সোমবার, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ৯ পৌষ ১৪৩১

দাবি-দাওয়ার বন্যায় কি অচল হয়ে পড়বে দেশ?

প্রকাশিতঃ ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪ | ৮:৩৩ পূর্বাহ্ন


নজরুল কবির দীপু : বাংলায় প্রচলিত প্রবাদ “লাগে টাকা দেবে গৌরী সেন” এর উৎপত্তি ধনী ব্যবসায়ী গৌরী সেনের অসীম দানশীলতা থেকে। তিনি অসহায় মানুষদের সাহায্য করতেন, কিন্তু তার এই উদারতার সুযোগ নিয়ে অনেকে অপব্যয় করত। এই অবস্থা চলতে থাকায় প্রবাদটি তৈরি হয় এবং শেষ পর্যন্ত তার পরিবারের পতন ঘটে। অনেকে মনে করেন গৌরী সেন আসলে একজন রূপক চরিত্র যা সমাজের দানশীলতা এবং তার সম্ভাব্য অপব্যবহারের প্রতি ইঙ্গিত করে।

যাই হোক, বর্তমান সময়ে বাংলাদেশে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসও একই ধরনের পরিস্থিতির সম্মুখীন হচ্ছেন, এ কথা অনেকেই বলছেন। দেশের বিভিন্ন স্তরের মানুষের নানা রকম দাবি-দাওয়া মেটাতে গিয়ে তিনি বেশ সমস্যায় পড়েছেন। দেশের পরিবেশ-পরিস্থিতি এবং জাতির উদ্দেশ্য বিষয়ক তার দুটি ভাষণ থেকে এই চিত্র স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থান বা বিপ্লবের ফলে শেখ হাসিনা ৫ আগস্ট পদত্যাগ করে দেশ ত্যাগ করলে দেশে এক সংকটময় পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়।

এই টালমাটাল অবস্থায় ছাত্র-তরুণদের অনুরোধে দেশের হাল ধরতে রাজি হন ড. মুহাম্মদ ইউনূস। কিন্তু, তার নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে প্রথম থেকেই অর্থনৈতিক, রাজনৈতিকসহ নানাবিধ চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হচ্ছে। তবে সবচেয়ে বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে মানুষের নানাবিধ দাবি-দাওয়া। এই দাবি-দাওয়া পূরণ না হওয়ায় জনমনে অসন্তোষ ও সহিংসতা বাড়ছে, যা নানা ধরনের জনদুর্ভোগ সৃষ্টি করছে।

গণঅভ্যুত্থানে ছাত্র ও তরুণ সমাজ মূল ভূমিকা পালন করেছে। কোটা আন্দোলন এবং পরবর্তী গণঅভ্যুত্থানে প্রায় এক হাজার লোক প্রাণ হারিয়েছে, যাদের বেশিরভাগই ছাত্র, চাকরিপ্রত্যাশী, তরুণ ও শিশু-কিশোর। তারা আজ আর বেঁচে নেই, কিন্তু তাদের স্বপ্ন বাস্তবায়নের মাধ্যমে আমাদের তাদের প্রতি ঋণ পরিশোধ করতে হবে।

ছাত্ররা অনির্দিষ্টকালের জন্য রাজপথে থাকতে পারে না, এমনটা আশা করাও ঠিক নয়। তাদের পড়াশোনায় ফিরে যেতে হবে। বর্তমানে শিক্ষার্থীদের পড়াশোনা শেষ করে চাকরির জন্য ‘লাইনঘাট’, ‘সিস্টেম’ আর ‘মামু খালু’র সন্ধানে ছুটতে হয়।

স্বাধীনতার এত বছর পরেও স্বচ্ছ ও প্রশ্নহীন প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে না পারাটা জাতির জন্য অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক। তরুণরা যাতে আস্থা রাখতে পারে, এমন একটি স্বচ্ছ ও নির্ভরযোগ্য ব্যবস্থার প্রয়োজন। যোগ্যতা থাকলে চাকরি হবে, নইলে নয় – এই নীতিই জাতির জন্য কল্যাণকর। এই বিষয়টি নিয়ে কাজ শুরু করা উচিত, এটাই সরকারের প্রধান কাজ।

শুধু নিয়োগ প্রতিষ্ঠান নয়, দেশের প্রায় সব প্রতিষ্ঠানই যেন ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। মানুষের আস্থা ও বিশ্বাস হারিয়ে ফেলেছে এসব প্রতিষ্ঠান। পুলিশ প্রশাসন, বিচার বিভাগ, আর্থিক প্রতিষ্ঠান, নির্বাচন কমিশন সর্বত্র একই চিত্র। বিগত সময়ে দেখা গেছে, কিছু মানুষ দুর্নীতি ও অপকর্মের মাধ্যমে অল্প সময়ের মধ্যেই বিপুল ধন-সম্পদের মালিক হয়েছে, এমনকি অনেকে সেই সম্পদ বিদেশে পাচারও করেছে। এই পরিস্থিতিতে, সবার প্রত্যাশা এই সরকার দেশের সবকিছু স্বাভাবিক করবে, প্রয়োজনীয় সংস্কার সাধন করবে এবং একটি অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে দেশে সুস্থ গণতান্ত্রিক ধারা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করবে।

