তৃতীয় দেশে রোহিঙ্গা পুনর্বাসন: আশার আলো, নাকি নতুন সংকটের পথ?


নজরুল কবির দীপু : রোহিঙ্গা সংকট বহু বছর ধরে বাংলাদেশে মানবিক, সামাজিক এবং কূটনৈতিক জটিলতার সৃষ্টি করেছে। এই সংকটের সমাধান খুঁজতে বাংলাদেশ সরকার এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় বিভিন্ন উদ্যোগ নিলেও এখন পর্যন্ত কার্যকর সমাধান আসেনি। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সাম্প্রতিক পুনর্বাসন সংক্রান্ত মন্তব্য অনেক রোহিঙ্গাকে তৃতীয় দেশে পুনর্বাসনের সম্ভাবনা সম্পর্কে আশাবাদী করে তুলেছে।

অনেক রোহিঙ্গা এখন তাদের পূর্বপুরুষের দেশ মিয়ানমারে ফিরে যাওয়ার চেয়ে তৃতীয় কোনো দেশে পুনর্বাসিত হওয়াকে প্রাধান্য দিচ্ছেন। তবে, এই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন কতটা কার্যকর হবে এবং এতে বাংলাদেশের জাতীয় স্বার্থ রক্ষিত হবে কি না, তা নিয়ে এখনো নানা প্রশ্ন ও উদ্বেগ রয়ে গেছে।

গত দুই বছর ধরে জাতিসংঘের শরণার্থী কমিশন ও আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার উদ্যোগে এবং বাংলাদেশ সরকারের সম্মতিতে, রোহিঙ্গা ক্যাম্প থেকে যুক্তরাষ্ট্রে পুনর্বাসনের কাজ গোপনে ক্ষুদ্র পরিসরে চলছিল। নিঃসন্দেহে, সরকারের সদিচ্ছা প্রকাশের ফলে এই প্রক্রিয়া এখন আরও গতি পাবে।

তবে, সরকারের পক্ষ থেকে তৃতীয় দেশে পুনর্বাসনের ইচ্ছা প্রকাশ করলেই কি ১০ লক্ষাধিক রোহিঙ্গার পুনর্বাসনে তৃতীয় দেশ দ্রুত ব্যবস্থা নেবে? রোহিঙ্গা গ্রহণের বিনিময়ে বাংলাদেশের কাছে তৃতীয় দেশের কী কী প্রত্যাশা থাকতে পারে? তাদের সব প্রত্যাশা কি বাংলাদেশের জাতীয় স্বার্থের জন্য অনুকূল হবে? এছাড়াও, যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার জন্য স্থানীয় জনগণের মধ্যে কেউ কেউ রোহিঙ্গা হিসেবে নাম লেখানোর চেষ্টা করবে না তো?

সম্ভবত এই প্রশ্নগুলো বিবেচনা করেই তৃতীয় দেশে রোহিঙ্গা পুনর্বাসনকে গতিশীল করা হবে। তবে, ২০১৭ সালে বা তার আগের বছরগুলোতে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ ঠেকানো যায়নি। ২০২৪ সালেও একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হচ্ছে। ভৌগোলিক এবং মানবিক কারণে বাংলাদেশ রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ বন্ধ করতে সবসময়ই ব্যর্থ হয়েছে। পুনর্বাসন কি আসলেই রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান? যদি তাই হয়, তাহলে মনে হবে মিয়ানমারের রোহিঙ্গারা বাংলাদেশকে করিডর হিসেবে ব্যবহার করে যুক্তরাষ্ট্রে যাচ্ছে। কারণ, একদিকে পুনর্বাসন হবে, অন্যদিকে নতুন করে রোহিঙ্গা আসবে, বিশেষ করে যারা এখন সীমান্তের ওপারে অপেক্ষা করছে।

গত দুই দশকে রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশের কূটনৈতিক দুর্বলতা স্পষ্ট ছিল। ফলে, পুরোনো বা নতুন- কোনো রোহিঙ্গাকেই ফেরত পাঠানোর উদ্যোগে বাংলাদেশ সফল হতে পারেনি। এই দুই দশকের প্রেক্ষাপটে, সরকারিভাবে রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে কোনো কার্যকর, ইতিবাচক ও বাস্তবসম্মত উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। এ অবস্থায়, প্রশ্ন জাগে, রোহিঙ্গা সমস্যা নিয়ে কিছু করার সময় কি এখনো আসেনি? নাকি যারা দায়িত্বে আছেন, তারা এখনো সমস্যার গভীরতা উপলব্ধি করতে পারছেন না?

