকল্পে সুফল মিলছে না। যাত্রীবান্ধব কর্ডলাইনসহ গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পগুলো গ্রহণ থেকে বিমুখ ছিল সংশ্লিষ্টরা।

রেলপথ মন্ত্রণালয়ের সচিব আবদুল বাকী জানিয়েছেন, নতুন রেলপথ নির্মাণ ও রোলিং স্টক ক্রয়ে অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগের বিষয়ে তারা অবগত এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের কাজ চলছে।

তিনি আরও জানান, ভবিষ্যতে গুরুত্বহীন নতুন রেলপথ ও প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়ন যাতে না হয় সেদিকে তারা সর্বোচ্চ সতর্কাবস্থানে থাকবেন। কোনো রাজনৈতিক বা ব্যক্তিগত স্বার্থে প্রকল্প গ্রহণ বা বাস্তবায়ন করা হবে না বলেও তিনি জোর দিয়ে বলেন।

শুধুমাত্র যাত্রীদের নিরাপত্তা, সাশ্রয় এবং সন্তুষ্টি নিশ্চিত করে এমন প্রকল্পগুলোকেই অগ্রাধিকার দেওয়া হবে। যেসব প্রকল্প থেকে সুফল পাওয়া যাচ্ছে না, সেগুলোর সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের জবাবদিহিতার আওতায় আনা হবে বলেও সচিব জানান।