তবে, এই সরকারের প্রথম দিন থেকেই প্রধান চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে বিভিন্ন মানুষের নানা ধরনের দাবি-দাওয়া। অনেকের দীর্ঘদিনের অপূর্ণ আশা ও বঞ্চনার বেদনা রয়েছে। বিপ্লবের পর তারা আশা করছে হয়তো এবার তাদের প্রত্যাশা পূরণ হবে। কিন্তু যৌক্তিক-অযৌক্তিক, সময়োচিত-অসময়োচিত নানা দাবির চাপে সরকার যেন দিশেহারা না হয়ে পড়ে সেদিকেও নজর রাখতে হবে।

উল্লেখ্য, মুহাম্মদ ইউনূস নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারের শপথ গ্রহণের পর বিভিন্ন সরকারি, আধা-সরকারি এবং বন্যা পরবর্তী সময়ে স্বায়ত্তশাসিত ও আধা-স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান এবং আদালতে চরম অস্থিরতা দেখা দেয়। পদোন্নতি ও সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিতরা একযোগে আন্দোলনে নেমে পড়ে। তাদের দাবি, এখনই সমাধান চাই, আর দেরি নয়। এর ফলে ব্যাপক হারে পদোন্নতি এবং নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।

বিভিন্ন সরকারি প্রকল্পের ও অস্থায়ী কর্মকর্তা-কর্মচারীরাও আন্দোলনে নেমে পড়েছে। তাদের দাবি, তাদের চাকরি জাতীয়করণ ও স্থায়ীকরণ করতে হবে, এখনই স্বাক্ষর করুন, এখনই প্রজ্ঞাপন জারি করুন। এমনকি রাতভর সচিবালয়ে উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের আটকে রাখা এবং হাতাহাতির মতো ঘটনাও ঘটেছে। এসব ক্ষেত্রে মেধার বিষয়টি প্রায়ই উপেক্ষিত হচ্ছে, যা বিপ্লবের মূল চেতনা, বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের পরিপন্থী।

প্রথম ধাক্কাটা আসে পুলিশ বাহিনী থেকে। নিরাপত্তাসহ নানা দাবিতে তারা সবাই একযোগে কর্মবিরতি শুরু করে। পুলিশ বাহিনী ছাড়া দেশ পরিচালনা কতটা কঠিন, তা পুলিশবিহীন কয়েক দিনের অবস্থা থেকে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এই পরিস্থিতির জন্য কিছু অপেশাদার পুলিশ কর্মকর্তা ও সদস্য দায়ী, এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই। যাই হোক, সরকার তাদের বুঝিয়ে এবং কিছু দাবি-দাওয়া মেনে নিয়ে কাজে ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হয়।

এরপর দাবি আদায়ের লড়াইয়ে নামে গ্রাম পুলিশ ও আনসার বাহিনীর সদস্যরা। গ্রাম পুলিশের সদস্যরা এক সময় কাজে ফিরলেও, আনসার বাহিনীর কয়েক হাজার সদস্য জাতীয়করণের দাবিতে অনড় থাকে এবং সহিংস আন্দোলনের পথ বেছে নেয়। তারা রাতভর সচিবালয়ের কর্মকর্তা, কর্মচারী, উপদেষ্টা, ছাত্র প্রতিনিধি ও অন্যান্যদের অবরুদ্ধ করে রাখে। এক পর্যায়ে ছাত্র-জনতা ও পুলিশের সাথে তাদের সংঘর্ষ বাধে। এই ঘটনায় একজন নিহত এবং অসংখ্য লোক আহত হয়।

এক পর্যায়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সেনাবাহিনীকে নামানো হয়। এরপর দেখা যায়, সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কর্মী, বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সংগঠন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা, ধর্মীয় সম্প্রদায়, বিভিন্ন গোষ্ঠী ও পেশার মানুষ নানা দাবি-দাওয়া নিয়ে সচিবালয়, প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন ও শাহবাগে অবস্থান নিতে শুরু করে। এক পর্যায়ে সচিবালয়ের স্বাভাবিক কার্যক্রম মারাত্মকভাবে ব্যাহত হয়। মেট্রোরেল, বিদ্যুৎ বিভাগ ও সচিবালয়ের অভ্যন্তরেও নানা সমস্যা দেখা দেয়।

এই অবস্থায় প্রধান উপদেষ্টা জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দেন। তিনি বলেন, “আমাদের আবাস ও কর্মস্থল ঘেরাও করে আমাদের কাজে বাধা দেবেন না। আপনারা আমাদের প্রতিপক্ষ নন। কারো যদি কোনো দাবি থাকে, তাহলে লিখিতভাবে জানান, আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করব।” এরই পরিপ্রেক্ষিতে, সচিবালয় ও প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন এলাকায় সব ধরনের মিছিল, মিটিং ও সমাবেশ নিষিদ্ধ ঘোষণা করে পুলিশ।