অন্তর্বর্তী সরকারপ্রধানের তৃতীয় দেশে পুনর্বাসন সম্পর্কিত বক্তব্য রোহিঙ্গাদের মধ্যে আশার সঞ্চার করবে, এটাই স্বাভাবিক। তবে, দেশের স্বার্থ অক্ষুণ্ন রেখে যুক্তরাষ্ট্রে রোহিঙ্গা পুনর্বাসন প্রকল্প বাস্তবায়ন করলেও যে প্রশ্নটি উত্তরহীন থেকে যায়, তা হলো গণহত্যার বিচার।

শুধু যুক্তরাষ্ট্র নয়, যেকোনো দেশে রোহিঙ্গা পুনর্বাসন কার্যক্রম পরিচালিত হলে মিয়ানমারের কাছে ভুল বার্তা যাবে। মিয়ানমার ভাবতে পারে, গণহত্যা আসলে ঘটেনি, রোহিঙ্গারা বাংলাদেশি বলেই বাংলাদেশ নিজ দায়িত্বে তাদের পুনর্বাসন করছে। সরকারের রোহিঙ্গা পুনর্বাসনসংক্রান্ত ঘোষণায় রোহিঙ্গা এবং বাংলাদেশিদের খুশি হওয়ার যথেষ্ট কারণ থাকলেও, মিয়ানমারের জঘন্য অপরাধের দায়মুক্তিতে এর প্রভাব কী হবে, সেটিও ভাবতে হবে।

অন্যদিকে, চীনের সঙ্গে বাণিজ্যিক সমঝোতার মাধ্যমে মিয়ানমারে তার প্রভাব কাজে লাগিয়ে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে মিয়ানমারকে রাজি করানো গেলে (যদিও এটি বর্তমানে অতি কাল্পনিক মনে হয়), এর প্রভাব যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কে পড়বে।

বাংলাদেশের ভূ-রাজনৈতিক অবস্থান এবং অতীতের কূটনৈতিক সিদ্ধান্তের ফলে, দেশটিকে হয়তো যুক্তরাষ্ট্র অথবা চীনের পক্ষ নিতে হতে পারে, যা অন্য পক্ষের অসন্তুষ্টির কারণ হতে পারে। তবে এই অসন্তুষ্টি দূর করার প্রচেষ্টায়, বাংলাদেশকে সতর্ক থাকতে হবে যেন গণহত্যার অপরাধী মিয়ানমার কোনো ভুল বার্তা না পায়। মিয়ানমারে সংঘটিত গণহত্যার যথাযথ বিচার নিশ্চিত করা বাংলাদেশের নৈতিক দায়িত্ব।

এছাড়াও, স্বার্থপর চিন্তা পরিহার করে একটি জাতীয় শরণার্থী নীতি প্রণয়ন করা অত্যন্ত জরুরি। রোহিঙ্গা পুনর্বাসন সম্ভব না হওয়া পর্যন্ত তাদেরকে শরণার্থী হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করা উচিত। এর জন্য ১৯৫১ সালের কনভেনশনে স্বাক্ষর করা বাধ্যতামূলক নয়। রোহিঙ্গাদের স্থানীয় অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণের সুযোগ দিলে দাতা সংস্থার ওপর নির্ভরতা কমবে।

একই সাথে, বাংলাদেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে তাদেরকে শরণার্থী পরিচয়ে লেখাপড়ার সুযোগ দেওয়া উচিত, তাহলে মিথ্যা পরিচয়পত্র ও জন্মনিবন্ধন করিয়ে ভর্তি হওয়ার প্রয়োজন আর থাকবে না।

লেখক : ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক, একুশে পত্রিকা।