এসব এলাকায় প্রতিবাদ কিছুটা কমলেও, দাবি-দাওয়া নিয়ে দেশের অন্যান্য এলাকা অস্থির হয়ে উঠছে। গাজীপুর, নরসিংদী, সাভারসহ অনেক শিল্পাঞ্চল আক্রান্ত হয়ে পড়েছে। অসন্তোষ ও সহিংসতার কারণে অনেক কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। ঔষধ শিল্প মালিকরা জানিয়েছেন, স্বাধীনতার ৫৩ বছর ধরে তারা নির্বিঘ্নে উৎপাদন করে আসছেন, তাদের শ্রমিকদের কখনো আন্দোলনে যেতে হয়নি। কিন্তু বর্তমানে নানা দাবির কারণে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ায় তাদের অনেক কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে।

বাংলাদেশে বিভিন্ন ধর্ম, গোষ্ঠী ও মতাদর্শের মানুষ বসবাস করে। এই বৈচিত্র্যের মধ্যে, বিভিন্ন জনগোষ্ঠী বিভিন্ন দাবি নিয়ে সরকারের কাছে আসছে। একটি দল সারা দেশ থেকে সুফি মাজার ভেঙে ফেলার দাবি জানিয়েছে এবং তারা কেবল দাবি জানিয়েই ক্ষান্ত হয়নি, সারা দেশে সুফি মাজারগুলোতে হামলা চালিয়ে সহিংসতা করে যাচ্ছে। আবার অন্য একটি দল খেলাফত প্রতিষ্ঠার দাবিতে কর্মসূচি পালন করছে। হিন্দু সম্প্রদায়ের পক্ষ থেকে শাহবাগে আন্দোলন করে দুর্গাপূজার সময় ৫ দিনের সরকারি ছুটিসহ ৮ দফা দাবি পেশ করা হয়েছে। এই দাবিগুলোর অনেকগুলোই কেবল একটি নির্বাচিত সরকারই পূরণ করতে পারে, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পক্ষে নয়।

এছাড়াও বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারাও বিভিন্ন দাবি নিয়ে সরকারকে চাপ দিচ্ছেন। কেউ কেউ জাতীয় সংগীত পরিবর্তন করার দাবিও তুলেছেন। যদিও একজন উপদেষ্টা স্পষ্ট করে বলেছেন যে তাদের কাজ প্রয়োজনীয় সংস্কার করে একটি নির্বাচনের দিকে এগিয়ে যাওয়া, এসব ইস্যু নিয়ে ভাবার সময় তাদের নেই। তা সত্ত্বেও, বাঙালির চিরাচরিত বিতর্ক, পক্ষে-বিপক্ষে বিভ্রান্তিকর তথ্য ছড়ানোর প্রবণতা থেমে নেই।

দেশে এখনো অস্থিতিশীল পরিবেশ বিরাজ করছে, সরকার এখনো সবকিছু স্বাভাবিক করতে পারেনি। এই অবস্থায় বিভিন্ন স্থানে দাবি-দাওয়া নিয়ে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করা অত্যন্ত দুঃখজনক। এরই মধ্যে, কিছু সুবিধাবাদী চাঁদাবাজি, লুটপাট ও জমি দখলের চেষ্টা করছে। অন্যদিকে, কেউ কেউ চুপিসারে প্রশাসন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ সব জায়গায় নিজেদের লোকদের ঢুকিয়ে দিচ্ছে। অনেকে আবার অবৈধভাবে আয়ের উৎসগুলো দখল করে নিচ্ছে।

অনেকে মনে করেন, বাংলাদেশে বিগত সময়ে যেসব সমস্যা দেখা দিয়েছে তার মূল কারণ সুস্থ গণতান্ত্রিক চর্চার অভাব। একটি কার্যকর সংসদ ও বিরোধী দল থাকলে হয়তো এমন পরিস্থিতি তৈরি হতো না। স্বচ্ছ প্রতিষ্ঠান গড়ে না তুলে, সুস্থ গণতান্ত্রিক চর্চা না করে, কেবল উন্নয়নের নামে জনগণের অসন্তোষকে দমিয়ে রাখলে তা কখনো টেকসই হয় না। জনগণের বিক্ষোভের প্রবল ঝাপটায় একসময় এমন উন্নয়ন তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়ে।

তাই, এই সরকারের কাছে সবার প্রত্যাশা হলো প্রয়োজনীয় সংস্কার করে একটি সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে দেশে গণতান্ত্রিক ও ক্ষমতা হস্তান্তরের সুস্থ ধারা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা। সবার উচিত এই সরকারকে তাদের মূল কাজটি করতে দেওয়া। অন্যথায়, বাংলাদেশ যদি একটি অকার্যকর রাষ্ট্রে পরিণত হয় তাহলে দাবি-দাওয়া আদায়ের পরিবেশটিও হারিয়ে যেতে পারে।

লেখক : ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক, একুশে পত্রিকা।